কৃষিঋণ কৃষককে কতটা রক্ষা করবে?
বাংলাদেশে সবচেয়ে অবহেলিত খাত কৃষি। বছরের পর বছর কৃষিকাজ করে লোকসান করছেন কৃষক। কষ্টের ফসলের দাম না পেয়ে খেতে পোড়ানোর ঘটনাও ঘটেছে সম্প্রতি। ফসল উৎপাদনে যা খরচ হয়, তা আবার উঠে আসে না। মূলত, শহরের ধনী ও মধ্যবিত্ত যে খাবার খায়, তা আক্ষরিক অর্থেই কৃষকের ভর্তুকির ফসল। কৃষকের দরকার একটি সুষম বাজারব্যবস্থা, অকৃষকের জমির মালিকানা পরিবর্তন করে প্রকৃত কৃষকের হাতে জমি যাওয়া, ফসল উৎপাদনের উপকরণের ওপর নিয়ন্ত্রণ এবং বিশ্ব জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টি মাথায় রেখে শস্যবিমাসহ আধুনিক রাষ্ট্র কৃষকের যেসব রাষ্ট্রীয় সুযোগ দিয়ে থাকে, তা নিশ্চিত করা।
এসব করা না গেলে ভবিষ্যতে কৃষিব্যবস্থার ওপর বড় একটা অংশের নেতিবাচক মনোভাব তৈরি হলে খোদ খাদ্য নিরাপত্তায় টান পড়বে। এ রকম পরিপ্রেক্ষিতে সরকার করোনা প্রাদুর্ভাবে থাকা কৃষকের জন্য পাঁচ হাজার কোটি টাকা ৪ শতাংশ সুদে ঋণ দেওয়ার নীতি নিয়েছে। মূলত, এ ঋণ হলো কৃষকের ফসল সরকারের কাছে বন্ধক বা লিজ রেখে ঋণ নেওয়া।
কিন্তু লাখ লাখ বর্গা চাষি, যাঁরা অন্যর জমিচাষ করেন, তাঁরা কি পাবেন এই ঋণ? সরকারের বিদ্যমান কৃষিঋণ নীতিমালা অনুযায়ী, জমির মালিক ছাড়া এই ঋণ পাওয়ার কি সুযোগ আছে? যেসব বর্গা চাষি এই ঋণের আবেদন করবেন, তাঁদের প্রমাণ করতে হবে, তিনি অন্যর জমি লিজ নিয়ে চাষ করছেন। বাংলাদেশ বর্গা চাষিদের এ রকম কোনো লিজ চুক্তি তো নেই। তাহলে কী হবে বর্গা চাষিদের? শুধুই কি বর্গা চাষি? এই ঋণের সুফল আসলেই কি প্রকৃত চাষিরা পাবেন—সেটাই বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে।
কারা ঋণ পাবেন
১৩ এপ্রিল বাংলাদেশ ব্যাংক একটা সার্কুলার জারি করেছে। তাতে বলা হচ্ছে, ১৮ মাসের মধ্যে ঋণ ফেরত দিতে হবে। এর প্রথম ছয় মাস গ্রেস পিরিয়ড থাকবে, মানে এ সময় কিস্তি দেওয়া লাগবে না। বাকি ১২ মাসে বারো কিস্তির মাধ্যমে ঋণ পরিশোধ করতে হবে।
সার্কুলারে বলা হয়েছে, শস্য ও ফসল খাত ব্যতীত কৃষির অন্যান্য চলতি মূলধন নির্ভরশীল খাত, যেমন: হর্টিকালচার (মৌসুমি ফুল ও ফল চাষ), মাছ চাষ, পোলট্রি, ডেইরি ও প্রাণিসম্পদ খাতে এই ঋণ দেওয়া হবে। কোনো খাতে ৩০ শতাংশের বেশি ঋণ দেওয়া যাবে না। অর্থাৎ যদি কোনো একটা এলাকায় ধানচাষিদের ৩০ শতাংশ ঋণ দেওয়া হয়, তবে আর কোনো চাষি ঋণ পাবেন না।
মূলত, কৃষিঋণ নীতিমালা অনুযায়ী কৃষকের উৎপাদিত ফসল বন্ধক রেখে কৃষিঋণ নিতে হয়। এটার সরকারি নাম হলো ‘শস্য বন্ধকি দলিল’। অর্থাৎ কৃষক তাঁর শস্য একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত ব্যাংকের কাছে বন্ধক রাখবেন। ধান বা যেকোনো শস্য বিক্রি করে ঋণের টাকা আবার ফেরত দেবেন।
কৃষক ঋণ পাবেন কৃষিঋণ নীতিমালা অনুযায়ী। এ নীতিমালা অনুযায়ী ৫ একর বা ১৫ বিঘা পর্যন্ত জমির মালিক সর্বোচ্চ আড়াই লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ পাবেন। সে জন্য তাঁদের জমির দলিল বন্ধক রাখতে হবে। যাঁদের জমি নেই, তাঁরাও এই ঋণ পাবেন, তবে সে ক্ষেত্রে কৃষককে যাঁর জমি ভাড়া নিয়ে চাষ করেন, সেই ভাড়ার চুক্তিপত্র জমা দিতে হবে। বাস্তবতা হলো, বাংলাদেশে প্রান্তিক খেটে খাওয়া ভূমিহীন চাষি কখনোই চুক্তি করে জমি লিজ নেন না। আর অকৃষক জমির মালিক লিখিত চুক্তির মাধ্যমে কোনো চাষিকে জমি বর্গা দেন না। এ জন্য বর্গা চাষির দোষ নেই, কারণ লিখিত চুক্তির মাধ্যমে জমি বর্গা দিলে সরকারকে ফি দিতে হয়। সেই ফি জমির মালিককেই পরিশোধ করতে হয়। ফলে, এই পাঁচ হাজার কোটি টাকার ঋণ প্যাকেজ থেকে বর্গা চাষির ঋণ পাওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। শুধু তা-ই নয়, কৃষকদের সবচেয়ে বড় অংশ ধান চাষ করেন, কোনো একটা এলাকায় যদি ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের বড় অংশ ব্যাংক পর্যন্ত যান ঋণের জন্য, তাহলে ওই অঞ্চলে বরাদ্দকৃত ঋণের ৩০ শতাংশই কেবল ধানচাষিরা পাবেন।
বাংলাদেশে জেলাভেদে ফসলের উৎপাদনও ভিন্ন হয়। ফলে, সারা বাংলাদেশের কৃষকের জন্য গড় এই বেঁধে দেওয়া শতাংশ হার কৃষকের জন্য কতটা সুফল বয়ে আনবে, সে প্রশ্ন থেকেই যায়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এই সার্কুলারে একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় রয়েছে, তা হলো যেসব উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠান কৃষক কর্তৃক উৎপাদিত কৃষিপণ্য কিনে সরাসরি বিক্রি করে থাকে, তারা এই ঋণ প্যাকেজের আওতায় আসবে। এসব ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান সর্বোচ্চ পাঁচ কোটি টাকা ঋণ পাবে।
অর্থাৎ যে কৃষক মাথার ঘাম পায়ে ফেলে ফসল উৎপাদন করেন, তিনি পাবেন সর্বোচ্চ আড়াই লাখ টাকা। আর যিনি কৃষকের ফসল কম টাকায় কিনে বেশি টাকায় বিক্রি করবেন, সেই মধ্যস্বত্বভোগী ফোড়িয়ারা ঋণ পাবেন পাঁচ কোটি টাকা। অথচ বহুকাল ধরে দাবি জানানো হচ্ছে, কৃষকের উৎপাদিত ফসল কীভাবে সরাসরি ক্রেতার কাছে যেতে পারে, সে রকম একটা ব্যবস্থা সরকারিভাবে গড়ে তোলা হোক। উল্টো এই ঋণব্যবস্থায় মধ্যস্বত্বভোগীদের পোক্ত করা হয়েছে।
চলতি বোরো মৌসুমে ২ কোটি টন ধান উৎপাদন হতে পারে। কিন্তু সরকার কিনবে মাত্র ১৯ লাখ টন। বাকি ধান কৃষকের কাছ থেকে কম দামে কেনেন এই ফড়িয়া মধ্যস্বত্বভোগীরা। কৃষকের নামে দেওয়া ব্যাংকঋণ নিয়ে কেনার সুবিধা কি রাখা হলো না, সে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।
কৃষি ব্যয় বাড়ছে প্রতিবছর
কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বোরো মৌসুমে প্রতি কেজি ধানের উৎপাদন খরচ ছিল সাড়ে ২৪ টাকা। সরকারি পর্যায়ে ধানের দাম ২৬ টাকা কেজি। প্রতিবছর লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে কৃষির উৎপাদন ব্যয়। সরকার ১০ শতাংশের কম ধান কিনেছে, বাকিটা কৃষক বিক্রি করেছেন ফড়িয়াদের কাছে উৎপাদন খরচের বহু কমে।
দশকের পর দশক কৃষক লোকসানের পরও নিরলসভাবে ফসল উৎপাদন করে গেছেন। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা বা এফএওর বিশ্ব পরিসংখ্যান পকেট বুক-২০১৯-এর তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের কৃষক ২০১৭ সালে যে কৃষিপণ্য উৎপাদন করেছেন, তার আর্থিক মূল্য প্রায় দুই লাখ কোটি টাকা। ২০ বছর আগে কৃষক যে অবদান অর্থনীতিতে রাখতেন, এখন তার দ্বিগুণ রাখেন।
কৃষক সবটুকু করলেও তার সব দায়িত্ব কৃষকের জন্য পালন করতে পারেনি। এবার ধানের দাম নিয়ে যা হয়েছে, তা অতীতে দেখা যায়নি। কৃষক ধানের দাম না পেয়ে বিভিন্ন জায়গায় ফসল পুড়িয়ে প্রতীকী প্রতিবাদ করেছেন। এই প্রতিবাদকে শুধু সরকারবিরোধী ক্ষোভ হিসেবে দেখা যাবে না। এটিকে দেখতে হবে গত পাঁচ দশকে কৃষকবান্ধব নীতি গ্রহণ না করার সম্মিলিত ফল হিসেবে।
কৃষকের বহুমুখী ঋণের জাল
দেশের মোট শ্রমশক্তির ৪৮ ভাগ কৃষিতে নিযুক্ত। এর বড় অংশের হাতে আবার নিজের জমি নেই। জমির মালিকদের একটি বড় অংশই অকৃষক। তাঁদের মধ্যে যাঁরা বেশি অবস্থাপন্ন, তাঁরা রাজধানীতে, তারপর সামর্থ্য অনুযায়ী বড় জেলা শহর ও উপজেলায় থাকেন। বড় ধরনের জমির মালিকানার পরিবর্তন বা ভূমি সংস্কার ছাড়া বাস্তবে কৃষকের জন্য কিছু করা সম্ভব না। কিন্তু বিদ্যমান ব্যবস্থায়ও যদি কৃষকের জন্য কিছু করতে হয়, তাহলে বর্গা কৃষককে কীভাবে সরকারি প্রণোদনার আওতায় আনা যায়, সেটি নিয়ে ভাবতে হবে। কারণ, দেশে ঋণ পাওয়া একটা জটিল বিষয় হওয়ায় কৃষকেরা অধিকাংশ সময় এনজিও এবং মহাজনী ঋণের জালে জড়িয়ে পড়ছেন।
আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (ইফপ্রি) ২০১৯ সালের এক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, বেসরকারি সংস্থা (এনজিও), আত্মীয়স্বজন, বেসরকারি ব্যাংক, দাদন ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন বেসরকারি উৎস থেকে কৃষক ৮১ শতাংশের বেশি ঋণ নেন বাংলাদেশের কৃষকেরা। এসব ঋণের সুদের হার ১৯ থেকে ৬৩ শতাংশ। আর কৃষি ব্যাংক থেকে যে ঋণ দেওয়া হয়, তার সুদের হার ৯ শতাংশ হলেও তা অল্পসংখ্যক কৃষক পেয়ে থাকেন। কৃষকের মোট ঋণের মাত্র ৬ শতাংশ আসে কৃষি ব্যাংক থেকে।
ইফপ্রির সমীক্ষায় দেখা গেছে, দেশে মোটে ঋণের ৩৬ দশমিক ৪ শতাংশ নেওয়া হয় এনজিও থেকে। এরপর আত্মীয়স্বজনদের কাছ থেকে ঋণ নেয় ১৯ শতাংশ। জমির মালিকের কাছ ১৫ শতাংশ। মহাজন বা দাদন (গ্রামাঞ্চলের অনানুষ্ঠানিক পদ্ধতিতে ঋণব্যবস্থা) থেকে ১১ দশমিক ৪ শতাংশ এবং বিভিন্ন সমিতি থেকে আসে ৩ দশমিক ৬ শতাংশ ঋণ।
সরকারি ঋণের অবস্থা দেখুন। একটু ওপরে যে আলোচনা হয়েছিল বর্গাচাষিরা ঋণ পাবেন না। সেটা ইফপ্রির সমীক্ষায় উঠে এসেছে। সংস্থাটি বলছে, সরকারের কৃষি ব্যাংক থেকে আসা ঋণের পরিমাণ ৬ শতাংশের মতো। এই ঋণের সবচেয়ে বেশি অংশ পান বড় চাষিরা, প্রায় ১৫ শতাংশ। বড়, মাঝারি ও ছোট চাষি মিলে মোট ঋণের ৩৬ শতাংশ পান। আর প্রান্তিক চাষি পান ৫ শতাংশের মতো। বর্গা চাষি, অর্থাৎ অন্যের জমি ইজারা নিয়ে চাষ করেন—এমন কৃষকেরা এই ঋণ পান না। ফলে তাঁদের এনজিওসহ অন্য উৎসের ঋণের ওপর নির্ভর করতে হয়।
কৃষকের জন্য যা জরুরি
করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাব মোকাবিলা করার জন্য পাকিস্তান সরকার সরাসরি জনগণের কাছে অর্থ সহায়তা দেওয়ার কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। ১০ এপ্রিল পাকিস্তান অবজারভারে তথ্য অনুযায়ী, ‘এহসাস ইমার্জেন্সি ক্যাশ প্রোগ্রাম’ নামে একটি অর্থ সহায়তা কর্মসূচি নিয়েছে পাকিস্তান সরকার। এ কর্মসূচিতে ১ কোটি ২০ লাখ পরিবারকে পরিবারপ্রতি এককালীন ১২ হাজার রুপি করে দেওয়া হবে। এ জন্য ১৪ হাজার ৪০০ কোটি রুপির বিশেষ বাজেটও বরাদ্দ করা হয়েছে।
সাহায্যপ্রার্থীরা একটি নম্বরে খুদে বার্তা দিয়ে নিজেদের জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর পাঠিয়ে সাহায্যের আবেদন করবেন। সাহায্যপ্রার্থী সরকারির চাকরিজীবী, করদাতা, গাড়ির মালিক, বারবার বিদেশগামী ইত্যাদি ক্যাটাগরির মধ্যে পড়লে সাহায্য পাবেন না। প্রকৃত ব্যক্তিদের খুঁজে বের করতে ন্যাশনাল ডেটাবেইসের সাহায্য নেওয়া হবে। এভাবে যাচাই-বাছাই করার পর সাহায্যপ্রার্থী সাহায্য পাওয়ার যোগ্য বিবেচিত হলে তাঁকে জানিয়ে দেওয়া হবে কোন ব্যাংকের কোন শাখার এটিএম বা পজ মেশিন থেকে বায়োমেট্রিক ভেরিফিকেশনের মাধ্যমে তিনি এককালীন ১২ হাজার রুপি তুলতে পারবেন।
পাকিস্তান পারলে বাংলাদেশ কেন পারবে না? বাংলাদেশে প্রায় এক কোটি কৃষকের ১০ টাকার ব্যাংক হিসাব রয়েছে। তা ছাড়া সরকার চাইলে প্রকৃত ব্যক্তিদের তালিকা করা কি সম্ভব না?
কৃষকের জন্য পাঁচ হাজার কোটি টাকার একটি ঋণ প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়েছে। এটির সুদের হার ছিল ৫ শতাংশ, সমালোচনা হওয়ায় সুদের হার ৪ শতাংশ করা হয়েছে। এর পাশাপাশি সরকার কৃষকের কাছ থেকে আগামী বোরো মৌসুমে অতিরিক্ত দুই লাখ টন ধান কেনার ঘোষণা দিয়েছে। এর আগে লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১৭ লাখ টন। তাহলে সব মিলিয়ে কৃষকের কাছ থেকে সরকার ধান কিনবে ১৯ লাখ টন। অথচ এবারের বেরো মৌসুমে কৃষক অন্তত দুই কোটি টন ধান উৎপাদন করবে। মোট উৎপাদিত বোরো ধানের একটা অংশ কিনবে সরকার, বাকিটা চলে যাবে ফড়িয়া, চাতালের মালিক ও মজুতদারদের হাতে। আবার তাঁদের কাছ থেকে কৃষক নিজের খাবারের চাল কিনবেন বেশি দামে। এই চক্র থেকে কৃষককে বাঁচাতে হলে ঋণ নয়, সুলভ মূল্যে ধান কেনার কর্মসূচি থাকতে হবে সরকারের। এর পাশাপাশি নগদ সহায়তা থাকার দরকার।
একসময় কৃষকের কাছে বীজ ছিল, সেই বীজের নিয়ন্ত্রণ চলে গেছে বিদেশি বহুজাতিক কোম্পানির হাতে। ধান উৎপাদনের উপকরণ, যেমন: পানি, সার, ওষুধ এবং উৎপাদনে ব্যবহৃত টেকনোলোজি (ট্রাক্টর, ধান কাটার মেশিন, ধান মাড়াইয়ের মেশিন ইত্যাদি) কোনোটিই কৃষকের নিয়ন্ত্রণে এবং দাম নাগালের মধ্যে নেই। উৎপাদনের এসব উপকরণ সুলভ ও সহজে পাওয়ার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। বীজ বিনা মূল্যে সরবরাহ করা গেলে সবচেয়ে ভালো। দেশে নকল টিএসপি সারে সয়লাব। প্রভাবশালীরা প্রশাসনের নাকের ডগায় এসব নকল টিএসপি সারের কারখানা বানিয়ে ব্যবসা করে যাচ্ছে। কৃষক কিনে প্রতারিত হচ্ছেন। এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। ধান কাটার সময় স্থানীয় লোকবলকে কীভাবে কাজে লাগানো যায়, সেটি নিয়ে এখনই পরিকল্পনা থাকতে হবে। কৃষকের উঠান থেকে সরকারিভাবে ধান কেনার ব্যবস্থা থাকতে হবে।
প্রায় ২০টি জেলায় ইতিমধ্যে লকডাউন করে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এসব এলাকায় ধান কীভাবে কাটা হবে? এসব জেলায় ধান কাটার পর তা কৃষকের উঠান পর্যন্ত আনা একটা বড় ঝক্কির কাজ। এই বিপুল পরিমাণ ধান কৃষকের পক্ষে দীর্ঘদিন বাড়িতে রাখা সম্ভব না। কারণ, ধারদেনা করে ফসল করার পর যত দ্রুত সম্ভব তা ফিরিয়ে দিতে হবে। বিশেষত মহাজনি ও এনজিও ঋণ। ধান কেনার ক্ষেত্রে সরকারের কড়া অবস্থানে থাকতে হবে। কোনোভাবেই মধ্যস্বত্বভোগীরা এখান থেকে যেন ফায়দা না নিতে পারে।
আর যদি কৃষক ক্ষতির মুখে পড়েন, তাহলে এবার তা গোটা জাতিকে ভোগাবে। কারণ, করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবে গোটা বিশ্বের অর্থনীতির বেহাল দশা। এতে কৃষিতেও বড় ধাক্কা লাগবে, সেটাই স্বাভাবিক। যদি কৃষি উৎপাদন, বিশেষত ধান উৎপাদন ভবিষ্যতে কমে যায়, তবে বিশ্ব থেকে সহায়তা পাওয়া কঠিন হয়ে যাবে। কৃষককে ঋণ নয়, সরাসরি প্রণোদনা দিয়ে কৃষি উৎপাদনে উৎসাহ দিতে হবে। বিদেশে বহুজাতিক কোম্পানির হাতে থাকা বীজ কীভাবে ন্যায্যমূল্যে বা ভর্তুকি মূল্যে কৃষক পেতে পারেন, তা নিশ্চিত করতে হবে সরকারকে।
ইউরোপে একটি গরুর পেছনে বছরে ভর্তুকি দেওয়া হয় ৭০ হাজার টাকা। ভারতীয় সাংবাদিক পি সাইনাথ একবার এক ভারতীয় কৃষক সংগঠককে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘ভারতীয় কৃষকের স্বপ্ন কী?’ উত্তর এসেছিল, ‘পরের জন্মে ইংল্যান্ডের গরু হয়ে জন্ম নেওয়া।’ যদি আমরা আমাদের কৃষকদের রক্ষা করতে না পারি, তাহলে পরবর্তী জন্মে তাঁরাও হয়তো ইংল্যান্ডের গরু হয়েই জন্মাতে চাইবেন।
মো. আরিফুজ্জামান: প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
[email protected]