
সালাম মানে শান্তি, ইসলাম মানে শান্তির জন্য আত্মসমর্পণ; মুসলিম মানে হলো শান্তিপ্রিয়। হাদিস শরিফে আছে, ‘প্রকৃত মুসলমান সেই ব্যক্তি, যার হাত ও জবান থেকে অন্য মুসলমান নিরাপদে থাকে বা কষ্ট না পায়।’ অথবা ‘প্রকৃত মুসলমান সেই ব্যক্তি, যার হাত ও জবান দ্বারা অন্য মুসলমান শান্তি পায়।’ (বুখারি শরিফ, খণ্ড: ১, ইমান অধ্যায়, পরিচ্ছেদ: ৪, হাদিস: ৯, পৃষ্ঠা: ১৭)। তাই কোনো মুসলমানের সঙ্গে অন্য কোনো মুসলমানের দেখা-সাক্ষাৎ হলে ইসলামি সম্ভাষণরীতি হলো সালাম বা শান্তি, নিরাপত্তা ও কল্যাণ কামনা। আরবিতে এই অভিবাদন বাক্যটি হলো: ‘আসসালামু আলাইকুম’। মানে হলো ‘আপনার প্রতি শান্তি বর্ষিত হোক’ বা ‘আপনি নিরাপদে থাকুন’। অর্থাৎ, আমার দ্বারা আপনার শান্তি ও নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে না, বরং কল্যাণ সাধিত হবে এবং আমার জ্ঞাতসারে অন্য কারও দ্বারাও আপনার শান্তি ও নিরাপত্তাহানি ঘটতে পারবে না।
যিনি শান্তির পথের পথিক, যিনি অন্যের নিরাপত্তা বিধানে সর্বদা সচেষ্ট, যিনি পরের মঙ্গল কামনা ও হিত সাধনায় সদা ব্রতী; সর্বোপরি যিনি সৃষ্টিকুলের শান্তি রক্ষার জন্য মহান স্রষ্টার প্রতি আত্মসমর্পণ করেছেন, তিনিই প্রকৃত ও যথার্থ মুসলিম।
ইমান মানে হলো বিশ্বাস ও নিরাপত্তা, মুমিন অর্থ হলো বিশ্বাসী, নিরাপদ ব্যক্তি ও নিরাপত্তা প্রদানকারী। আমরা জানি, মুসলিম হতে হলে তাকে অবশ্যই মুমিন হতে হবে। ইমান ও ইসলামের পরিসর ও ব্যাপ্তি যা-ই হোক না কেন, মুমিন মাত্রই মুসলিম এবং মুসলিম মাত্রই মুমিন। এ দুটি একে অন্যের পরিপূরক এবং একটির সঙ্গে অন্যটি গভীরভাবে সম্পৃক্ত। সুতরাং মুমিন ব্যক্তি প্রথমত, নিজে নিরাপদে থাকবেন; দ্বিতীয়ত, অন্যদের জন্য নিরাপদ হবেন। অর্থাৎ আপদ বা বিপদের কারণ হবেন না; তৃতীয়ত, সবার জন্য নিরাপত্তা বিধান করবেন, যেন কেউ কারও ক্ষতি সাধন করতে না পারে।
আল্লাহপাক রাব্বুল আলামিন স্বীয় পরিচয় প্রদান করতে গিয়ে বলেন, ‘তিনিই আল্লাহ, তিনি ব্যতীত কোনো ইলাহা নেই। তিনিই অধিপতি, তিনিই পবিত্র, তিনিই শান্তি, তিনিই নিরাপত্তা বিধায়ক, তিনিই রক্ষক, তিনিই পরাক্রমশালী, তিনিই প্রবল, তিনিই অতীব মহিমান্বিত। (আল-কোরআন, পারা: ২৮, সূরা (৫৯) হাশর, আয়াত: ২৩)। অত্র আয়াতে কারিমায় আল্লাহ তাআলা আপন কুদরতি পরিচয় প্রদান করতে গিয়ে নিজেকে ‘সালাম’ তথা শান্তির আকর এবং ‘মুমিন’ তথা নিরাপত্তা বিধায়ক বলে অভিহিত করেছেন।
নবী-রাসুলগণকে আল্লাহ দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন স্বীয় গুণাবলি প্রকাশ করতে। ইনসানে কামিল বা পরিপূর্ণ মানব মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর পরিচয় প্রদান করতে গিয়ে আল্লাহপাক কোরআনুল কারিমে ঘোষণা করেছেন: ‘অবশ্যই তোমাদের মধ্য থেকেই তোমাদের নিকট এক রাসুল এসেছেন, যা তোমাদিগকে বিপন্ন করে তা তাঁর জন্য কষ্টদায়ক। তিনি তোমাদের মঙ্গলকামী, মুমিনদের প্রতি তিনি দয়ার্দ্র ও পরম দয়ালু।’ (আল-কোরআন, পারা: ১১, সূরা (৯) তাওবা, আয়াত: ১২৮)। এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা ‘রউফ’ (স্নেহশীল-দয়ার্দ্র) ও ‘রহিম’ (পরম করুণাময় অসীম দয়ালু)—এ দুটি গুণবাচক নামে নিজেকে অভিহিত করেছেন।
>যিনি শান্তির পথের পথিক, যিনি অন্যের নিরাপত্তা বিধানে সর্বদা সচেষ্ট, যিনি পরের মঙ্গল কামনা ও হিত সাধনায় সদা ব্রতী; সর্বোপরি যিনি সৃষ্টিকুলের শান্তি রক্ষার জন্য মহান স্রষ্টার প্রতি আত্মসমর্পণ করেছেন, তিনিই প্রকৃত ও যথার্থ মুসলিম
মানুষ আল্লাহর খলিফা বা প্রতিনিধি। মহাগ্রন্থ আল-কোরআনে আল্লাহপাক বলেছেন: ‘আমি পৃথিবীতে প্রতিনিধি সৃষ্টি করছি।’ (আল-কোরআন, পারা: ১, সূরা (২) বাকারা, আয়াত: ৩০)। মানুষ আল্লাহর খলিফা বা প্রতিনিধি; তাই মানুষকে সামর্থ্যমতো ও প্রয়োজন অনুযায়ী আল্লাহর গুণাবলি অর্জন করতে হবে। আল্লাহ চান প্রতিটি মানুষ আল্লাহর রঙে রঙিন হোক। অর্থাৎ আল্লাহর গুণাবলি অর্জন ও ধারণ করে তা বিকশিত ও প্রসারিত করুক। তাই সফল মুমিন মুসলমানদের পরিচয় দিতে গিয়ে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন এভাবে বলেন: ‘আমরা আল্লাহর রং গ্রহণ করলাম, রঙে আল্লাহ অপেক্ষা কে অধিকতর সুন্দর? এবং আমরা তাঁরই ইবাদতকারী (অনুগত)।’ (আল-কোরআন, পারা: ১, সূরা (২) বাকারা, আয়াত: ১৩৮)।
যাঁরা যত বেশি প্রকৃত ইমানদার বা মুমিন ও মুসলিম, তাঁরা তত বেশি আল্লাহর রঙে রঙিন হয়েছেন এবং সেই রঙ্গে রঞ্জিত করেছেন অন্যদেরও। আল্লাহর রং হলো তাঁর সুন্দর সুন্দর গুণবাচক নামসমূহ। যথা: রহমান (অসীম দয়ালু), রহিম (পরম করুণাময়), গফুর (মায়াময়), গাফফার (অধিক ক্ষমাশীল), করিম (অতীব মেহেরবান), সাত্তার (দোষ গোপনকারী), সবুর (ধৈর্যশীল), হালিম (সহিষ্ণু) ইত্যাদি। আমরা যদি এসব গুণ অনুশীলন করি, তাহলে সমাজে শান্তিশৃঙ্খলা উপভোগ্য হয়ে উঠবে।
বিদায় হজের ভাষণের উপসংহারে প্রিয় নবী বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) ঘোষণা করেছেন: ‘জেনে রাখো! তোমাদের জান (প্রাণ), তোমাদের মাল (সম্পদ), তোমাদের সম্মান পরস্পরের জন্য হারাম, যেমন আজকের এ মাস (মহররম), তোমাদের এ শহর (মক্কা), আজকের এ দিন (আরাফাহ দিবস) সম্মানিত।’ (বুখারি শরিফ, খণ্ড: ১, ইলম অধ্যায়, পরিচ্ছেদ: ৫১, হাদিস: ৬৭, পৃষ্ঠা: ৫৫)।
এখানে তোমাদের বলতে মুমিন মুসলমানদের বোঝানো হয়েছে। মুমিন মুসলমান কারা? এ প্রসঙ্গে হাদিস শরিফে নবী করিম (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি আমাদের মতো সালাত আদায় করে, আমাদের কিবলামুখী হয় আর আমাদের জবাই করা প্রাণীর গোশত খায়, সে-ই মুসলিম; যার জন্য আল্লাহ ও তাঁর রাসুল জিম্মাদার। সুতরাং তোমরা আল্লাহর জিম্মাদারিতে খেয়ানত কোরো না।’ (বুখারি শরিফ, খণ্ড: ১, সালাত অধ্যায়, পরিচ্ছেদ: ২৬৯, হাদিস: ৩৮৪, পৃষ্ঠা: ২২১)।
মানবজীবনে দুটি হক বা অধিকার রক্ষা করাই মুখ্য। এ দুটি হলো আল্লাহর হক ও বান্দার হক। আল্লাহর হক আল্লাহ যাকে ইচ্ছাÿ ক্ষমা করবেন (শিরক ব্যতীত); বান্দার হক আল্লাহ ক্ষমা করবেন না। আর বান্দার হক বা অধিকার হলো তিনটি। যথা: জান, মাল, ইজ্জত তথা জীবন, সম্পদ ও সম্মান। অতএব, কোনোক্রমেই যেকোনোভাবেই হোক বান্দার হকের এ তিনটি বিষয় লঙ্ঘন করা যাবে না। যারা এ অধিকার ক্ষুণ্ন করল বা খর্ব করল, তারা আল্লাহর সীমানা লঙ্ঘন করল। আর যারা আল্লাহর সীমানা লঙ্ঘন করল, তারা নিজেদেরই ÿক্ষতি সাধন করল।
ইসলামি শরিয়তের পাঁচটি প্রধান উদ্দেশ্য হলো: জীবন রক্ষা, সম্পদ রক্ষা, সম্মান ও সম্ভ্রম রক্ষা, জ্ঞান রক্ষা, বংশ রক্ষা ও ধর্ম রক্ষা। এখানে প্রণিধানযোগ্য যে শরিয়তের মূল লক্ষ্যের শেষটি হলো ধর্ম রক্ষা এবং প্রথমটি হলো জীবন রক্ষা। কারণ, প্রাণ না থাকলে ধর্ম চলে না।
ইসলাম জীবন রক্ষার জন্য প্রাণপাতের বিধান দিয়েছে। কিন্তু তা নিয়ম ও বিধান মেনেই করতে হবে। কেউ যদি এমন কোনো অপরাধও করে, যাতে তার প্রাণ নিধনের বিধান রয়েছে; তবে তা কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর বাস্তবায়ন করা ইসলামসম্মত নয়; বরং তা যথাযথ আদালত ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষই কেবল বাস্তবায়নের এখতিয়ার রাখে। কারণ, কোরআন-হাদিসে বর্ণিত বিধিবিধান, যা অন্যের সঙ্গে সম্পর্কিত। অর্থাৎ যা ব্যক্তির একান্ত নিজের নয়; সমাজ ও রাষ্ট্রের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, তা কোনো ব্যক্তি বা সম্প্রদায় নিজেদের মতো করে বাস্তবায়ন করা শরিয়তসম্মত নয়। এটি কেবল আদালত ও প্রশাসনের দায়িত্ব।
মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী: যুগ্ম মহাসচিব: বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতি, সহকারী অধ্যাপক: আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম।
smusmangonee@gmail.com