ট্রাম্পের 'শতাব্দী'তে আশা নেই ফিলিস্তিনের
আরবেরা ফিলিস্তিনে ইসরায়েলের অবৈধ দখলদারির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে বেশ কয়েকবার। কায়রো থেকে বাগদাদ পর্যন্ত তার দাগ রয়ে গেছে। আরবদের জাতীয় জীবনে ওই সব যুদ্ধের পরাজয় আর ফিলিস্তিনে ইসরায়েলের অবৈধ দখলদারি সৃষ্টি করেছিল এক অমোচনীয় ক্ষত। ফিলিস্তিনিরা সেই ক্ষত জীবন্ত রেখেই মুক্তির আশা করছিল। কিন্তু ট্রাম্প-কুশনার আর নেতানিয়াহু গংয়ের ‘শতাব্দীর চুক্তির’ ব্যাপারে কিছু আরব দেশের এক ধরনের সায় জেরুজালেম ও ফিলিস্তিনের ভবিষ্যৎ ইসরায়েলের হাতে তুলে দেওয়ারই নামান্তর। ফিলিস্তিনের আদি ভূমিতেই যদি তারা না থাকে তাহলে ক্ষতটাও মুছে যায়। অনেক আগেই এই বন্দিদশার ভয়াবহতা ফুটে উঠেছে ফিলিস্তিনের জাতীয় কবি মাহমুদ দারবিশের বর্ণনায়: হে নিস্তেজ বন্দী ইগল, হে আকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু হে... তোমার জ্বলজ্বলে ক্ষত ডুবে আছে আমার চোখের ভেতর।
রাজনীতিতে দুর্বৃত্তায়নের এই যুগে যে কয়েকজন রাজনীতিবিদ নিজ সামর্থ্যে মানুষকে চমকে দিতে পারেন, ট্রাম্প তাঁদের একজন। ২০১৮ সালে ট্রাম্পের জেরুজালেমে আমেরিকান দূতাবাস সরানোর ঘোষণায় যতটা না চমক ছিল, তার থেকেও ‘শতাব্দীর চুক্তি’তে চমক বেশি। সেবার আরবরা মৃদুস্বরে নিন্দা করলেও এবার আর পিছিয়ে থাকেনি। হোয়াইট হাউসের বলরুমে হাজির থেকে হাততালি দিয়ে শতাব্দীর এই চুক্তিতে শামিল হন তাঁরা। এটা ছিল ইসরায়েল রাষ্ট্রের বৈধতার সনদে স্বাক্ষরস্বরূপ আর ফিলিস্তিনের কফিনে শেষ পেরেক।
ট্রাম্প-কুশনার-নেতানিয়াহু সম্পাদিত ‘শতাব্দীর চুক্তি’ নামের এই দলিলে ফিলিস্তিনিদের জন্যও একটি রাষ্ট্র গঠনের পরিকল্পনার কথা আছে। মার্কিনদের আকস্মিক ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের ভালোবাসা কোথা থেকে এল! আসল ফাঁকিটা এখানেই। আদতে ট্রাম্পের ছক অনুযায়ী পশ্চিম তীর, জেরুজালেমসহ যেসব এলাকা ইসরায়েল বারে বারে শক্তিতে দখলে নিয়েছে, তাকে ইসরায়েলের বলে বৈধতা দেওয়া হয়েছে। ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীরের জর্ডান উপত্যকা ইসরায়েল নিয়ে নেবে। আল কুদসসহ অবিভক্ত জেরুজালেম হবে ইসরায়েলের রাজধানী। নতুন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র হবে বিভিন্ন জায়গায় কিছু টুকরা টুকরা বসতি নিয়ে। এমনকি ফিলিস্তিনি শরণার্থীরাও ফিরতে পারবে না নতুন ওই কল্পিত রাষ্ট্রে। এখানেই ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনে পশ্চিমাদের আগ্রহ। পশ্চিমারা ফিলিস্তিনিদের জন্য একটি পকেট রাষ্ট্র বানাতে চায়, যার চারপাশে ঘিরে থাকবে ইসরায়েল। সময়ের প্রয়োজনে নিরাপত্তার খাতিরে ইসরায়েল যেন তা দখলে নিতে পারে। পশ্চিমাদের এই পরিকল্পনায় আরবরা প্রতিরোধ গড়ে তোলার পরিবর্তে সমর্থনই দিয়েছে।
মার্কিনদের তথা ট্রাম্পের ‘শতাব্দীর এই চুক্তি’র পৃষ্ঠপোষক হওয়ার জন্য হোয়াইট হাউসে উপস্থিত ছিলেন আরব আমিরাত, বাহরাইন আর ওমানের প্রতিনিধিরা। আল জাজিরার খবরে প্রকাশ, ট্রাম্পের পছন্দের স্বৈরাচার সিসি সতর্কতার সঙ্গে এই চুক্তি পড়ে সিদ্ধান্ত নিতে উপদেশ দেন ফিলিস্তিনিদের। একধাপ এগিয়ে আরব আমিরাত বলেছে, মার্কিনদের মধ্যস্থতায় ও পশ্চিমা কাঠামোর মধ্যে থেকে আলোচনার টেবিলে ফিরে আসতে। কাতার ১৯৬৭ সালের সীমানা মেনে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের তাগিদ দিয়েছে। জর্ডান, আরব আমিরাতসহ সৌদি বলয়, যারা আপসরফার কথা বলেছে, আসলে তারা ভুলেই গেছে যে যতবার ফিলিস্তিনিরা আলোচনার টেবিলে বসেছে, ততবার ঠকেছে। ওয়াশিংটনে, অসলো, জেনেভা আর মাদ্রিদ আলোচনায় চুক্তির শর্ত মেনেছে শুধুই ফিলিস্তিনিরা, ইসরায়েল মানেনি। না মেনে বরং ফিলিস্তিনিদের জন্মভূমিতে আগ্রাসন চালিয়ে ভূমি দখল অব্যাহত রেখেছে। তাই রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, আলোচনা ইসরায়েলসহ পশ্চিমাদের ফিলিস্তিনিদের ভূমি দখলের মাধ্যম ছাড়া কিছুই নয়। যেমনটি ফিলিস্তিনের জাতীয় কবি মাহমুদ দারবিশ ইহুদিবাদ প্রকল্পকে ফিলিস্তিনিদের ভূমি ডাকাতির প্রকল্প হিসেবে দেখেছেন।
তুরস্ক জাতীয়ভাবে ‘শতাব্দীর এই চুক্তি’-কে বাতিল করে দিয়েছে। জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠক ডেকে ট্রাম্পের এই চুক্তির বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় অবস্থান জানিয়ে দিয়েছে। ধর্মীয় কারণে অটোমান সাম্রাজ্যে জেরুজালেমের বিশেষ মর্যাদা ছিল। মুস্তাফা কামালের কঠোর সেক্যুলার ধারার আমলেও ফিলিস্তিনিদের প্রতি সহমর্মিতা ছিল। এরদোয়ানের মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক পররাষ্ট্রনীতির অন্যতম ভিত্তি ফিলিস্তিনিদের দুর্দশা বিশ্বদরবারে তুলে ধরা। ট্রাম্পের শতাব্দীর এই পরিকল্পনার বিরুদ্ধে যখন আরবরা ক্ষমতা চিরস্থায়ী করার ফন্দি খুঁজছে, তখন তুরস্কের প্রধান সেক্যুলার ও ধর্মভিত্তিক দলগুলো এক কাতারে এসে শতাব্দীর এই চুক্তির বিরুদ্ধে সংসদ থেকে একযোগে নিন্দা প্রস্তাব পাস করেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের সম্ভাব্য প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে ট্রাম্পের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বার্নি স্যান্ডার্সসহ এলিজাবেথ ওয়ারেন থেকে শুরু করে ডেমোক্র্যাট সিনেটররা জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক নিয়ম মেনে চুক্তিতে উভয় পক্ষের সম্মতিতে শান্তির কথা বলেছেন। গাজা, আম্মান, ইস্তাম্বুলের রাস্তায় প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে ট্রাম্পের চুক্তিতে আরবদের সমর্থন নিয়ে। তবে আরবদের একটি অংশের ট্রাম্পের ‘শতাব্দীর এই চুক্তি’-তে সহমত পোষণের ঘটনা মধ্যপ্রাচ্যে ঘটে যাওয়া ১০০ বছর আগের এক ঘটনাকে মনে করিয়ে দেয়, যার কুশীলব ছিলেন অক্সফোর্ডে ইতিহাস পড়ুয়া ব্রিটিশ গুপ্তচর টমাস এডওয়ার্ড লরেন্স। লরেন্স আরবি সংস্কৃতি আর ভাষায় অত্যন্ত দক্ষ ছিলেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় পুরো মধ্যপ্রাচ্য ঘুরে আরবদের আধুনিক স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখিয়ে অটোমানদের বিরুদ্ধে বন্দুক দিয়ে যুদ্ধে নামিয়েছিলেন ঠিক সমকালীন কুর্দিদের মতো করেই। লরেন্সের নতুন জাতি রাষ্ট্রের ধ্যানধারণা আরবদের বশীভূত করে এবং পরবর্তী সময়ে তারা অটোমানদের মধ্যপ্রাচ্য থেকে বিদায় করে।
সময়ের পরিবর্তনে লরেন্স আর ট্রাম্প জামাতা কুশনারের কাজকর্মে অনেক মিল খুঁজে পেয়েছেন সমালোচকেরা। ট্রাম্প নির্বাচিত হওয়ার পর থেকেই জামাতা কুশনারকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার। লরেন্সের মতো কুশনারকে অক্সফোর্ডে আর মরুভূমিতে ঘুরতে হয়নি জেরুজালেমবিহীন একটি পকেট ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের চিত্র অঙ্কনে। স্কাই নিউজে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে কুশনার জানিয়েছেন, ফিলিস্তিন-ইসরায়েল সম্পর্কিত ২৫টি বই আর মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি রাজধানীতে করা বৈঠকেই সমাধান খুঁজে পেয়েছেন তিনি। নিজের ইহুদি স্ত্রীর কথাও তিনি বলতে পারতেন। কুশনার সময় পাননি শুধু ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে দেখা করার। তবে নিন্দুকেরা বলছেন ভিন্ন কথা। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে মার্কিনদের অনবরত যুদ্ধ আর তথাকথিত আরব বসন্তের অস্থিতিশীলতা আরবদের রাজনৈতিক ভিত কাঁপিয়ে নতুন এক ভূ-অর্থনৈতিক কাঠামো তৈরি করেছে। যে কাঠামোর মধ্যে পশ্চিমাদের আঙুল হেলানোতেই মধ্যপ্রাচ্যে যে ক্ষমতার পালাবদল হতে পারে, তা সৌদি বলয়ের কাতার অবরোধ এবং মিসরের হাজার বছরের ইতিহাসে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রথম রাষ্ট্রপতি মুরসির বিদায় ও মৃত্যু থেকে সবাই বুঝে নিয়েছে। দুর্বোধ্য এসব হিসাব মাথায় রেখে আরবদের কোনো অংশই কুশনারকে রাগাতে যায়নি বরং চুক্তিতে হাততালি দিয়ে আসন রক্ষা করেছে।
একটু হেরফের করে হলেও ট্রাম্প-কুশনার-নেতানিয়াহুর সহযোগিতায় নিজেদের ক্ষমতার একাধিপত্যবাদ টিকিয়ে রাখতে সৌদি বলয় এই শতাব্দীর চুক্তিকে বাস্তবায়ন করতে সবকিছুই করবে। কারণ এই চুক্তির মধ্যেই রাজতান্ত্রিক অনেক আরব রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতার শর্ত রয়েছে। তবে ইতিমধ্যেই মাহমুদ আব্বাস ইসরায়েল ও মার্কিনদের সঙ্গে সব সম্পর্ক ছিন্ন করে ঘোষণা দিয়ে বলেছেন, তিনি এই জুলুমের চুক্তিতে সায় দিয়ে বেইমান হিসেবে মরতে চান না। আব্বাসের এই অনমনীয় অবস্থান ফিলিস্তিনিদের আন্দোলনকে কিঞ্চিৎ বেগবান করবে। তবে অদূর ভবিষ্যতে আব্বাসের আসনে সৌদি বলয়পন্থী কাউকে বসিয়ে ট্রাম্পের ‘শতাব্দীর চুক্তি’র ফসল হিসেবে বৃহৎ ইসরায়েলের পকেটের মধ্যে ছেঁড়াখোঁড়া ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠন করলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
রাহুল আনজুম: ইস্তাম্বুলে বসবাসরত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞানের প্রাক্তন শিক্ষার্থী।