২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

বড় বন্যার আভাস দিচ্ছে আবহাওয়া ও জলবায়ু

প্রথম আলো ফাইল ছবি
প্রথম আলো ফাইল ছবি

বাংলাদেশে ২০২০ বর্ষা মৌসুমে স্বাভাবিকের চেয়ে বড় মানের একটি বন্যার সম্ভাবনা নির্দেশ করছে আবহাওয়া ও জলবায়ুর সূচকগুলো। বাংলাদেশে চলমান বন্যা পরিস্থিতি ও আগামীতে তার বিস্তার নিয়ে গণমাধ্যমগুলো বিভিন্ন বিশেষজ্ঞের উদ্ধৃতি দিয়ে সম্ভাব্য একটি বড় বন্যার কথা বলছে। দুর্ভাগ্যবশত বেশির ভাগ রিপোর্টেই বন্যার প্রকৃত কারণ অর্থাৎ বন্যার সঙ্গে সম্পর্কিত আবহাওয়া ও জলবায়ুবিষয়ক তথ্যগুলো অনুপস্থিত।

আবহাওয়া ও জলবায়ুবিষয়ক বিভিন্ন তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, ২০২০ সালে বাংলাদেশে স্বাভাবিকের চেয়ে বড় মানের একটি বন্যার সম্ভাবনা অনেক বেশি।

ভারতীয় উপমহাদেশের মৌসুমি বৃষ্টিপাতের সঙ্গে মেডেন-জুলিয়ান বা সংক্ষেপে এমজেও, এল-নিনো ও লা-নিনা নামের তিনটি দোলন বা স্পন্দন নামের তিনটি সূচক, বঙ্গোপসাগরের সমুদ্রপৃষ্ঠের পানির স্বাভাবিক তাপমাত্রার বিচ্যুতি ও ২৬ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড পানির স্তরের গভীরতা প্রত্যক্ষভাবে জড়িত বলে আবহাওয়া বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন গবেষণায় প্রমাণ পেয়েছেন। এ ছাড়া কালবৈশাখী মৌসুমে হওয়া বৃষ্টিপাতের ফলে মাটির আর্দ্রতার সঙ্গেও বৃষ্টিপাত ও বন্যার সম্পর্ক প্রমাণিত। মেডেন-জুলিয়ান আবহাওয়া চক্রটির অবস্থান দেখে কোনো স্থানের দৈনন্দিন ও সাপ্তাহিক আবহাওয়ার পূর্বাভাস করা যায়। পক্ষান্তরে এলনিনো ও লা-নিনা অবস্থা বিশ্লেষণ করে কোনো স্থানের মাসিক, অর্ধমৌসুমি বা মৌসুমি আবহাওয়ার পূর্বাভাস করা হয়। বাংলাদেশের বর্ষা মৌসুমের বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ও বন্যার তীব্রতার সঙ্গে এল-নিনো ও লা-নিনার প্রভাব ইতিমধ্যেই প্রমাণিত।

কোন বছরে বাংলাদেশে বন্যার তীব্রতা কেমন হতে পারে, তার প্রধান একটি নির্দেশক হলো উত্তর ভারত মহাসাগর, বিশেষ করে বঙ্গোপসাগর ও আরব সাগরের পানির তাপমাত্রার বিচ্যুতি। গত ৩৮ বছরের আরব সাগর ও বঙ্গোপসাগরের পানির তাপমাত্রা বিশ্লেষণ করে প্রমাণ পাওয়া যায় যে বছরগুলোতে (যেমন ১৯৮৮, ১৯৯৮, ২০১৬ ইত্যাদি) মে-জুন মাসে বঙ্গোপসাগরে পানির তাপমাত্রা সর্বোচ্চ ছিল, সেই বছরগুলোতে বাংলাদেশে তীব্র বন্যা সংঘটিত হয়েছে।

বাংলাদেশের জলবায়ু পর্যালোচনা করে দেখা যায় সাধারণত যে বছর এল-নিনো অবস্থা বিরাজ করে, সেই বছর বর্ষা মৌসুমে স্বাভাবিকের চেয়ে কম বৃষ্টিপাত হয়ে থাকে, বিপরীতক্রমে যে বছর লা-নিনা বা নিরপেক্ষ অবস্থা বিরাজ করে, সেই বছর বর্ষা মৌসুমে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত হয়ে থাকে। এল-নিনো অবস্থা শেষ হওয়ার অব্যবহিত পরের বর্ষা মৌসুমে (যে সময় নিরপেক্ষ অবস্থা বিরাজ করে) বাংলাদেশে বড় মানের বন্যা সংঘঠিত হয়ে থাকে। গত ৪০ বছরে সবচেয়ে শক্তিশালী এল-নিনো হয়েছে ১৯৮২-১৯৮৩, ১৯৮৭-১৯৮৮, ১৯৯৭-১৯৯৮ ও ২০১৫-২০১৬ সালে। ২০১৫-২০১৬ ও ১৯৯৭-১৯৯৮ সালের এল–নিনো অবস্থা ছিলও গত ১০০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী।

স্বাধীনতার পরে বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বাপেক্ষা বড় তিনটি বন্যা হয়েছে ১৯৮৮, ১৯৯৮ ও ২০১৬ সালে। এ ছাড়া গত ২০ বছরে স্বল্প সময়ের জন্য ও ছোট মানের বন্যা হয়েছিল ২০০৭ (দুর্বল এল–নিনো অবস্থা) ও ২০১০ (শক্তিশালী এল–নিনো অবস্থা) সালে। দৈবক্রমে এই বন্যা দুটিও সংঘঠিত হয়েছিল এল–নিনো অবস্থা শেষ হওয়ার অব্যবহিত পরের বর্ষা মৌসুমে। ১৯৯৭-১৯৯৮ ও ২০১৫-২০১৬ সালের এল–নিনো অবস্থা শেষ হয়ে নিরপেক্ষ অবস্থায় প্রবেশ করেছিল সংশ্লিষ্ট বছরের মে মাসে। দৈবক্রমে ২০১৯-২০২০ সালের অপেক্ষাকৃত দুর্বল এল–নিনো অবস্থার অবসান হয়েছে গত মে মাসে এবং বর্তমানে নিরপেক্ষ অবস্থা বিরাজ করছে।

বাংলাদেশে বর্ষাকালে বৃষ্টিপাত পর্যবেক্ষণ করলে লক্ষ করা যায় কিছুদিন দেশব্যাপী নিয়মিত বৃষ্টির পরে ১ থেকে ৩ সপ্তাহ প্রায় বৃষ্টিহীন থাকে। এই অতিবৃষ্টি ও অনাবৃষ্টির চক্রটা আবহাওয়া বিজ্ঞানীরা ব্যাখ্যা করে থাকেন মেডেন-জুলিয়ান নামের আবহাওয়া চক্রের মাধ্যমে। মেডেন-জুলিয়ান চক্রটির বর্তমান অবস্থান বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, জুলাই মাসের তৃতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত বাংলাদেশ ও ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে প্রচুর বৃষ্টিপাত হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে।

২০২০ সালে কালবৈশাখীর মৌসুমে বাংলাদেশে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত হয়েছে, ফলে বর্ষা মৌসুমের শুরুতে মাটির আর্দ্রতা স্বাভাবিক অপেক্ষা বেশি বিরাজ করছে। পূর্বে উল্লেখ করেছি, কোনো স্থানের বৃষ্টিপাতের ওপর ওই স্থানের মাটির আর্দ্রতার একটা প্রভাব থাকে। মাটি শুষ্ক থাকলে কম বৃষ্টিপাত হবে; মাটি আর্দ্র থাকলে বেশি বৃষ্টিপাত হবে। দেশের স্থলভাগের বেশির ভাগ অংশের মাটি ইতিমধ্যেই সম্পৃক্ত, তাই বৃষ্টির পানি মাটিতে পড়ার পরে শোষিত না হয়ে গড়িয়ে নদী-নালায় পতিত হয়ে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি ঘটাবে।

ওপরে উল্লিখিত কারণগুলো প্রধান ভূমিকা রাখলেও বায়ুমণ্ডলে গ্রিনহাউস গ্যাস বৃদ্ধির ফলে বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা বৃদ্ধির কিছু প্রভাব রাখতে পারে সম্ভাব্য অতিবৃষ্টি ও বন্যার ওপরে। ২০২০ সালের মে মাসটি ছিল যুগ্মভাবে ২০১৬ সালের মে মাসের সঙ্গে পৃথিবীর তাপমাত্রা পরিমাপের ইতিহাসে সর্বোচ্চ গড় তাপমাত্রার মাস।

অতিবৃষ্টির মূল কারণগুলোর একটি হলো বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে সমুদ্রের পানির তাপমাত্রা বৃদ্ধি ও তার কারণে সমুদ্রের পানির বাষ্পায়ন বৃদ্ধি পেয়ে বায়ুমণ্ডলে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়া। আজ থেকে ৫০ বছর আগে বছরের কোনো এক নির্দিষ্ট মাসে বায়ুমণ্ডলে যে পরিমাণ জলীয় বাষ্প উপস্থিত থাকত, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তা অপেক্ষা বেশি পরিমাণ জলীয় বাষ্প উপস্থিত থাকছে ও অতিবৃষ্টি আকারে তা ভূ-পৃষ্ঠে পতিত হয়ে পানিচক্র পূর্ণ করছে।

আবহাওয়ার পূর্বাভাস বিজ্ঞানের তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক অভূতপূর্ব উন্নতির ফলে বর্তমানে ৩ থেকে ১৫ দিন আগের আবহাওয়া পূর্বাভাস করা যায় অনেক নিখুঁতভাবে। সুপার কম্পিউটারের সহজলভ্যতা বেড়ে যাওয়ায় বিশ্বের প্রধান প্রধান আবহাওয়া পূর্বাভাস সংস্থাগুলো প্রতি ৬ ঘণ্টা পরপর সারা বিশ্বের আগামী এক থেকে দুই সপ্তাহ পর্যন্ত আবহাওয়া পূর্বাভাস প্রদান করে থাকে। আমেরিকার আবহাওয়া পূর্বাভাস সংস্থার ‘গ্লোবাল ফোরকাস্ট সিস্টেম’ নামের আবহাওয়া পূর্বাভাস মডেলের ১০ জুলাইয়ের সর্বশেষ পূর্বাভাস অনুসারে, বাংলাদেশের উত্তর দিকে ভারতের হিমালয় পর্বতের পাদদেশ এবং আসাম ও মেঘালয় রাজ্যে জুলাই মাসের ২১ তারিখে পর্যন্ত নিয়মিতভাবে ভারী বৃষ্টিপাত হতে পারে। এই বৃষ্টিপাতের প্রায় পুরোটা তিস্তা ও ব্রহ্মপুত্রের মাধ্যমে বাংলাদেশে প্রবেশ করবে এবং যমুনা নদীর দুই কূলবর্তী জেলাগুলোয় বন্যা পরিস্থিতির ব্যাপক অবনতি ঘটাতে পারে।

সুতরাং ২০২০ সালের বর্ষা মৌসুমে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি বৃষ্টি ও তীব্র বন্যার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে এবং আবহাওয়া পূর্বাভাসের গাণিতিক মডেলগুলোও তা সমর্থন করছে। চলমান করোনা মহামারির কারণে বাংলাদেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা ইতিমধ্যেই চাপের মধ্যে আছে। সম্ভাব্য একটি বড় মানের বন্যা–পরবর্তী সময়ে কলেরার প্রাদুর্ভাব দেখা গেলে দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা সম্পূর্ণরূপে ভেঙে পড়তে বাধ্য। সুতরাং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়, খাদ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা ও সরকারের নীতিনির্ধারণী ব্যক্তিদের সম্ভাব্য অতিবৃষ্টি ও বন্যা মোকাবিলায় পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নিয়ে রাখা জরুরি।

মোস্তফা কামাল: আবহাওয়া ও জলবায়ুবিষয়ক পিএইচডি গবেষক। স্কুল বফ এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সাস্টেনিবিলিটি সাসকাচোয়ান বিশ্ববিদ্যালয়, কানাডা।