থ্যালাসেমিয়া: চিকিৎসা ও সচেতনতা জরুরি
আজ ৮ মে, বিশ্ব থ্যালাসেমিয়া দিবস। প্রতিবছরের মতো এবারও দেশব্যাপী সর্বসাধারণের মধ্যে এ রোগের চিকিৎসা ও প্রতিরোধ নিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির নানা কর্মসূচি চলছে। এবারে প্রতিপাদ্য হচ্ছে, ‘সচেতনতা, শেয়ার, যত্ন: থ্যালাসেমিয়ায় যত্নের ফাঁক পূরণে শিক্ষাকে শক্তিশালী করা।’
থ্যালাসেমিয়া এক ধরনের বংশগত রক্তরোগ। বাবা ও মা উভয়েই থ্যালাসেমিয়ার বাহক হলে, তাঁদের সন্তানদের মধ্যে কেউ কেউ থ্যালাসেমিয়ার রোগী হতে পারে, যার ফলে এক বছর বয়স থেকে রক্তশূন্যতা দেখা দেয় এবং প্রায় প্রতি মাসেই নিয়মিত রক্ত পরিসঞ্চালন করতে হয় তাদের স্বাভাবিক বয়োবৃদ্ধির জন্য।
থ্যালাসেমিয়ার বাহক
বাহক/কেরিয়ার/ ট্রেইট/ মাইনর—একই অর্থ বহন করে। থ্যালাসেমিয়ার বাহকেরা রোগী নয়, শুধু এ রোগের আংশিক ক্রুটিপূর্ণ জিন বহন করেন, ফলে তাদের স্বল্পমাত্রায় রক্তশূন্যতা থাকতে পারে। বাহ্যিকভাব তাদের কোনো লক্ষণ থাকে না, ফলে বাহক শনাক্ত করতে প্রয়োজন হিমোগ্লোবিন-ইলেকট্রোফরেসিস পরীক্ষা, আর থ্যালাসেমিয়া রোগ প্রতিরোধ করার জন্য প্রয়োজন দুজন বাহকের মধ্যে বিবাহ বর্জন করা। বাহকদের কোনো চিকিৎসার প্রয়োজন হয় না, তারা আয়রনজাতীয় খাবারসহ সব ধরনের খাবার স্বাভাবিক মাত্রায় খাবেন দেহের চাহিদা পূরণের জন্য। অনেকে আয়রনজাতীয় খাবার সম্পূর্ণ বর্জন করেন, যার কারণে সহজেই তারা রক্তশূন্যতায় ভোগেন ও দুর্বল হয়ে পড়েন।
থ্যালাসেমিয়ার চিকিৎসাব্যবস্থা মূলত দুই ধরনের: ১. মেডিকেল বা সাপোর্টিভ চিকিৎসা। ২. নিরাময়মূলক বা কিউরেটিভ চিকিৎসা।
১. মেডিকেল বা সাপোর্টিভ চিকিৎসা
থ্যালাসেমিয়া রোগীরা, বিশেষ করে যারা ট্রান্সফিউশন নির্ভরশীল; অর্থাৎ যাদের শিশুকাল থেকে নিয়মিত রক্ত নিতে হয়, রক্ত না নিলে সিভিয়ার রক্তশূন্যতা (৬ গ্রাম/মিলি এর কম) দেখা দেয়, যেমন থ্যালাসেমিয়া মেজর। এই চিকৎসাপদ্ধতির মধ্যে রয়েছে—
ক. নিয়মিত রক্ত পরিসঞ্চালন করা: কী পরিমাণ রক্ত প্রয়োজন, তা নির্ভর করে হিমোগ্লোবিন বৃদ্ধির পরিমাণ কত হবে, রোগীর ওজন এবং ডোনার ব্লাডের হিমাটোক্রিটের ওপর। নিয়মিত ও পরিমিত রক্ত পরিসঞ্চালন করলে শিশুর শারীরিক বৃদ্ধি ঘটে, প্লীহা স্বাভাবিক থাকে (অর্থাৎ Extramedulary Erythropoiesis হবে না), হাড়ের বিকৃতি (Thalassemia facies) হয় না, এ ক্ষেত্রে প্রিট্রান্সফিউশন হিমোগ্লোবিন টার্গেট ৯-১০ গ্রাম/ ডিএল। একদিনে ১০ মিলি/কেজির বেশি রক্ত (packed RBC) পরিসঞ্চালন করা উচিত নয়। পোস্টট্রান্সফিউশন হিমোগ্লোবিন টার্গেট ১২-১৩ গ্রাম/ ডিএল (তবে ১৫ গ্রামের বেশি নয়)। ট্রান্সফিউশনজনিত বিরূপ প্রতিক্রিয়া (অ্যালোইমিউনাইজেশন ও ফেবরাইল রিঅ্যাকশন) কমানোর জন্য অ্যান্টিবডি স্ক্রিনিং টেস্ট, লিউকোসাইট রোধক ফিল্টার ব্যবহার করা উত্তম।
খ. লাসপেট্যারসেপ্ট (inj Luspatercept /Reblozyl): নতুন আবিষ্কৃত এই ওষুধ ব্লাড ট্রান্সফিউশনের বিকল্প হিসেবে উন্নত দেশে ১৮ বছরের ঊর্ধ্বে রোগীদের ব্যবহার করা হয়। ওষুধটি অনেক ব্যয়বহুল এবং আমাদের দেশে এখনো পাওয়া যায় না। থ্যালাসেমিয়া রোগীদের বেলায় ১ এমজি/ কেজি হিসাবে তিন সপ্তাহ অন্তর অন্তর চামড়ার নিচে প্রয়োগে হিমোগ্লোবিন দুই গ্রাম/ মিলি বাড়াতে সক্ষম। (২৫ গ্রাম ওষুধের মূল্য ভারতে ১৩ হাজার রুপি, সেই হিসাবে বছরে ৪ থেকে ৫ লাখ রুপি প্রয়োজন ৪০ থেকে ৫০ কেজি ওজনের একজন রোগীর চিকিৎসা ব্যয়)।
গ. আয়রন কিলেটিং (লৌহ অপসারণ): নিয়মিত পরিসঞ্চালনের ফলে শরীরে বিশেষ করে লিভার, হার্ট ও এন্ড্রোক্রাইন গ্ল্যান্ডে অধিক পরিমাণে আয়রন জমে এসব অঙ্গের কার্যকারিতা কয়েক বছরের মধ্যে হ্রাস করে দিতে পারে। এক ব্যাগ রক্ত পরিসঞ্চালন করলে প্রায় ২০০ মিলি গ্রাম আয়রন দেহে প্রবেশ করে। অথচ শরীর থেকে প্রতিদিন মাত্র ১ মিলিগ্রাম আয়রন অপসারিত হতে পারে। রক্তে ফেরিটিনের পরিমাণ ১ হাজার মাইক্রোগ্রাম/ মিলির অধিক অথবা ২০ থেকে ২৫ ব্যাগ ব্লাড-ট্রান্সফিশন করার পরপরই নিয়মিত আয়রন কিলেটিং ওষুধ ব্যবহার করা জরুরি, ফলে অধিক আয়রনজনিত জটিলতা এড়ানো সম্ভব। আয়রন কিলেটিং ওষুধ ব্যবহারে শরীরে অতিরিক্ত জমে থাকা আয়রন মলমূত্রের সঙ্গে অপসারণ করে দেয়। আমাদের দেশে মুখে খাবার ও শিরায় নেওয়ার আয়রন কিলেটিং ওষুধ রয়েছে, যেমন Deferasirox, Deferiprone, Deroxamine, যা প্রয়োজনমতো একক বা যৌথভাবে ব্যবহার করা যায়।
ঘ. Hydroxyurea এবং Thalidomide ব্যবহার: এসবের ব্যবহারে কিছু কিছু ক্ষেত্রে Hb-F-এর উৎপাদনকে বাড়িয়ে থ্যালাসেমিয়ার তীব্রতা কমিয়ে দিতে পারে, যার ফলে ব্লাড-ট্রান্সফিউশনের চাহিদা কমে। কিন্তু ইন্ট্রামেডুলারি হেমোলাইসিস এবং অ্যাপোপটোসিসকে উন্নত করে না। উপরন্তু, হাইড্রোক্সিউরিয়া হলো মাইলোসাপরেটিভ থ্যালাসেমিয়ায় রক্তশূন্যতাকে সিকেল সেল রোগের তুলনায় অনেক বেশি মাত্রায় বাড়িয়ে দিতে পারে। তবে হাইড্রোক্সিউরিয়া সিকেল সেল রোগের বেলায় অধিক কার্যকর ভিন্ন রোগতত্ত্বের কারণে।
ঙ. প্লিহা অপারেশন (স্প্লেনেকটমি): এটা কোনো কার্যকর চিকিৎসাপদ্ধতি নয়, তবে বিশেষ কিছু কারণে স্প্লেনেকটমি করা হয়ে থাকে, যেমন বড় স্প্লিন সেই সঙ্গে হঠাৎ ব্লাড-ট্রান্সফিউশনের পরিমাণ বেড়ে গেলে (বছরে দ্বিগুণ), হাইপার-স্প্লিনিজিম (বিশাল স্প্লিনের কারণে প্যানসাইটোপেনিয়া) অথবা স্প্লেনিক ইনফার্কশন। তবে প্লিহা অপারেশন পরবর্তী সময় ইনফেকশনের আশঙ্কা বেড়ে যায়।
চ. থ্যালাসেমিয়াজনিত জটিলতা: শারীরিক বৃদ্ধি ও বয়ঃসন্ধি বিলম্বিত হওয়া, অস্টিওপেনিয়া ও অস্টিওপোরোসিস, হার্ট ফেইলিউর ও অ্যারিথমিয়া, পিত্তথলিতে পাথর, ডায়াবেটিস, হাইপোথাইরয়েড, থ্রোম্বসিস (রক্ত জমাট বাঁধার প্রবণতা বৃদ্ধি) ও লিভার ফাইব্রোসিসসহ নানা ধরনের জটিলতা দেখা দিতে পারে, যদি না যথাযথ চিকিৎসাব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।
নিরাময়মূলক (কিউরেটিভ) চিকিৎসা:
স্ট্যাম সেল ট্রান্সপ্ল্যানটেশন (বা বোন ম্যারো ট্রান্সপ্ল্যানটেশন) একমাত্র নিরাময়মূলক চিকিৎসাপদ্ধতি, যদিও ব্যয়বহুল ও এতে মৃত্যুঝুঁকি রয়েছে। কম বয়সী থ্যালাসেমিয়া রোগী, যাদের HLA ম্যাচ-ডোনার ও শরীরে আয়রনের পরিমাণ স্বাভাবিক, সেই সঙ্গে লিভার ও হার্ট স্বাভাবিক রয়েছে, তারাই ট্রান্সপ্ল্যানটেশনের জন্য উত্তম প্রার্থী এবং এ ক্ষেত্রে নিরাময়ের সম্ভাবনা প্রায় ৮০ থেকে ৮৫ শতাংশ, অর্থাৎ প্রয়োজন হবে না ব্লাড-ট্রান্সফিউশন আর জীবন হবে স্বাভাবিক। এ চিকিৎসাব্যবস্থা আমাদের দেশে এখনো অপ্রতুল ও সাধারণের সাধ্যের বাইরে (প্রায় ২০ থেকে ৩০ লাখ টাকার প্রয়োজন) তাই প্রয়োজন সরকারি উদ্যোগ ও পৃষ্ঠপোষকতা।
থ্যালাসেমিয়া ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশনের এক সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে যে উন্নয়নশীল দেশে মাত্র ১০ শতাংশ থ্যালাসেমিয়া রোগীরা মানসম্মত চিকিৎসার আওতায় আসতে পারছে। বাংলাদেশে থ্যালাসেমিয়ার রোগীদের জন্য চিকিৎসা সহজলভ্য করার জন্য সরকারি উদ্যোগ গ্রহণ ও থ্যালাসেমিয়া সমিতি হাসপাতালের চিকিৎসাসেবা কার্যক্রমকে সহায়তা দানে বিত্তবানদের এগিয়ে আসতে হবে।
অধ্যাপক ডা. এম. এ. খান উপদেষ্টা, বাংলাদেশ থ্যালাসেমিয়া সমিতি হাসপাতাল