নগদ আয় সহায়তা দিয়ে অর্থনীতি সচল করুন
করোনায় সব শ্রেণি-পেশার মানুষের আয়রোজগার-সঞ্চয় তলানিতে নেমেছে। দুবেলা খেয়ে–পরে বাঁচাই অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। দুর্ভোগ-দুশ্চিন্তা ক্রমাগত বেড়েই চলেছে।
জীবন ও জীবিকার সংকট
শুধু দরিদ্র ও অনানুষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত ব্যক্তিরা নয়, করোনা অধিকাংশ মানুষের জীবিকার ওপরই থাবা বসিয়েছে। উচ্চবিত্ত ২০ শতাংশ ও দরিদ্র সাড়ে ২০ শতাংশ হলে জনসংখ্যার ৬০ শতাংশই মধ্য ও নিম্নমধ্যবিত্ত। দারিদ্র্য পরিস্থিতি বেড়ে দ্বিগুণ হলে মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্তদের সংখ্যা অর্ধেকের বেশি কমে যাবে। মধ্যবিত্তের প্রায় ২০ শতাংশ সরকারি চাকরি করেন। নিম্নমধ্যবিত্তের ৫১ দশমিক ৬ শতাংশ বেসরকারি চাকরি করেন, ব্যবসায় যুক্ত ১৭ শতাংশ। করোনার অভিঘাত দরিদ্রকে চরম দরিদ্র, মধ্যবিত্তকে নিম্নমধ্যবিত্ত এবং নিম্নবিত্তকে দরিদ্রে রূপান্তরিত করেছে।
বেকারত্ব, দারিদ্র্য ও অসমতার উল্লম্ফন
উন্নয়ন অন্বেষণ এক গবেষণায় দেখিয়েছে, প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়ায় বেকারত্ব ৩ শতাংশের বেশি বাড়বে। দারিদ্র্য বর্তমানের দ্বিগুণের বেশি হবে। প্রায় ৪৩ দশমিক ৫ শতাংশ পরিবারের আয় আন্তর্জাতিক দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাবে। করোনা দীর্ঘস্থায়ী হলে এ হার ৪৭ দশমিক ৪৩ শতাংশ হতে পারে। অসমতা প্রকটতর হবে। গিনি সহগ দশমিক ৩২ থেকে বেড়ে দশমিক ৫০ হতে পারে। মজুরি প্রবৃদ্ধি পাঁচ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। পিপিআরসি ও ব্র্যাকের হিসাবে শহর ও গ্রামের মানুষের আয় কমেছে যথাক্রমে ৭৫ ও ৬২ শতাংশ। সাত কোটি মানুষ কর্মহীন ও দারিদ্র্যসীমার নিচে।
আনুষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিতদের শঙ্কা
৯০ লাখ মানুষ আনুষ্ঠানিক খাতে কাজ করেন। এ খাতের মাত্র ১৫ লাখ সরকারি, বাকি ৭৫ লাখ মানুষ বেসরকারি খাতে। ব্যক্তি খাতের অনেক প্রতিষ্ঠান সরকারঘোষিত ছুটিতে বেতন দেয়নি। অনেকে মাত্র ৩০-৪০ শতাংশ বেতন দিচ্ছে। ঈদের বোনাস দিচ্ছে না। সেবা খাতের কর্মীদের বেতন ৩১ দশমিক ২ শতাংশ কমেছে। গণপরিবহন ও আবাসিক পরিষেবাকর্মীদের বেতন কমেছে যথাক্রমে ৪৬ দশমিক ৩ শতাংশ এবং
১৬ দশমিক ৫ শতাংশ। তৈরি পোশাক খাতে ৩৫০টি কারখানার শ্রমিক বেকার হয়েছেন। ২২ লাখ শ্রমিক চাকরি হারিয়েছেন।
সরকারি, বেসরকারি ও বিদেশি ব্যাংকগুলোর আয় প্রায় ৬৬ শতাংশ কমেছে, কর্মীদের বেতন কমানো হচ্ছে। অনেক কর্মী ছাঁটাই হওয়ার দ্বারপ্রান্তে। ২৫টি রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল বন্ধ করে দেওয়ায় প্রায় ২৫ হাজার স্থায়ী শ্রমিক বেকার হয়ে পড়েছেন। অধিকাংশ বেসরকারি
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আংশিক বেতন পরিশোধ করছে অথবা কোনো অর্থই পরিশোধ করেনি। ব্যক্তি খাতের অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বিক্রির বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছে।
অনানুষ্ঠানিক খাতে মরণপণ দশা
পরিসংখ্যান ব্যুরো বলছে, ৮৬ শতাংশের ওপরে অর্থাৎ প্রায় ছয় কোটি মানুষ অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে নিযুক্ত। জিডিপিতে এ খাতের অবদান প্রায় ৪০ শতাংশ। কৃষি খাতে ২ কোটি ৩৮ লাখের বেশি কর্মী নিযুক্ত। শিল্প ও সেবা খাতে যথাক্রমে ১ কোটি ১১ লাখ ৬৮ হাজার ও ১ কোটি ৭০ লাখ শ্রমিক নিযুক্ত। তাঁরা দিন এনে দিন খান। নেই কোনো সঞ্চয়। শ্রম আইন অনুযায়ী ন্যূনতম মজুরি ও সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত।
ব্যক্তি খাতের চাকরিজীবীদের প্রতি ৩ জনের ২ জনই কুটিরশিল্প, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে নিয়োজিত। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের জরিপ অনুযায়ী, জিডিপির ২৫ শতাংশ আসে এ খাত থেকে। শিল্প খাতের কর্মসংস্থানের ৮৬ শতাংশই এ খাতে, সংখ্যায় প্রায় এক কোটি। এ খাতে ৫২ শতাংশ প্রতিষ্ঠান এবং উদ্যোগ বন্ধ হয়ে গেছে। ২৮ শতাংশ প্রতিষ্ঠানের আয় অর্ধেকে নেমে এসেছে। সরকারঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজের শর্ত সহজতর না হওয়ায় ক্ষুদ্র ও মাঝারি স্তরের উদ্যোক্তারা ব্যাংকব্যবস্থা থেকে ঋণ নিতে পারছেন না। খাদ্যসংকটে ৪৬ শতাংশ জেলে চড়া সুদে ঋণ নিতে বাধ্য হচ্ছেন। ব্র্যাক দেখিয়েছে, মহামারির মাত্র দেড় মাসে শস্য ও মত্স্য খাতে যথাক্রমে প্রায় ১৫ ও ৩৯ হাজার কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে। গড়ে প্রতিজন কৃষকের প্রায় ২ লাখ ৭ হাজার টাকা লোকসান।
যুব সম্প্রদায় চরম বিপাকে
আইএলও জানিয়েছে, প্রাক্-করোনাকালেই যুবকদের ২৭ দশমিক ৩৯ শতাংশ কোনো ধরনের কর্মসংস্থান, শিক্ষা অথবা প্রশিক্ষণে নিয়োজিত ছিলেন না। যুবকদের আয়ের সম্ভাব্য পথগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। অসংখ্য শিক্ষার্থী টিউশনি করে নিজের ও সংসারের খরচ চালাতেন। তাঁরা হাত গুটিয়ে বসে আছেন। অনেকেই নানা রকম অনানুষ্ঠানিক পেশা যেমন ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট, ফটোগ্রাফি, ট্যুরিস্ট গাইড ইত্যাদিতে খণ্ডকালীন নিয়োজিত ছিলেন। এখন সব বন্ধ হয়ে আছে। ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনেও কাজ বন্ধ।
নারী, বয়স্ক ও শিশুদের দুর্দশা
জনসংখার অর্ধেকের বেশি নারী। ২০২১ নাগাদ বাংলাদেশে প্রবীণ লোকের সংখ্যা দাঁড়াবে ১ কোটি ২০ লাখ। শূন্য থেকে ২৫ বছর বয়সীরা মোট জনসংখ্যার ৬০ শতাংশ। যেকোনো দুর্যোগের অভিঘাত বেশি পড়ে সমাজের নারী, শিশু, বৃদ্ধ, বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের ওপর । অর্থনৈতিক সংকোচনে দুশ্চিন্তা, অনিশ্চয়তা, শঙ্কা বেড়ে যাওয়ায় মানুষ ক্রমাগত মানসিকভাবে ভেঙে পড়ছে। তার প্রভাব পড়ছে ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে। কলহ-সহিংসতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। সামাজিক শৃঙ্খলা ভেঙে পড়ার হুমকি তৈরি হয়েছে।
ইতিমধ্যে নারী ও শিশু নির্যাতন বেড়েছে ৬৫ শতাংশ। বস্তিবাসী প্রায় ৯৮ শতাংশ নারী করোনাকালে পারিবারিক সহিংসতার শিকার। আয় কমে যাওয়ায় পরিবারে নির্ভরশীল বৃদ্ধ ও শিশুদের প্রয়োজনীয় চাহিদা পূরণ সম্ভব হচ্ছে না। এসএমই খাতের মোট ঋণের কমপক্ষে ১৫ শতাংশ নারী উদ্যোক্তাদের পাওয়ার কথা থাকলেও তাঁরা তা পাচ্ছেন না। সামাজিক নিরাপত্তায় নারী, শিশু, বয়স্কদের জন্য বরাদ্দ অপ্রতুল।
অভিবাসীদের গ্রামে ফিরে যাওয়া
বাংলাদেশের অগ্রযাত্রার গল্পটি ছিল গ্রাম থেকে অভিবাসীদের শহরে এবং বিদেশে শ্রমিক হিসেবে গমন। ইতিমধ্যে ৫০ হাজারের বেশি মানুষ শহর ছেড়েছে। দীর্ঘদিন গ্রামের বাইরে থাকায় অনেকেই এখন সরকারি ত্রাণসহায়তাও পাচ্ছেন না।
দুই লাখের বেশি অভিবাসী শ্রমিক দেশে ফিরেছেন। দেশে ফেরার অপেক্ষায় আছেন আরও লাখ লাখ অভিবাসী শ্রমিক। ফিরে এলে কাজের সুযোগ থাকবে না। গ্রামাঞ্চলে বেকারের সংখ্যা প্রায় ৭৭ লাখ। ছদ্ম বেকার ও নতুন বেকারদের যোগ করলে এ সংখ্যা অনেক অনেক বেড়ে যাবে।
সংকটে ভাড়াটে ও বাড়ির মালিক
ভাড়াটেরা বাড়িভাড়া দিতে পারছেন না। বাসা ছেড়ে দেওয়ায় সংকটে পড়েছেন বাড়ির মালিকেরা। যাঁরা ঋণ নিয়ে বাড়ি তৈরি করেছিলেন, তাঁরা ঋণের কিস্তি শোধ করতে পারছেন না। সংসার চালাতেও হিমশিম খেতে হচ্ছে। ঋণের সুদ পরিশোধ সাময়িক বন্ধ রাখা না হলে বা তাঁদের জন্য থোক বরাদ্দ না থাকলে বাড়িভাড়া কমানো সম্ভব হবে না।
বন্যা ও নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি
বন্যায় ১৪টি জেলার প্রায় সাড়ে তিন লাখ মানুষ পানিবন্দী। প্রায় ১৪ লাখ মানুষের ঘর ও ফসলের ক্ষতি হয়েছে। বন্যা–নদীভাঙনে ঘরবাড়ি ও নানা স্থাপনা নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। ভাঙনের কবলে পড়ছে বাঁধ। অন্যদিকে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণের দাম বেড়েছে। জুন মাসে মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। একসঙ্গে করোনার ঘাত এবং বন্যার থাবায় মানুষের ভোগান্তি ও দুর্দশা চরমে পৌঁছাবে।
সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি কার্যকর নয়
বিদ্যমান সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিগুলো পর্যাপ্ত নয়। পেনশন ভাতা, সঞ্চয়পত্রের সুদ ইত্যাদি বাদ দিলে এ বরাদ্দ ২০১৯-২০ অর্থবছরের ৯ শতাংশ থেকে হ্রাস পেয়ে ৭ দশমিক ৬ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। সরকারঘোষিত ৫০ লাখ পরিবারকে অর্থসহায়তা দেওয়ার কথা বলা হলেও ৩৪ লাখ এখনো টাকা পায়নি। সুবিধাভোগী নির্বাচনে চরম অনিয়ম পরিলক্ষিত হয়েছে। এমনকি প্রশাসনের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তারা প্রত্যক্ষভাবে উপস্থিত থেকেও অনিয়ম সামাল দিতে পারছেন না। কারণ, কর্মসূচিগুলো সর্বজনীন নয়, নির্দিষ্ট দল বা গোষ্ঠীকে কেন্দ্র করে নেওয়া। তাই অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সুবিধাভোগী নির্বাচন রাজনৈতিক পক্ষপাতদুষ্ট।
নগদ অর্থ সহায়তা দিয়ে অর্থনীতি সচল করুন
মোট রাজস্বের প্রায় ৭০ শতাংশ আসে পরোক্ষ কর থেকে। এর মধ্যে ভ্যাট থেকেই আসে প্রায় ৩৯ শতাংশ। অর্থাৎ সিংহভাগ রাজস্বই আসে খেটে খাওয়া মানুষের কাছ থেকে। তাই জনগণের টাকা থেকেই আগামী ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত জনগণকে আপৎকালীন নগদ সহায়তা দিতে হবে। জাতীয় পরিচয়পত্রের বিপরীতে জরুরি হিসাব খুলে টাকা পাঠাতে হবে। আন্তর্জাতিক দারিদ্র্যসীমা ১ দশমিক ৯০ ডলার অনুসারে মাসে মাথাপিছু ৪ হাজার ৮৪৫ টাকা পৌঁছে দিতে হবে। অনানুষ্ঠানিক খাতের সবাইকে এ কর্মসূচির অধীনে নগদ সহায়তা দিতে হবে। আর জাতীয় রাজস্ব বোর্ড থেকে পে-রোল ডেটা নিয়ে সরকারি চাকরিজীবী ছাড়া আনুষ্ঠানিক খাতে বাজেটে ঘোষিত করসীমার নিচে অবস্থানকারী সবাইকে নগদ সহায়তার অধীনে আনতে হবে।
ভারত ও পাকিস্তানে ঋণ জিডিপির যথাক্রমে ৭৩ দশমিক ৮০ এবং ৮৩ দশমিক ৩৫ শতাংশ হলেও দেশ দুটি নগদ টাকা সহায়তা দিয়েছে। সে তুলনায় বাংলাদেশে ঋণ জিডিপির মাত্র ৩৩ শতাংশ। সর্বজনের জীবনের নিরাপত্তা ও সামাজিক স্থিতিশীলতার জন্য নগদ অর্থসহায়তা দিয়ে অর্থনীতির চাকা সচল করার কোনো বিকল্প নেই।
ড. রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক এবং উন্নয়ন
অন্বেষণের চেয়ারপারসন