জীবন ও জীবিকার সন্ধিস্থলে ভবিষ্যতের পাথেয়র খোঁজ
কোভিড-১৯ বা করোনাভাইরাসের ত্রাসের এ রাজত্ব কবে শেষ হবে, তা কেউ জানে না। জীবন রক্ষার্থে এবং প্রতিরোধমূলক চিকিৎসা ব্যবস্থার সুবিধার্থে অধিকাংশ দেশই ‘লকডাউন’ কৌশলকেই আপাতসমাধান হিসেবে বেছে নিয়েছে। কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে এই স্বেচ্ছাগৃহবন্দিত্ব এবং স্থবির অর্থনৈতিক দশা কোনো চূড়ান্ত সমাধান নয়। তাই এই মুহূর্তে বিশ্বের প্রতিটি দেশকেই এমন কিছু কার্যকর কৌশল অনুসন্ধান করতে হচ্ছে, যার ফলে নাগরিকদের জীবনের যথাসম্ভব সর্বোচ্চ সুরক্ষা প্রদানের সঙ্গে সঙ্গে জীবিকার স্বার্থে দেশীয় অর্থনীতির চাকাও সচল রাখা যাবে। বিশেষ করে, বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল অর্থনীতির জন্য করোনাসংকট একটি গভীর দুর্যোগ। আমাদের মতো একটি উদীয়মান অর্থনীতির দেশে, যেখানে কয়েক বছরের নিরন্তর চেষ্টায় উন্নয়নের বিভিন্ন সূচকে স্থিতিশীল অগ্রগতি অর্জিত হয়েছে, সেখানে এই অপ্রত্যাশিত সংকটের কারণে দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক কৌশলে ভিন্নমাত্রিক পুনর্বিন্যাসের প্রয়োজনীয়তা সৃষ্টি হয়েছে।
টেকসই উন্নয়ন অর্জনের জন্য বাংলাদেশ যে রূপরেখা প্রণয়ন করেছে তা বাস্তবায়নে এবং যেসব লক্ষ্যমাত্রা স্থির করেছিল সেসব অর্জনের ক্ষেত্রে ২০২০-২১ অর্থবছর কৌশলগতভাবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বছর। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতেও টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার রূপরেখা ও কর্মকাঠামো অপরিবর্তিত রেখেই করোনা মোকাবিলার কৌশল নির্ধারণ করা সম্ভব। টেকসই উন্নয়নের মূল অ্যাজেন্ডা হলো সামগ্রিক জনগোষ্ঠীকে অন্তর্ভুক্ত করে উন্নয়ন কার্যক্রম অব্যাহত রাখা। করোনা মোকাবিলার ক্ষেত্রেও এই অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জ মাথায় রেখেই কাজ করতে হবে। সরকারের প্রণোদনা ও বৃত্তিমূলক সহায়তা এবং কৌশলগত পরিকল্পনার পরিধির বাইরে যেন কোনো নাগরিক না থাকেন, তা নিশ্চিত করতে হবে।
দারিদ্র্য দূরীকরণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সাম্প্রতিক সময়ে প্রভূত উন্নতি অর্জন করেছে। বাংলাদেশের দারিদ্র্যের হার হ্রাস পেয়ে ২০.৫ শতাংশে উপনীত হয়েছে। কিন্তু এই করোনাসংকটের সময়ে এসে দেখা গেল, আমাদের বিপুলসংখ্যক জনগোষ্ঠী, যারা দারিদ্র্যসীমার ওপরে ছিল, অর্থনীতির এই নাজুক পরিস্থিতিতে তারা দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করছে। এ থেকে বোঝা যায়, দেশের একটি বৃহৎ জনগোষ্ঠীর জীবিকা নির্বাহের কোনো টেকসই পন্থা ছিল না। যার ফলে অর্থনৈতিক দুর্যোগকালে তাঁরা উপার্জন-অক্ষম বিপন্ন জনগোষ্ঠীতে পরিণত হয়েছেন। এই পরিস্থিতিতে আমাদের করণীয় নির্ধারণে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদে কয়েকটি বিষয় খেয়াল রাখতে হবে।
এক. স্বল্প মেয়াদে এই নতুন করে দারিদ্র্যে নিমজ্জিত হওয়া জনগোষ্ঠীকে এমন এক সুসমন্বিত বণ্টন ব্যবস্থার আওতায় আনতে হবে, যাতে করে তাঁরা জীবন নির্বাহের মৌলিক চাহিদা পূরণ করতে সক্ষম হন।
দুই. মধ্যমেয়াদি পরিকল্পনার মাধ্যমে তাঁদের অর্থনৈতিক কাঠামোতে এমনভাবে যুক্ত করতে হবে, যাতে করে তাঁদের উপার্জনসক্ষমতা টেকসই হয় এবং যেকোনো ঝুঁকি বা দুর্যোগ মোকাবিলার ক্ষেত্রে তাঁরা ব্যক্তিগত পর্যায়ে কার্যকর আর্থিক ব্যবস্থাপনায় সক্ষম হন।
তিন. দারিদ্র্যের হার নির্ধারণপদ্ধতি এবং দীর্ঘ মেয়াদে দারিদ্র্য বিমোচন কৌশল প্রণয়নের পদ্ধতিগত রূপ সম্পর্কে নতুন করে ভাবতে হবে। এবারের অভিজ্ঞতা থেকে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে বর্তমানে নির্ধারিত দরিদ্রতার নিম্নসীমা অত্যন্ত ভঙ্গুর। জনগোষ্ঠীর যে অংশকে আমরা দারিদ্র্যসীমার ঊর্ধ্বে বিবেচনা করেছি, তারা আসলে একটি দোদুল্যমান অর্থনৈতিক অবস্থায় আছে। দারিদ্র্যকে আমরা আয়ের অঙ্ক হিসাবে সংখ্যাগতভাবে দেখেছি এবং সেই অনুপাতেই দারিদ্র্যের হার নির্ধারণ করেছি। কিন্তু দারিদ্র্যের আপেক্ষিক রূপটিও যে সম্যক বিবেচ্য, সেই বাস্তবতাই এবার উপলব্ধি হলো। তাই আমাদের এমন একটি পদ্ধতি বেছে নিতে হবে, যাতে করে প্রকৃত আয়ের হিসাবে প্রকৃত দারিদ্র্যের হার নিরূপণ করা যায় এবং সেই মোতাবেক দীর্ঘমেয়াদি জাতীয় কৌশল প্রণয়নের মাধ্যমে নাজুক সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতেও ব্যষ্টিক ও সামষ্টিক অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণের সক্ষমতা অর্জন করা সম্ভব হয়।
ইতিমধ্যে সরকার পোশাকশিল্পসহ অন্যান্য খাতের জন্য বিবিধ প্রকারের প্রণোদনামূলক ব্যবস্থার ঘোষণা দিয়েছে। প্রথমত, এই বিপুল পরিমাণ প্রণোদনা বাস্তবায়ন ও বণ্টনের ক্ষেত্রে যেন স্বচ্ছতা বজায় থাকে এবং দ্বিতীয়ত, এই প্রণোদনার বণ্টনে যেন কোনো বৈষম্যের সৃষ্টি না হয়—এই দুটি বিষয় অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে।
এডিবির কাছ থেকে প্রাপ্ত ঋণের একটি বড় অংশ সরকার ব্যয় করবে দরিদ্র মানুষের কাছে সরাসরি অর্থ ও খাদ্যসহায়তা পৌঁছে দেওয়ার মাধ্যমে। এই উদ্যোগের ফলে প্রায় দেড় কোটি মানুষ উপকৃত হবে। কিন্তু এই অর্থ কারা কীভাবে পাবে, এই তালিকা প্রস্তুতের ক্ষেত্রে যেন কোনো অনিয়ম না হয়, সেটি নিশ্চিত করতে হবে। উচ্চবিত্তের জন্য নানাবিধ প্রণোদনা এবং দরিদ্রদের জন্য ত্রাণ সহায়তা—এই দুইয়ের মধ্যে যেন মধ্যবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত জনগোষ্ঠী আমাদের দৃষ্টি ও উদ্যোগের আওতা থেকে অপসৃত হয়ে না যায়, সেটিও বিশেষভাবে খেয়াল রাখতে হবে।
ইতিমধ্যেই অনেক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন এবং অনেকে ব্যক্তিগত উদ্যোগে করোনাসংকট মোকাবিলায় এগিয়ে এসেছেন। সরকারি-বেসরকারি-স্বেচ্ছাসেবী—এই ত্রিমাত্রিক কর্মযজ্ঞের মধ্যে সমন্বয় করা প্রয়োজন, যাতে করে অনেক বেশি মানুষ অর্থনৈতিক সুরক্ষার আওতায় আসতে পারে।
সামনেই জাতীয় বাজেট প্রণয়নের সময়। এবারের বাজেটে সরকারকে কিছু জটিলতার সমাধান করতে হবে। যেমন অর্থনীতির এই পরিস্থিতিতে এবার বিপুলসংখ্যক করদাতা করযোগ্য আয়সীমার নিচে অবস্থান করবেন। এর ফলে বাজেটের আয় খাত নিয়ে সরকারকে নতুন করে ভাবতে হবে, এই অর্থবছরে অর্থের সংকুলান কোথা থেকে হবে; সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হবে। বাজেট ঘাটতি কীভাবে পূরণ হবে; সরকার কি অভ্যন্তরীণ ঋণ বেশি নেবে, নাকি বৈদেশিক ঋণের ওপর নির্ভর করবে; অর্থপ্রবাহ বৃদ্ধিতে টাকা ছাপানোর মুদ্রানীতি কি বাস্তবসম্মত সমাধান; পরবর্তী সময়ে মূল্যস্ফীতি কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হবে; এই ধরনের দ্বিধাবিভক্তির যৌক্তিক সমাধান খোঁজাই এবারের বাজেটের মূল চ্যালেঞ্জ।
আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ হবে এডিপি বাস্তবায়ন করা। আমাদের এডিপি বাস্তবায়নের কাজ হয় মূলত শেষ পর্বে; অর্থাৎ এপ্রিল-মে-জুন মাসে, এবার লকডাউনের কারণে যা সম্ভব হয়নি। সে ক্ষেত্রে পরবর্তী অর্থবছরের এডিপি প্রণয়ন করতে হবে সম্পূর্ণ অনুমাননির্ভর হয়ে। এটি অর্থনীতির জন্য একটি বড় সমস্যা।
এবারের করোনাসংকট আমাদেরকে স্বাস্থ্য খাতের দুর্বলতাগুলো চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে। তাই আমাদের প্রারম্ভিক কাজ হবে স্বাস্থ্য খাতের অবকাঠামোর আধুনিকায়ন, চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের সুরক্ষা, প্রশিক্ষণ ও পর্যাপ্ত পারিশ্রমিক প্রদান এবং স্বাস্থ্যসেবার সক্ষমতা প্রসারণ ও মান বৃদ্ধি। আমরা যদিও এডিবি থেকে প্রাপ্ত অর্থে করোনা চিকিৎসার অবকাঠামো উন্নয়নের প্রকল্প হাতে নিয়েছি, কিন্তু এর বাস্তবায়নের কাজ হতে হবে দ্রুত এবং সেই সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনাগুলো হতে হবে টেকসই। স্বাস্থ্য সেবাপ্রাপ্তির সুলভ সম্প্রসারণ নিশ্চিত করতে সরকারি ও বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবার মধ্যে সমন্বয় সাধন করতে হবে। স্বাস্থ্য খাতের বাজেট বাড়াতে হবে। গত অর্থবছরের বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ ছিল জিডিপির ১ শতাংশেরও কম; এ বছর অন্তত তা ৩ শতাংশ করা উচিত। স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দ বৃদ্ধির ক্ষেত্রে এই মুহূর্তে অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ কোন খাতে বরাদ্দ কমানো হবে, তা নির্বাচন করার ক্ষেত্রেও প্রাজ্ঞতার পরিচয় রাখতে হবে। মনে রাখতে হবে, জনস্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগ আসলে পরোক্ষভাবে অর্থনৈতিক বিনিয়োগই। যত বেশি মানুষ ‘ট্রেস-টেস্ট-ট্রিট’—এই তিন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে করোনার আক্রমণ থেকে মুক্ত হবে, তত বেশি সংখ্যায় তারা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হতে পারবে। তাই এই বিষয়ে সর্বোচ্চ মনোযোগ দেওয়ার কোনো বিকল্প নেই।
কৃষি খাতকে এবার অগ্রাধিকার দিতে হবে। বিশ্বের প্রতিটি দেশ যেখানে বিচ্ছিন্ন হয়ে আছে; সেখানে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা এখন অর্থনৈতিক সক্ষমতার প্রধান শর্ত। তাই কৃষি খাতের উৎপাদন, সরবরাহ ও বণ্টনের যে চক্র, তা নিরবচ্ছিন্ন ও নিরাপদ রাখতে হবে। কোনোভাবেই যেন চাহিদা ও জোগানের জটিলতার কারণে কৃষক ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত না হন, তা নিশ্চিত করতে হবে। কৃষক ও কৃষির সুরক্ষায় প্রয়োজনে ভর্তুকি বাড়াতে হবে, কৃষকদের জন্য সুদমুক্ত ঋণের ব্যবস্থা করতে হবে। একই ভাবে, ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্পগুলো যেন দেশের অর্থনীতিকে উদ্দীপ্ত করতে পারে, দেশীয় বাজারে এর ভিত্তি বজায় রাখতে পারে, সেই উদ্যোগ নিতে হবে। রপ্তানিমুখী শিল্পের বাজার ধরে রাখতে সরকারকে যুগপৎভাবে বাণিজ্যিক ও কূটনৈতিক তৎপরতা চালু রাখতে হবে। আমাদের শিক্ষা খাত একেবারেই স্থবির হয়ে রয়েছে। পরিস্থিতি চূড়ান্ত স্বাভাবিক পর্যায়ে যাওয়ার কাল অনির্দিষ্ট; তাই আর অপেক্ষায় না থেকে ডিজিটাল সক্ষমতা প্রয়োগ করে সামগ্রিক শিক্ষা ব্যবস্থাকে পুনরুজ্জীবিত করতে হবে। সর্বোপরি প্রতিটি ক্ষেত্রেই আমাদের তিন পর্যায়ের মধ্যমেয়াদি কৌশল প্রণয়ন করতে হবে; যাতে করে আমরা আগামী এক বছরে কী কী স্বল্পমেয়াদি পদক্ষেপ গ্রহণ করব এবং পরবর্তী দুই অর্থবছরে কীভাবে দীর্ঘমেয়াদি পুনর্গঠনের কাজ করব, তার নির্দেশনা থাকবে।
মূলত জীবন রক্ষার্থে লকডাউন একটি আপৎকালীন সমাধান। কিন্তু অনির্দিষ্টকালের সংকট মোকাবিলায় মানুষকে ধীরে ধীরে আবার জীবিকার যুদ্ধে নামতেই হবে; নিজেকে সুরক্ষিত রেখেই দেশকে ধীরে ধীরে সচল করতে হবে, আসন্ন অর্থনৈতিক বিপর্যয় থেকে সুরক্ষার জন্য। আর তার জন্য নীতিনির্ধারণী ও প্রায়োগিক পর্যায় থেকে প্রয়োজন সময়ানুগ-প্রাসঙ্গিক-সমন্বিত পদক্ষেপ,টেকসই কর্মকৌশল, প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা, ন্যায়পরায়ণতা ও সুশাসন।
ড. মোহাম্মদ আবু ইউসুফ: অধ্যাপক, ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগ; পরিচালক, সেন্টার অন বাজেট অ্যান্ড পলিসি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং নির্বাহী পরিচালক, রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্ট (র্যাপিড)।