ভোলার গ্যাস উন্নয়নে বাপেক্সই যোগ্য
দক্ষিণ উপকূল অঞ্চলে অবস্থিত ভোলা বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ দ্বীপ, যা উত্তর-দক্ষিণে প্রায় ১২০ কিলোমিটার ও পূর্ব-পশ্চিমে প্রায় ২৫ কিলোমিটার বিস্তৃত। প্রাকৃতিক গ্যাস এই দ্বীপকে দুভাবে উল্লেখযোগ্য করে তুলেছে। প্রথমত, এটি বাংলাদেশের একমাত্র স্থান, যেখানে জনগোষ্ঠীর একাংশ ৪০ বছরের বেশি সময়ব্যাপী বিনা মূল্যে মাটির অগভীর স্তর থেকে আপনা-আপনি বের হতে থাকা গ্যাস রান্নাঘরে নিয়ে অবাণিজ্যিকভাবে ব্যবহার করে আসছে। দ্বিতীয়ত, ইতিমধ্যে বাংলাদেশ জাতীয় গ্যাস অনুসন্ধানী কোম্পানি বাপেক্স ভোলা দ্বীপে দুটি গভীর বাণিজ্যিক গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার করে, যাতে যথেষ্ট পরিমাণ গ্যাস মজুত রয়েছে বলে প্রমাণিত হয়। বাপেক্স ভূতাত্ত্বিক বিশ্লেষণের ভিত্তিতে মনে করে যে ভোলার আরও কটি চিহ্নিত কাঠামোতে কূপ খনন করলে নতুন গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কৃত হবে।
ভূবিজ্ঞানীরা মনে করেন, গ্যাসসমৃদ্ধ সিলেট অঞ্চলের মতো বাংলাদেশের ভূখণ্ডে ভোলা দ্বীপ এলাকাটি আরেকটি গ্যাস–সম্পদে সমৃদ্ধ এলাকা হয়ে ওঠার সমূহ সম্ভাবনা বহন করে। এ অবস্থায় এখানে বাপেক্স কর্তৃক গ্যাস অনুসন্ধানের জোরালো উদ্যোগ গ্রহণ করা বাঞ্ছনীয়। তদুপরি বর্তমানে দেশের গ্যাস-সংকটের দুর্দিনে ভোলায় বাপেক্স কর্তৃক ইতিমধ্যে আবিষ্কৃত গ্যাসক্ষেত্র দুটি উন্নয়নের কাজ অনতিবিলম্বে শুরু করে উত্পাদিত গ্যাস জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করা উচিত। গ্যাস উৎপাদনের কাজ গ্যাস আবিষ্কারের কাজের তুলনায় অনেক সহজ। তাই গ্যাস আবিষ্কারক বাপেক্সই বর্তমানে ভোলার গ্যাস উন্নয়নে পুরোপুরিভাবে দক্ষ, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু ঊর্ধ্বতন প্রশাসনের বর্তমান অবস্থানের পরিপ্রেক্ষিতে এটি প্রতীয়মান হয় যে ভোলার গ্যাস উন্নয়নে বাপেক্স নয়, বরং বিদেশি কোম্পানিকে নিয়োগ করা হচ্ছে। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠেছে, বাপেক্সের গ্যাসক্ষেত্রে বিদেশি কোম্পানি কেন? বাপেক্স নয় কেন?
ভোলা দ্বীপে গ্যাসের অবস্থানগুলো বিশ্লেষণ করে ভূতত্ত্ববিদেরা বলছেন, এখানে প্রাকৃতিক গ্যাস দুটি ভিন্ন প্রক্রিয়ায় ও পরিবেশে সৃষ্টি হয়েছে এবং অবস্থান করছে, যথা অগভীর গ্যাস ও গভীর গ্যাস। এর একটির সঙ্গে অপরটি সম্পর্কযুক্ত নয়। ভোলায় বসবাসকারী পরিবার জানে যে অগভীর গ্যাস অনেক আগে থেকেই তাদের কাছে পরিচিত এবং কোনো কোনো পরিবার ৫০ বছর আগেও মাটি থেকে নিজে নিজে বের হয়ে আসা গ্যাস ব্যবহার করত। এই অগভীর গ্যাস ভূপৃষ্ঠ থেকে মাত্র ২৫০ মিটার গভীরতায় অবস্থান করে। এটি মূলত পানির জন্য খনন করা টিউবওয়েল (নলকূপ) মাধ্যমে পানির সঙ্গে উঠে আসে। ভূতত্ত্ববিদেরা এটিকে বায়োজেনিক গ্যাস বা জৈব গ্যাস বলে থাকেন। এটির মজুত ছোট, তা স্বল্প চাপে ও স্বল্পভাবে প্রবাহিত হয় এবং তার স্থায়িত্ব তুলনামূলকভাবে কম হয়ে থাকে। এই গ্যাস বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহৃত হয় না, বরং ভোলাবাসী দীর্ঘদিন যাবৎ এই গ্যাস তাদের রান্নাঘরে বিনা মূল্যেই ব্যবহার করে আসছে।
অপর দিকে ভোলা দ্বীপের বৃহৎ গ্যাস মজুতের অবস্থানগুলো ভূগর্ভে গভীর স্তরে, অর্থাৎ ২ হাজার ৫০০ মিটার থেকে ৩ হাজার ৫০০ মিটার গভীরতায় অবস্থান করে। এ গ্যাস থার্মোজেনিক গ্যাস নামে পরিচিত আর এগুলোই বাণিজ্যিক গ্যাসক্ষেত্রের সৃষ্টি করেছে। ১৯৯৫ সালে বাপেক্স ভোলা দ্বীপে প্রথম গ্যাসক্ষেত্র শাহবাজপুর আবিষ্কার করে। এখানে ভূগর্ভে উপরিউক্ত গভীরতায় মধ্যে পাঁচটি গ্যাসস্তরের সন্ধান পাওয়া যায়। বাপেক্স কর্তৃক এই গ্যাসক্ষেত্রটির আবিষ্কার যে কারণে বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ, তা হলো খনন করা আবিষ্কৃত কূপে ভূগর্ভ থেকে তীব্র উচ্চ চাপের ধাক্কা এবং তা সামলে নিয়ে কূপটিকে ধ্বংস হওয়া থেকে বিপদ-মুক্ত করা। উল্লেখ্য, বাংলাদেশে গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রমে এটি প্রমাণিত যে এখানে অনেক স্থানে ভূগর্ভে শিলাস্তরে অতি উচ্চ চাপ বিরাজ করে, যাকে ভূতাত্ত্বিক ভাষায় ওভারপ্রেশার জোন নামে অভিহিত করা হয়। এই উচ্চ চাপ অনেক সময় অনিয়ন্ত্রিতভাবে ওপরে উঠে এসে খনন কূপ ও আনুষঙ্গিক খনন স্থাপনা ধ্বংস করে দেয়, যা ব্লো আউট নামে পরিচিত। ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের ইউনোকল অয়েল কোম্পানি কর্তৃক খনন করা সিলেটের মাগুরছড়া কূপে গ্যাস ব্লো আউট দুর্ঘটনা সংঘটিত হয়, যার কারণে প্রচুর গ্যাস নষ্ট হয়ে ক্ষতি সাধিত হয়। আবার ২০০৫ সালে একইভাবে কানাডার নাইকো রিসোর্স কোম্পানি ছাতকে টেংরাটিলা গ্যাসকূপে ব্লো আউট দুর্ঘটনা ঘটিয়ে প্রচুর গ্যাস–সম্পদ ও পরিবেশ নষ্ট করে খবরের শিরোনাম হয়েছিল। গ্যাসকূপে ব্লো আউট দুর্ঘটনা ঠেকিয়ে গ্যাসকূপকে বিপদ-মুক্ত করা একটি দক্ষ ও সাহসী কাজ। এ ক্ষেত্রে বাপেক্স কর্তৃক সম্ভাব্য ব্লো আউট দুর্ঘটনা সামাল দিয়ে খনন কূপ বিপদ–মুক্ত করা এবং সফলভাবে শাহবাজপুর গ্যাসক্ষেত্রটি আবিষ্কার করা নিঃসন্দেহে একটি কৃতিত্বের কাজ।
বাপেক্স ২০১৭ সালে ভোলা দ্বীপে দ্বিতীয় গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার করে। এটির নাম দেওয়া হয় ভোলা নর্থ এবং এটি প্রথম গ্যাসক্ষেত্রটি থেকে ৩৫ কিলোমিটার দূরে ভোলা দ্বীপের উত্তর অংশে অবস্থিত। ভোলায় বাপেক্স কর্তৃক সম্পাদিত ত্রিমাত্রিক বা থ্রিডি সাইসমিক জরিপে আরও কিছু ভূতাত্ত্বিক কাঠামো শনাক্ত করা হয়, যেখানে নতুন গ্যাসক্ষেত্রের সন্ধান পাওয়া যাওয়ার সম্ভাবনা উজ্জ্বল বলে বাপেক্স মনে করে। এ অবস্থায় বাপেক্সকে ভোলায় ইতিমধ্যে আবিষ্কৃত গ্যাস উত্তোলন ও নতুন গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কারে কূপ খননের লক্ষ্যে পরিপূর্ণ ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার ছকে কাজে নিয়োজিত করা অতি জরুরি। কিন্তু কার্যত সেটি লক্ষ করা যায় না, বরং ভোলায় গ্যাস উত্তোলন ও অনুসন্ধানের জন্য বিদেশি কোম্পানিকে নিয়োগ করার লক্ষ্যে ব্যবস্থা গ্রহণ চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে বলে জানা যায়। বাপেক্স তার নিজের গ্যাসক্ষেত্রে নিজস্ব আয়োজনে গ্যাস উত্তোলন ও অনুসন্ধান করলে তা হবে সাশ্রয়ী, প্রাতিষ্ঠানিকভাবে উৎসাহব্যঞ্জক এবং কর্মীদের অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা বাড়ানোর সহায়ক। অপর পক্ষে বিদেশি কোম্পানির মাধ্যমে গ্যাস কর্মযজ্ঞ চালালে তা হবে অপেক্ষাকৃত ব্যয়বহুল (কোনো কোনো ক্ষেত্রে কূপপ্রতি ব্যয় বাপেক্সের তুলনায় দ্বিগুণ), জাতীয়ভাবে আত্মনির্ভরশীল হওয়ার পথে বাধাস্বরূপ এবং জাতীয় কোম্পানিকে নিজস্ব কাজ করতে না দিয়ে হতাশা উপহার দেওয়ার শামিল।
বাপেক্স বছরে তিন থেকে চারটি অনুসন্ধান কূপ খনন করার ক্ষমতা রাখে। বর্তমানে এ সংস্থা শ্রীকাইলে একটি অনুসন্ধান কূপ খনন করছে। ২০১৮ সালে কুমিল্লার কসবাতে সম্প্রতি কেনা অপর একটি ড্রিলিং রিগ খননকাজ শেষ করলেও এক বছরের বেশি সময় তা সেখানেই অব্যবহৃত অবস্থায় দাঁড়ানো রয়েছে। কূপ খননের জন্য প্রয়োজনীয় যে জনবল, তা-ও বাপেক্সের রয়েছে এবং কূপ খননে আর্থিক সংহতির অভাব নেই। তা সত্ত্বেও কেন বাপেক্সকে দিয়ে তার নিজের গ্যাসক্ষেত্র উন্নয়ন করা হয় না, এর কোনো কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না। বাংলাদেশের আর দশটি সরকারি সংস্থার মতো বাপেক্সেরও দুর্বলতা রয়েছে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে রয়েছে অব্যবস্থাপনার সাক্ষ্য। কিন্তু সামগ্রিকভাবে জাতীয় অর্থনীতিতে বাপেক্সের অবদানের সাক্ষ্য তার আবিষ্কৃত আটটি গ্যাসক্ষেত্র ও দৈনিক ১০ কোটি ঘনফুট গ্যাস উৎপাদন করে জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করা।
ভোলা দ্বীপে যে দুটি গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়েছে, তাতে মোট ২ টিসিএফ গ্যাস মজুত রয়েছে বলে জানা যায়। যদিও কোনো কোনো নিরীক্ষায় এ মজুত আরও বেশি বলে হিসাব করা হয়েছে। ১৯৯৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ইউনোকল অয়েল কোম্পানি ভোলার গ্যাসের অতি উজ্জ্বল সম্ভাবনার আলোকে বাংলাদেশ সরকারের কাছে এই গ্যাসের ওপর অবলম্বন করে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জন্য গ্যাস ও বিদ্যুৎ উন্নয়নের একটি দীর্ঘমেয়াদি সামগ্রিক প্রস্তাব পেশ করে, যা ওয়েস্টার্ন রিজিওনাল ইন্টিগ্রেটেড প্রজেক্ট নামে পরিচিত। কিন্তু সে সময় দেশীয় গ্যাসক্ষেত্র বিদেশি কোম্পানিকে দেওয়ার বিষয়ে জনগণের নেতিবাচক অবস্থানের কারণে সে প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়নি। সে সময় থেকেই ভোলার ওপর দেশি-বিদেশি অনেক মহলের নজর পড়ে রয়েছে। ভূতত্ত্ববিদেরা বলছেন, ভোলার এই নজরকাড়ার ক্ষমতা ভূবিজ্ঞানের সূত্রমতেই হয়েছে। তাঁদের মতে, কেবল ভোলা দ্বীপের মূল ভূখণ্ডই নয়, বরং এর পার্শ্ববর্তী দ্বীপগুলো ও সাগরের অংশজুড়ে একটি গ্যাসবলয় থাকার সম্ভাবনা উজ্জ্বল। আর সে ক্ষেত্রে জোরালো অনুসন্ধানকাজ ভোলাকে সিলেটে বেসিনের মতো অপর একটি গ্যাসসমৃদ্ধ বেসিন হিসেবে উন্মোচিত করতে পারে। আর এর জন্য প্রয়োজন সরকারি তথা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের উদার পৃষ্ঠপোষকতা।
বাংলাদেশ তীব্র গ্যাস-সংকটের কারণে সম্প্রতি বিদেশ থেকে উচ্চমূল্যে এলএনজি (তরলীকৃত গ্যাস) আমদানি শুরু করে এবং দেশীয় গ্যাস না পেলে এলএনজির ওপর নির্ভরশীলতা আরও বাড়বে। আর এর ফলে ভোক্তা পর্যায়ে গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধি পাবে, কেবল তা-ই নয়, বরং দীর্ঘমেয়াদে অর্থনীতির ওপর অতিরিক্ত চাপ পড়বে। বিদেশি কোম্পানি নয়, বরং দেশীয় সক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে ভোলা দ্বীপের উজ্জ্বল গ্যাস সম্ভাবনা বাস্তবায়নে জরুরি পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি জনগণের সবার।
ড. বদরূল ইমাম: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ