১৪ এপ্রিল বাঙালির প্রাণের উৎসব, পয়লা বৈশাখ। কিন্তু অন্যান্য বছরের মতো এ বছর কারও মধ্যেই নেই কোনো উৎসাহ। করোনা-আক্রান্ত এই সময়ে অনেকের কাছে দিন গুজরান করাই যখন কঠিন, তখন উৎসব তার তাৎপর্য হারায়। তবে পয়লা বৈশাখের মতো উৎসব শুধু উদযাপন আর আনন্দের নয়, এর রয়েছে অর্থনৈতিক গুরুত্ব। উৎসবকে ঘিরে খাবার-দাবার, কাপড়চোপড়সহ অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় কিংবা অনেক ক্ষেত্রে অপ্রয়োজনীয় জিনিস কেনারও হিড়িক পড়ে যায়। আর সেই সঙ্গে হাতবদল হয় বিপুল পরিমাণ অর্থের। সঠিক পরিসংখ্যান না থাকলেও ধারণা করা হয়, বাংলা নববর্ষকে ঘিরে প্রতিবছর প্রায় কয়েক হাজার কোটি টাকার ব্যবসা হয়। আর বৈশাখী অর্থনীতির আকার প্রতিবছরই বেড়ে চলছে। এ ছাড়া গত কয়েক বছর সরকারি কর্মকর্তা আর কর্মচারীরা মূল বেতনের ২০ শতাংশ হারে বৈশাখী ভাতা পাওয়ার কারণে বেচা-কেনা আরও বেড়েছে। তবে ঈদের মতো অন্যান্য উৎসবের সঙ্গে এর পার্থক্য হচ্ছে, পয়লা বৈশাখে দেশীয় পণ্যের কেনা-বেচা হয় বেশি। তাই দেশীয় পণ্যের উদ্যোক্তারা এ সময় তুলনামূলকভাবে বেশি ব্যবসা করে থাকেন। আর গ্রামীণ অর্থনীতির চাকাও এ কারণে বেগবান হয়। অনেক ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাই সারা বছরের সিংহভাগ বাণিজ্য বৈশাখকে কেন্দ্র করে করে থাকেন। এ বছর করোনাভাইরাসের কারণে তৃণমূল পর্যায়ের এসব ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাসহ শহরাঞ্চলের বড় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও বিপণিবিতানগুলোও তাই বিশাল ক্ষতির মুখে পড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে সরকারের তাই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।
উৎসবকে ঘিরে এই অর্থনৈতিক কার্যক্রমের মূলে রয়েছে বিভিন্ন দ্রব্যের চাহিদার বৃদ্ধি। কিন্তু সামাজিক দূরত্ব পালন, নিম্ন-মধ্যম আয়ের মানুষের আয়ের ঘাটতিসহ সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় চাহিদার ক্ষেত্রে এ বছর বড় ধরনের ঘাটতি রয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে স্বল্প সময়ে চাহিদা সেভাবে চাঙা করা সম্ভব না হলেও অনলাইনভিত্তিক ব্যবসাকে উৎসাহ দিতে হবে। এ ছাড়া প্রান্তিক পর্যায়ের একদম ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের সাহায্য করতে এবং এই লক্ষ্যে শহরভিত্তিক ক্রেতা ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তাঁদের সংযুক্ত করতে তাঁদের তথ্য ও কারিগরি সাহায্য দেওয়ার চিন্তা করা যেতে পারে। এটি পয়লা বৈশাখে না হলেও অন্তত ভবিষ্যতে ঈদের মতো উৎসবের ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে।
সরকারের তরফ থেকে বড় ধরনের প্রণোদনার প্রয়োজন রয়েছে মূলত ব্যবসার খরচ কমানোর ক্ষেত্রে। আর এ বিষয়ে স্বল্প ও মধ্যম মেয়াদে নীতিসহায়তা অত্যন্ত জরুরি। প্রথমত, সুতা, রংসহ পণ্যের সব ধরনের কাঁচামালের ওপর শুল্ক মওকুফ করা যেতে পারে, আর আগামী বাজেটে এ সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা থাকা প্রয়োজন। দ্বিতীয়ত, ক্ষুদ্র ও মধ্যম আকারের উদ্যোক্তাদের জন্য স্বল্প সুদে ঋণের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন এবং পূর্বের ঋণ পুনঃ তফসিলীকরণের সুযোগ থাকা আবশ্যক। তৃতীয়ত, পণ্য বিপণনের বিভিন্ন পর্যায়ে মূসকের ছাড় দেওয়া যেতে পারে, যা তাদের পণ্যের দাম কম রাখতে সাহায্য করতে পারে। এ সময়ে খাবার ও মিষ্টির দোকানগুলোকেও একই ধরনের সুবিধা দেওয়া যেতে পারে। এ ছাড়া অপেক্ষাকৃত বড় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো এ সময় যাতে কর্মী ছাঁটাই না করে, সে জন্য বিশেষ তহবিল বরাদ্দ করার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা প্রয়োজন। অর্থনীতিবিদদের অনেকে বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় সরকারের বৈশাখী ভাতার অর্থ ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের সাহায্যে ব্যয় করবার পরামর্শ দিয়েছেন, যা নিঃসন্দেহে একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ হতে পারে। বিকল্প হিসেবে এ বছরের সব ধরনের উৎসব ভাতার একটি অংশের ক্ষেত্রে শহুরে ক্রেতাদের দেশি বুটিকভিত্তিক ভাউচার দেওয়ার চিন্তা করা যেতে পারে।
সবশেষে বলা চলে, উৎসবকে কেন্দ্র করে যে বিশাল আকারের অর্থনীতি গড়ে উঠেছে বর্তমান পরিস্থিতিতে সেই অর্থনীতির ওপর নির্ভরশীল নিম্ন ও মধ্যম আয়ের মানুষের ক্ষতি কিছুটা হলেও পূরণের জন্য সময়োপযোগী নীতি সহায়তা দরকার।
ড. সায়মা হক বিদিশা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক।