অদৃশ্য এক শত্রুর বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধের প্রস্তুতি
এক অদৃশ্য ভাইরাস থেকে সংক্রমিত মহামারি মোকাবিলায় যুদ্ধকালীন প্রস্তুতি গ্রহণ শুরু করেছে বিশ্বের অধিকাংশ দেশ। বিলম্বিত হলেও যুক্তরাষ্ট্রে জাতীয় জরুরি অবস্থা জারি হয়েছে। স্কুলসহ অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের ঘোষণা দিয়েছে নিউইয়র্কসহ একাধিক অঙ্গরাজ্য। কর্মক্ষেত্রের বদলে ঘরে বসে ইন্টারনেটের মাধ্যমে কাজ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে একাধিক সরকারি ও বেসরকারি সংস্থা। কেন্দ্রীয় ব্যাধি নিয়ন্ত্রণকেন্দ্র সারা দেশের কোথাও পঞ্চাশের অধিক মানুষের জমায়েত না হওয়ার নির্দেশ দিয়েছে। বেসবল, বাস্কেটবলসহ অধিকাংশ খেলা স্থগিত রাখা হয়েছে। সিনেমা হল, পানশালা ও রেস্তোরাঁ আংশিক বা পুরোপুরি বন্ধ ঘোষিত হয়েছে একাধিক অঙ্গরাজ্যে। জরুরি অবস্থা মোকাবিলায় সামরিক বাহিনী মোতায়েনের কথা পর্যন্ত বিবেচিত হচ্ছে। ইতিমধ্যে নিউইয়র্কসহ মোট ছয়টি রাজ্যে সেনাবাহিনীর ‘রিজার্ভ’ সদস্যের সমন্বয়ে গঠিত ন্যাশনাল গার্ড আংশিক মোতায়েন করা হয়েছে।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর এমন সর্বাত্মক প্রতিরোধ-প্রস্তুতি দেখেনি পৃথিবী। সিনেটর বার্নি স্যান্ডার্স, যিনি ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রেসিডেন্ট পদের মনোনয়নের জন্য প্রতিযোগিতা চালিয়ে যাচ্ছেন, তিনি বলেছেন এই মহামারির ফলে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে মৃতের সংখ্যা ছাড়িয়ে যেতে পারে। মঙ্গলবার স্যান্ডার্স এবং সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এই মনোনয়ন লড়াইয়ের অংশ হিসেবে এক মুখোমুখি বিতর্কে মিলিত হন। তাঁরা দুজনেই বলেন, এই ভাইরাস মোকাবিলায় অবিলম্বে সামরিক বাহিনী মোতায়েন করা হোক। এই ভাইরাসে আক্রান্ত লোকজনকে শনাক্ত করার প্রয়োজনে আগ্রহী সব মার্কিন নাগরিক যাতে বিনা মূল্যে টেস্টিং এবং চিকিৎসার সুযোগ পায়, তাঁরা সে দাবিও জানিয়েছেন।
উল্লেখ্য, করোনাভাইরাসের কারণে আগামী মঙ্গলবার ডেমোক্রেটিক পার্টির বাছাইপর্বের পরবর্তী নির্বাচন স্থগিত ঘোষণা করেছে জর্জিয়া ও লুইজিয়ানা। ঠিক কত দিন এই সংকটাবস্থা চলবে, কোনো সরকারি কর্মকর্তা সে কথা বলতে রাজি হননি। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বারবার বলছেন বটে, ভয়ের কিছু নেই, সবকিছু নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। কিন্তু মহামারি নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে নিযুক্ত কর্মকর্তারা বলছেন ঠিক উল্টো কথা। যুক্তরাষ্ট্রের সংক্রামক ব্যাধিবিষয়ক প্রধান বিশেষজ্ঞ অ্যান্থনি ফাউচি বলেছেন, সংকটকে তার ‘পিক’ বা চূড়ান্ত অবস্থায় পৌঁছাতে আরও কয়েক সপ্তাহ লাগবে। তাঁর ধারণা, এই মহামারির ফলে শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই অসংখ্য মানুষ মারা যেতে পারে।
রোববার এক টিভি সাক্ষাৎকারে ডা. ফাউচি সতর্ক করে বলেন, আমেরিকার মানুষ বিপদের মাত্রা এখনো পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারেনি। পুরো দেশকেই আরও লম্বা সময় নাক-কান গুঁজে কাটাতে হবে। সবচেয়ে বিপদের আশঙ্কা রয়েছে বয়োবৃদ্ধ এবং ক্যানসার, ডায়াবেটিস ও অন্যান্য জটিল রোগে আক্রান্ত রোগীদের। তিনি দুই সপ্তাহ এঁদের কাউকে ঘরের বাইরে না যাওয়ার পরামর্শ দেন। তিনি বিপদ এড়াতে আগামী দুই সপ্তাহ সারা দেশে সবকিছু বন্ধ করে দেওয়ার পক্ষেও মত প্রকাশ করেন।
৭৯ বছর বয়স্ক ফাউচি বলেন, সম্ভাব্য সবকিছুর জন্যই প্রস্তুত থাকতে হবে। ‘আমি ব্যক্তিগতভাবে কোনো ভিড়ের মধ্যে যাব না, রেস্তোরাঁয় যাব না। আমি এমন কিছু করব না, যার ফলে দুই সপ্তাহের জন্য নিজেকে কোয়ারেন্টিনে যেতে হয়।’
বিপদ কত মারাত্মক, নিউইয়র্কের স্কুলগুলো বন্ধের সিদ্ধান্ত ঘোষণার সময় মেয়র বিল ডি ব্লাজিও তা পরিষ্কার করে বলেন। তিনি ছাত্রদের প্রাতরাশ ও মধ্যাহ্নের আহারের বিকল্প ব্যবস্থা না করা পর্যন্ত স্কুল বন্ধের বিরোধিতা করেছিলেন। কিন্তু নিউইয়র্কের গভর্নর অ্যান্ড্রু কুওমো জরুরি অবস্থা বিবেচনা করে স্কুল বন্ধের সিদ্ধান্ত নেন। অভিভাবকদের তরফ থেকেও স্কুল বন্ধের প্রবল দাবি ওঠে। রোববার স্কুল বন্ধের সিদ্ধান্ত ঘোষণার সময় ডি ব্লাজিও বলেন, আগামী ২০ এপ্রিল পর্যন্ত সব সরকারি স্কুল বন্ধ থাকবে। এরপর অবস্থার পুনর্মূল্যায়ন শেষে পরবর্তী সিদ্ধান্ত গৃহীত হবে। তিনি বলেন, ‘হতে পারে এই শিক্ষা বছরের বাকি সময়টাই আমাদের স্কুল বন্ধ রাখতে হবে।’ তিনি ঘরে বসে ইন্টারনেটের মাধ্যমে শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা ঘোষণা করেন।
করোনাভাইরাসের সংক্রমণের আশঙ্কায় প্রবাসী বাংলাদেশিদের মধ্যেও ভীতি ছড়িয়ে পড়েছে। নিউইয়র্কে দুজন বাংলাদেশির এই ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। একজন বাঙালি চিকিৎসক এই প্রতিবেদককে বলেছেন, করোনাভাইরাস শনাক্তের জন্য যে টেস্টের প্রয়োজন, এখন পর্যন্ত তার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা করা সম্ভব হয়নি। আগামী কয়েক দিনে এই পরীক্ষার সুযোগ বাড়লে মোট আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা নাটকীয়ভাবে বেড়ে যেতে পারে।
হাসান ফেরদৌস: প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক