৭ মার্চেই এসেছে স্বাধীনতার ঘোষণা
১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ভাষণের পেছনের মানুষটির গড়ে-ওঠা গল্পকেও হার মানায়। তাঁর এই ভাষণের যুগান্তকারী ভূমিকা কেবল অবিশ্বাস্য নয়, চমকপ্রদও বটে। তাই এই মানুষ ও তাঁর ভাষণ—এ দুই-ই ইতিহাসে কালজয়ী দৃষ্টান্ত হয়ে আছে। আর যা গল্প ও বাস্তবকে হার মানায়, তা হয়ে ওঠে কিংবদন্তি বা কিংবদন্তিতুল্য। তিনি আর্কেটাইপ নন, লিজেন্ড।
সাধারণের কাছে এ জীবন এবং এ ভাষণ ঠিক বাস্তব বলে বিশ্বাস হয় না। বঙ্গবন্ধুর জীবন এবং কর্ম গ্রামের ‘মাথা গরম’ ছেলে থেকে বিশ্ববরেণ্য জাতীয়তাবাদী নেতার স্বীকৃতি অর্জন, ৭ মার্চের ভাষণ এবং বাংলাদেশের সংগ্রামে নেতৃত্ব যেকোনো বিচারে অসাধারণ ঘটনা। কিন্তু তাঁর জীবন এবং কর্ম ও ভাষণটি বিচার করলে এ যে রূপকথাকেও হার মানায়। এমন সব ঘটনা একের পর এক তিনি ঘটিয়েছেন, সেসবের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটির দিকে নজর দেওয়া যাক।Ñ প্রায় জন্মলগ্নেই পাকিস্তানের কাঠামোয় বাঙালির জাতিগত বিকাশের অসম্ভাব্যতা কেবল উপলব্ধিই নয়, এ বিষয়ে স্থির প্রত্যয়ে পৌঁছানো; মুসলিম লীগ ও এর নেতৃত্বের ওপর আস্থা হারানো এবং জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ত বিকল্প রাজনৈতিক দল গঠনের প্রয়োজন বুঝে ত্বরিত যথাযথ সিদ্ধান্ত গ্রহণ; ভাষা আন্দোলনের গুরুত্ব ও জাতীয় জীবনে এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব উপলব্ধি ও সে অনুযায়ী বাঙালি জাতির মুক্তির লক্ষ্যে রাজনীতি পরিচালনা; যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনী প্রচারণার সময় সংগঠক ও নেতা হিসেবে দলের বাইরে রাজনীতির বৃহত্তর অঙ্গনে নিজের স্বাক্ষর ও অবস্থান প্রতিষ্ঠা; আওয়ামী লীগের সার্বিক নেতৃত্ব গ্রহণ এবং অন্তত তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রধান রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে নিজের অবস্থান সুদৃঢ় করা; ছয় দফার সূত্রে দলমত–নির্বিশেষে বাঙালি জাতির নেতা ও নায়কের ভাবমূর্তি অর্জন ও ভূমিকা গ্রহণ; বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনায় সর্বস্তরের মানুষকে কেবল উজ্জীবিতই নয়, ঐক্যবদ্ধ করে সক্রিয় ভূমিকা পালনের জন্য অনুপ্রাণিত করা; জাতির এই অগ্রযাত্রার পথে ব্যক্তিগতভাবে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার মতো পাকিস্তান সরকারের অনেক দমনপীড়ন-ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েও অনমনীয় দৃঢ়তায় সব বাধা মোকাবিলা করে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অভিযাত্রায় ছেদ পড়তে না দেওয়া; এবং সাহসী, দৃঢ়প্রত্যয়ী, লক্ষ্যে-স্থির নেতৃত্বের গুণে জনতার লক্ষ্যে পৌঁছানোর আকাঙ্ক্ষা, অনুপ্রেরণা ও প্রত্যয়ের প্রতীক হয়ে বন্দিত্ব কিংবা অনুপস্থিতি সত্ত্বেও এক অমোঘ শাশ্বত ভরসা ও আশ্রয় হয়ে ওঠা। একজন ব্যক্তির এই উত্তরণের দিকে কেবল সবিস্ময়ে তাকিয়ে থাকতে হয়।
তাঁর এবং জাতির এই ঘটনাবহুল অভিযাত্রা এক দীর্ঘ উত্তাল পথ-পরিক্রমা শেষে গন্তব্যে তো পৌঁছাবে একবার। সেদিন ৭ মার্চ জাতি তার কান্ডারির সঙ্গে পৌঁছে গিয়েছিল স্বাধীনতার রক্তসমুদ্রের মোহনায়। সেদিনটির তাৎপর্য বুঝতে আগের কয়েকটি মাসের ঘটনার কথা স্মরণ করা দরকার।
১৯৭০ সালের নির্বাচনে বাংলাদেশের স্বাধীনতার দাবি তাঁর দলের ইশতেহারে ছিল না। কিন্তু তাঁরই নেতৃত্বের গুণে সেদিন আপামর বিজয়ী মানুষের চাওয়া এসে মিলেছিল একটি বিন্দুতে। তা হলো বঙ্গবন্ধু এবং আওয়ামী লীগের হাতে এবার দেশের শাসনভার ন্যস্ত হবে, বাঙালি দেশ শাসন করবে।
নির্বাচনের ফলাফল জেনারেল ইয়াহিয়া এবং পশ্চিম পাকিস্তানের বিজয়ী জনপ্রিয় রাজনীতিক জুলফিকার আলী ভুট্টোকে বোকা বানিয়ে দিল। শুরু হলো তাঁদের চক্রান্ত, বাঙালিকে বঞ্চিত করার ঘৃণ্য খেলা। ফেব্রুয়ারি থেকেই দেশের পরিস্থিতি উত্তাল, মানুষ ক্ষোভে ফুঁসছিল এবং পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে শেষ লড়াইয়ের জন্য বাঁধভাঙা উত্তেজনায় নেতার নির্দেশের জন্য অপেক্ষা করছিল। তাদের কাছে পাকিস্তানি চক্রান্ত স্পষ্ট হয়ে গেছে। তাদের বুঝতে বাকি রইল না আর স্বাধীনতার বিকল্প নেই, স্বাধীনতাই চূড়ান্ত গন্তব্য। পাকিস্তানের সামরিক স্বৈরশাসক জেনারেল ইয়াহিয়া খান ১৯৭১ সালের ১ মার্চ নিজেরই ডাকা জাতীয় পরিষদের প্রথম অধিবেশন বন্ধ ঘোষণা করে এবং পূর্ব পাকিস্তানে উত্তেজনা-অস্থিরতার সব দায় বঙ্গবন্ধু ও তাঁর সহযোগীদের ওপর চাপিয়ে তাঁর ওপর বিশ্বাসঘাতকতার কলঙ্ক লেপনের চেষ্টা করলেন। এ ছিল বারুদের স্তূপে দেশলাইয়ের জ্বলন্ত কাঠি ছুড়ে দেওয়ার মতো ঘটনা।
বঙ্গবন্ধু তখনই সে আগুন ছড়াতে দিলেন না। শুরু করলেন অসহযোগ আন্দোলনের নতুন দৃষ্টান্ত। বাংলাদেশ সেদিন সর্বার্থে পাকিস্তান সরকারকে কেবল অচল করে দেয়নি, বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে নিজেরাই বিকল্প সরকার পরিচালনা শুরু করেছিল। সেদিন পাকিস্তানের সংবিধান বা সামরিক বাহিনীকে অগ্রাহ্য করে এই বাংলাদেশ ভূখণ্ডে সরকারি-বেসরকারি সব কাজকর্ম চলেছে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর সহচর-পরামর্শকদের তৈরি নির্দেশনা অনুযায়ী। সেটিকে বলা যায় বাংলাদেশের প্রথম সরকার। এ শুধু জনগণের ধারণা ছিল না, এ ছিল জন-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন।
এই প্রেক্ষাপটেই এল ৭ মার্চ। নেতা উঠে মঞ্চে দাঁড়ালেন জনসমুদ্রের সামনে। তিনি জানেন এরা এবং সারা দেশের মানুষ তাঁর কাছ থেকে কোন ঘোষণা, কী নির্দেশনা শোনার জন্য উৎকর্ণ হয়ে অপেক্ষায় আছে। তাঁর চোখ এড়ায়নি আশপাশের ভবনের ছাদে পাকিস্তানি বাহিনীর মেশিনগান তাক করা আছে। এ–ও তিনি জানেন, পাকিস্তানি বাহিনীকে এই মাঠে অবস্থানরত অসংখ্য নেতা ও নিরস্ত্র মানুষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার সুযোগ দেওয়া যাবে না। তাহলে তিলতিল করে যে স্বপ্ন পূরণের দ্বারে তিনি নিয়ে এসেছেন জাতিকে, তা একমুহূর্তে তছনছ হয়ে যাবে। স্বাধীন বাংলার স্বপ্ন এইখানেই গুঁড়িয়ে যাবে। কিন্তু তা বলে লক্ষ্য থেকে সরে আসা যাবে না, আপসের আর সুযোগ নেই। স্বাধীনতার কথা তাঁকে বলতেই হবে আজ, তবে তা বলতে হবে সুকৌশলে।
বক্তৃতায় জনগণ ও পাকিস্তানি সরকারের উদ্দেশে তাঁর নির্দেশনাগুলো খেয়াল করলে বোঝা যায় তিনি আন্দোলন স্থগিত করছেন না বা থামাচ্ছেন না, বরং পাকিস্তানি সরকারকে জনতার ওপর তাৎক্ষণিক ঝাঁপিয়ে পড়ার উসকানি না দিয়ে কৌশলে জনগণকে স্বাধীনতার লক্ষ্যে এগিয়ে যাওয়ার পথই দেখিয়েছেন। আমরা নেতার সেই অবিস্মরণীয় ভাষণ থেকে কয়েকটি দৃষ্টান্ত স্মরণ করতে পারি:
১. ‘আমি পরিষ্কার অক্ষরে বলে দেবার চাই যে, আজ থেকে বাংলাদেশে কোর্ট, কাচারি, আদালত, ফৌজদারি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ থাকবে।...২৮ তারিখে কর্মচারীরা গিয়ে বেতন নিয়ে আসবেন।’
২. ‘আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার লোককে হত্যা করা হয়, তোমাদের উপর আমার অনুরোধ রইল, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল। তোমাদের যা কিছু আছে তা নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে।’
৩. ‘জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে সবকিছু আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি তোমরা বন্ধ করে দেবে।’
৪. ‘সরকারি কর্মচারীদের বলি: আমি যা বলি তা মানতে হবে। যে পর্যন্ত আমার এই দেশের মুক্তি না হবে, খাজনা, ট্যাক্স বন্ধ করে দেওয়া হলো। কেউ দেবে না।’
৫. ‘এই বাংলায় হিন্দু-মুসলমান, বাঙালি-নন-বাঙালি যারা আছে, তারা আমাদের ভাই। তাদের দায়িত্ব আপনাদের ওপর, আমাদের ওপর, আমাদের যেন বদনাম না হয়।’
৬. ‘দুই ঘণ্টা ব্যাংক খোলা থাকবে, যাতে মানুষ তাদের মাইনা-পত্র নেবার পারে।’
৭. ‘প্রত্যেক গ্রামে, প্রত্যেক মহল্লায়, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোলো এবং তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো।’
৮. ‘মনে রাখবা: রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব। এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশা আল্লাহ।’
শেষে চূড়ান্ত ঘোষণাটি দিলেন নেতা: ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
তখন বঙ্গবন্ধু সাড়ে সাত কোটি মানুষের নেতা, নির্বাচনের মাধ্যমে সাংবিধানিকভাবে তিনিই বৈধ নেতা। মনে রাখতে হবে, এটি নির্বাচিত বৈধ এবং সর্বজনের স্বীকৃতিপ্রাপ্ত নেতার ঘোষণা। জনগণ বস্তুতপক্ষে সেদিনই স্বাধীনতার বারতা পেয়েছে, তারা তো সংগ্রামের জন্য তারও আগে থেকেই প্রস্তুত, অধীর অপেক্ষায়। যুদ্ধ বাস্তবে কতটা ভয়াবহ আকার নেয়, কত নিষ্ঠুরতার জন্ম দেয়, হয়তো তার বাস্তব ধারণা কারও তেমন ছিল না। কিন্তু সেনানিবাসে, পুলিশ লাইনসেও সাজ সাজ রব শুরু হয়ে যায়।
সব বিচারে ৭ মার্চ তারিখের পড়ন্ত বিকেলে রেসকোর্স ময়দানের মঞ্চ থেকে বঙ্গবন্ধু ডাক দিয়েছিলেন স্বাধীনতার, মুক্তির। এটি বুঝতে সেদিন কোনো বাঙালির অসুবিধা হয়নি। ২৫ মার্চ মধ্যরাতে দখলদার বাহিনীর হাতে বন্দী হওয়ার আগে বঙ্গবন্ধু সেটারই আনুষ্ঠানিক ভাষ্য প্রচারের ব্যবস্থা করেছিলেন। আর মেহেরপুরে, আজকের মুজিবনগরে ১৭ এপ্রিল তৎকালীন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার স্বাধীনতার সরকারি বিজ্ঞপ্তি জারি করেছিল। কিন্তু ৭ মার্চের ভাষণে স্বতঃস্ফূর্তভাবেই বঙ্গবন্ধু প্রথম সরাসরি স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন। সেদিনই স্বাধীনতার ঘোষণা পেয়ে গেছে তাঁর জনগণ। তাই তো তারা দখলদারদের হটাতে যুদ্ধে নেমেছিল। এই ভাষণ, এই ডাক অন্তরে ধারণ করেই তারা নয় মাস ত্যাগ ও বীরত্বের সঙ্গে নেতার নির্দেশ মেনে মুক্তির যুদ্ধ করেছিল, এনেছিল বিজয় ছিনিয়ে।
আবুল মোমেন: কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক