সৌদি হামলা ও করোনা: দুদিকেই ধুঁকছে ইয়েমেন

ইয়েমেন
ইয়েমেন

করোনা মহামারির প্রকোপে পুরো বিশ্ব থমকে দাঁড়িয়েছে। ঘরবন্দী হয়েছে প্রায় তিন শ কোটি মানুষ। কিন্তু থামেনি মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধ। যুদ্ধ বিরতির মধ্যেই সিরিয়া, লিবিয়া আর ইয়েমেনে চলছে অবিরাম সংঘর্ষ। জাতিসংঘের অধীনে ৯ এপ্রিল শুরু হওয়া যুদ্ধবিরতি ভঙ্গ করে সৌদি জোট আবারও ইয়েমেনে হামলা করেছে। এই হামলা এমন সময়ে ঘটল, যখন ইয়েমেনের মানুষ যুদ্ধের চেয়ে করোনা মহামারির দরুন অনেক বেশি আতঙ্কিত। প্রায় অর্ধ দশকের যুদ্ধে অর্থনৈতিকভাবে আরব বিশ্বের সবচেয়ে দুর্বল রাষ্ট্রের প্রায় সব অবকাঠামো ধ্বংস হয়েছে। হাসপাতাল থেকে শুরু করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান—সবকিছুই নিশ্চিহ্ন। এই বিপুল ক্ষয়ক্ষতির জন্য জাতিসংঘ ইয়েমেনের সামগ্রিক অবস্থাকে স্মরণকালের বৃহৎ মানবিক বিপর্যয় হিসেবে ঘোষণা করেছে।

আজ-জাজিরার খবরে প্রকাশ, সৌদি জোট এক দিনের ব্যবধানে প্রায় এক শ বার ইয়েমেনে হামলা করেছে। এই হামলার প্রধান লক্ষ্য ছিল মাআরিব প্রদেশ। মাআরিব প্রদেশে ইয়েমেনের প্রধান গ্যাস এবং তেল স্থাপনাসমূহ অবস্থিত। তাই মাআরিব প্রদেশ দখলে নিতে পারলে সমগ্র ইয়েমেনের জ্বালানি ব্যবস্থাপনাকে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। তবে হুদেইদাহ সমুদ্রবন্দরেও সৌদি জোটের হামলা হয়েছে। সৌদি জোটের নিরবচ্ছিন্ন অবরোধের মধ্যে মূলত হুদেইদাহ বন্দরের মাধ্যমেই ইয়েমেনে যে কিঞ্চিৎ আন্তর্জাতিক ত্রাণ পৌঁছাত, তা এখন হুমকির সম্মুখীন। মাআরিব এবং হদেইদাহ বন্দরের পাশাপাশি সৌদি জোট যাওআফ প্রদেশের কয়েকটি মিলিটারি ক্যাম্প দখল করে নিয়েছে বিদ্রোহী হুতিদের কাছ থেকে। তবে হুতিদের এই অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে বরং হুতিদের বিরুদ্ধেই মানুষ হত্যার অভিযোগ এনেছে সৌদি জোট। পাল্টাপাল্টি অভিযোগ বৃদ্ধি করেছে ইয়েমেনিদের দুর্দশা। ধীরে ধীরে ফিকে হয়ে যাচ্ছে শান্তির আশা।

হিউম্যান রাইটস ওয়াচসহ অন্য আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর প্রতিবেদন বলছে, প্রায় দুই লাখ মানুষ নিহত হয়েছে এই যুদ্ধে। গড়ে এক শ শিশু প্রাণ হারাচ্ছে প্রতিদিন। প্রায় তিন কোটি জনসংখ্যার দেশে ৮০ ভাগ মানুষ ক্ষুধায় আক্রান্ত। জাতিসংঘের হিসাবে, প্রায় ১০ লাখ ইয়েমেনি কলেরায় আক্রান্ত, যাদের অধিকাংশ শিশু এবং প্রায় ৫০ লাখ মানুষ আজ গৃহহারা। জাতিসংঘসহ অন্য মানবাধিকার সংগঠনগুলোর আপত্তি গ্রাহ্য না করে সৌদি নেতৃত্বাধীন জোট ইয়েমেনকে চারদিক থেকে অবরোধ করে রেখেছে। বন্ধ করেছে সব আন্তর্জাতিক ত্রাণসামগ্রীর পরিবহন। সোমালিদের মতো ইয়েমেনিদেরও এড়িয়ে গিয়েছে পশ্চিমারা। সিরিয়ার কুর্দিদের রক্ষায় পশ্চিমারা যেভাবে বন্দুক নিয়ে এগিয়ে এসেছিল, ইয়েমেনিদের ক্ষেত্রে ততটাই নীরব থেকেছে। কারণ ভূরাজনীতিতে ইয়েমেনিদের দুর্বল অবস্থান এবং প্রাকৃতিক সম্পদের স্বল্পতা। সবাই ইরানের মদদপুষ্ট হুতিদের হটাতে সৌদি জোটের পক্ষ নিয়েছে। তবে ইয়েমেনের যুদ্ধকে পুঁজি করে পশ্চিমের কাছে যুবরাজ সালমানের সুদিন ফিরেছে।

সিরিয়া ও লিবিয়ার অনুরূপেই ইয়েমেনের দুর্দিনের শুরু হয়েছিল পশ্চিমাদের দমিয়ে দেওয়া তথাকথিত আরব বসন্তের মধ্য দিয়ে। আরব দুনিয়ায় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নিমিত্তে যখন ন্যাটো গাদ্দাফির পতনের লক্ষ্যে লিবিয়ায় বোমা বর্ষণ শুরু করেছিল, তখনই গালফ কো-অপারেশন কাউন্সিলের চাপে ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়ান ইয়েমেনের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আলী আবদুল্লাহ সালেহ। সালেহের কবজায় ইয়েমেন ছিল প্রায় দুই যুগ। গালফ কো-অপারেশন কাউন্সিলকে ব্যবহার করে সৌদিরা সালেহ-পরবর্তী সরকার গঠন করেন সালেহের দীর্ঘদিনের মিত্র এবং তৎকালীন সহকারী প্রেসিডেন্ট মানসুর হাদির নেতৃত্বে। মানসুর হাদির নেতৃত্বে ইয়েমেনে আদতে পরিবর্তনের ছোঁয়া লাগেনি, যেমনটা লেগেছিল তিউনিসিয়া ও মিসরে। পুরোনো মোড়কে পুরোনো পণ্য গণমানুষের ধৈর্য ধরে রাখতে পারেনি, বিশেষ করে সালেহ আমলে নিগৃহীত শিয়া হুতিদের।

সালেহ তাঁর দীর্ঘ সময়ের ক্ষমতার মধ্যে সেনাবাহিনীর মধ্যে একটি অনুগত অংশ তৈরি করেছিলেন। ওই অনুগত অংশ হুতিদের সঙ্গে অতীতের বিরোধ মীমাংসা করে নেয় এবং নতুন জোট গঠন করে। নতুন যৌথ বাহিনী নতুন প্রেসিডেন্ট মনসুর হাদিদকে ক্ষমতাচ্যুত করে ২০১৪ সালে ইয়েমেনর রাজধানী সানা দখল করে নেয়। হাদিদ সৌদি আরবে পলায়ন করেন। মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে এই দ্রুত মিত্র বদলের খেলাই মূলত মধ্যপ্রাচ্যে পশ্চিমাদের হস্তক্ষেপকে ত্বরান্বিত করেছে। সালেহের আমলের নির্যাতিত হুতিরা মুহূর্তেই সালেহের অনুসারীদের সঙ্গে ক্ষমতার লোভে জোটবদ্ধ হলো। ঠিক একই কাজ করেছে সিরিয়ার কুর্দিরা। যেই আসাদ কুর্দিদের নাগরিকত্ব, ভাষা ও অস্তিত্বকে অস্বীকার করেছিলেন, সেই কুর্দিরাই এখন আসাদের প্রধান রক্ষক। বিদ্রোহীদের সানা দখলের পর সৌদি বলয় এবং আফ্রিকার কয়েকটি দেশ মিলে ইয়েমেনে হামলা শুরু করে। ২০১৭ সালের শেষ দিকে সালেহ সৌদি জোটের সঙ্গে আলোচনায় বসার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করলে হুতিরা তাঁকে হত্যা করে। রাজনৈতিক ও ধর্মীয় কোনো বিষয়েই হুতিরা সৌদি আরবকে বিশ্বাস করে না। তবে ২০১৫ সালের হুতি বিদ্রোহীদের রাজধানী সানা দখলের ঘটনা মূলত মোহাম্মাদ বিন সালমানকে দৃশ্যপটে হাজির করে।

জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে চলমান এই যুদ্ধ বিরতির মধ্যে সৌদি জোটের অনবরত হামলায় আবার প্রশ্ন উঠেছে, মোহাম্মাদ বিন সালমানের নৃশংসতা কোথায় গিয়ে থামবে! জামাল খাসোগি হত্যা, লেবাননের সাবেক প্রধানমন্ত্রী হারিরিকে আটকে রেখে মারধর, সৌদি আরবে বেপরোয়া সংস্কার এবং সর্বশেষ আমাজন সিইও জেফ বেজোসের ফোন হ্যাকিং কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়লেও পশ্চিমে যুবরাজের জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়েনি বরং যুবরাজে পশ্চিমাদের আস্থা বেড়েছে। আস্থা বাড়ার অন্যতম কারণ সালমান পশ্চিমাদের বোঝাতে সক্ষম হয়েছেন যে ইয়েমেনসহ মধ্যপ্রাচ্যে ইরান এবং ‘রাজনৈতিক ইসলামকে’ ঠেকানোয় তার কোনো বিকল্প নেই। একই সঙ্গে সৌদি আরবের বার্ষিক বাজেটের পাঁচ ভাগের এক ভাগ তথা ৫০ বিলিয়ন ডলারের প্রতিরক্ষা বাজারে স্থান নিতে সবাই সালমানকে নীরবে সমর্থন করে চলছেন। মার্কিনদের পরে ফ্রান্স, ব্রিটেন, জার্মানি, চীন ও রাশিয়া সৌদিদের অস্ত্রের প্রধান জোগানদাতা। অস্ত্র বিক্রির পরের দায়িত্বও পশ্চিমারা নিয়েছে। সৌদিদের নানা দেশে নানা শত্রুর সন্ধান দিয়েছে।

এই মানবিক বিপর্যয়ের মধ্যেই মহামারি করোনার প্রাদুর্ভাব ইয়েমেনে। দীর্ঘ যুদ্ধের দরুন ইয়েমেনে চিকিৎসাব্যবস্থার অস্তিত্ব বিলীন হয়েছে। আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অন্ততপক্ষে ৫০ ভাগ হাসপাতাল সৌদি জোটের হামলায় ধ্বংস হয়ে গেছে। মাত্র ১২টি রেস্পিরেটর নিয়ে চলছে রাজধানীর সানার হাসপাতালসমূহ। করোনা মোকাবিলায় ইয়েমেনের এই শূন্য প্রস্তুতি ইয়েমেনের একটি বিশাল অংশকে মহামারিতে আক্রান্ত করতে পারে। মৃত্যুর মুখোমুখি হতে পারে জনসংখ্যার একটি বিশাল অংশ। এমন আশঙ্কাই করেছেন ইয়েমেনে জাতিসংঘের আবাসিক প্রতিনিধি লিসা গ্র্যান্ডে। মহামারির এই দুর্দিনে একদিকে সৌদি জোটের হামলা, অন্যদিকে করোনার দুশ্চিন্তা পুরো একটি জাতিকে নিঃশেষ করে দেওয়ার জন্য কি যথেষ্ট নয়!

রাহুল আনজুম: গবেষক