দীর্ঘ সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ সালের এই দিনে রক্তক্ষয়ী জনযুদ্ধের সূচনা ঘটেছিল, লাখো প্রাণের বিনিময়ে নয় মাস পর তার অবসান ঘটে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের মধ্য দিয়ে। আজ আমরা গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি মুক্তিযুদ্ধের সব শহীদকে। গভীর শ্রদ্ধা জানাই স্বাধীনতাসংগ্রামের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, প্রবাসী সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদসহ সব নেতার স্মৃতির প্রতি। নৃশংসতার শিকার নারী ও শহীদ পরিবারগুলোর সদস্যদের প্রতি জানাই সংহতি ও সহমর্মিতা।
একাত্তরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সর্বাত্মক জনযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল গোটা জাতি। কিন্তু সেই হানাদারদের সহযোগিতা করেছিল এ দেশেরই কিছু মানুষ। রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনী পাকিস্তানি বাহিনীকে গণহত্যায় শুধু যে সহযোগিতাই শুধু করেছিল তা নয়; তারা নিজেরাও অস্ত্র ধরেছিল মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে; নিরীহ মানুষের ওপরও তারা চালিয়েছিল নির্মম অত্যাচার-নির্যাতন।
মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ সংঘটনের দায়ে তাদের বিচার চলছে। এই বিচারকে কেন্দ্র করে জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রশিবির বিগত বছরটিতে দেশজুড়ে যে ভয়াবহ সহিংসতা চালিয়েছে, তার নিন্দা জানানোর ভাষা জানা নেই। আন্তর্জাতিক সব রীতি ও আইন মেনেই এই বিচারকাজ পরিচালিত হচ্ছে। এমনকি বিবাদীপক্ষ রায়ের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ আদালতে আপিলের সুযোগ পাচ্ছে। একদিকে আইনি লড়াই, অন্যদিকে সহিংসতা চালিয়ে বিচারকাজ বন্ধের অপচেষ্টা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না।
আশার কথা, দেশের সাধারণ মানুষ তাদের এই সহিংস তৎপরতার বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিয়েছে। ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চ যে চেতনার মশাল প্রজ্বালিত করেছিল, তা এখন ছড়িয়ে পড়ছে সারা দেশে। আজ জাতীয় প্যারেড গ্রাউন্ডে লাখো কণ্ঠে জাতীয় সংগীত পরিবেশনও সেই চেতনারই অংশ বলে মনে করি।
মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা ছিল জাতীয় ঐক্য, ন্যায় ও গণতন্ত্র; মুক্তিসংগ্রামের মর্মকথা ছিল অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক সব ধরনের অন্যায়-অবিচার, বৈষম্য থেকে মানুষের মুক্তি। কিন্তু দুর্ভাগ্য হলো, স্বাধীনতার চার দশক পরও আমরা সেই পথে বেশি দূর এগোতে পারিনি। নব্বইয়ে স্বৈরাচারের পতনের পর দেশের মানুষ যে ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছিল, ২০১৪ সালের একতরফা নির্বাচন তাকে আবার প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। সহিংস পথে নির্বাচন ঠেকানোর রাজনীতি যেমন অগ্রহণযোগ্য, তেমনি প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন
বা নিয়ম রক্ষার নির্বাচনও গণতান্ত্রিক চেতনার পরিপন্থী। দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে জনমনে যে শঙ্কা ও সংশয় আছে, তা নিরসনে সরকারকেই উদ্যোগী ভূমিকা নিতে হবে। সবার অংশগ্রহণে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনই পারে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি এবং জনগণের ভাগ্যোন্নয়ন নিশ্চিত করতে।
যে লক্ষ্য ও আদর্শ নিয়ে আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম, স্বাধীনতার ৪৩ বছরে আমরা সেই লক্ষ্য ও আদর্শ কতটা অর্জিত হয়েছে,
কতটা হয়নি, আজ স্বাধীনতা দিবসে সেই আত্মজিজ্ঞাসাও জরুরি। একাত্তরের চেতনায় বাংলাদেশ এগিয়ে যাক—এটাই এবারের স্বাধীনতা দিবসের প্রত্যাশা।