দাওয়াত ও তাবলিগ এবং বিশ্ব ইজতেমা

বিশ্ব ইজতেমায় অংশগ্রহণ করতে দূর-দূরান্ত থেকে ধর্মপ্রাণ মানুষেরা আসতে শুরু করেছেন। গতকাল বিকেলে টঙ্গীর ইজতেমা ময়দানসংলগ্ন এলাকায়।  ছবি: প্রথম আলো
বিশ্ব ইজতেমায় অংশগ্রহণ করতে দূর-দূরান্ত থেকে ধর্মপ্রাণ মানুষেরা আসতে শুরু করেছেন। গতকাল বিকেলে টঙ্গীর ইজতেমা ময়দানসংলগ্ন এলাকায়। ছবি: প্রথম আলো

দাওয়াত মানে ‘আহ্বান’, তাবলিগ অর্থ পৌঁছানো। ইসলামের অনুপম আদর্শের প্রতি মানুষকে ডাকা হলো দাওয়াত। আল্লাহ তাআলা বলেন: ‘তোমরা ডাকো তোমাদের রবের পথে, হেকমত এবং সুন্দর উপদেশের মাধ্যমে।’ (সুরা-১৬ নাহল, আয়াত: ১২৫)। ইসলামের কল্যাণের বিষয়গুলো মানুষের দ্বারে দ্বারে পৌঁছে দেওয়া হলো তাবলিগ। হাদিস শরিফে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন: ‘তোমরা আমার পক্ষ থেকে একটি বাণী হলেও পৌঁছে দাও।’ (মুসলিম)। বিদায় হজের ভাষণে মহানবী (সা.)–এর সর্বশেষ বাক্য ছিল, ‘তোমরা যারা উপস্থিত রয়েছ, তারা অনুপস্থিতদের কাছে পৌঁছে দাও।’ (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া)। দাওয়াত তাবলিগের মূল প্রতিপাদ্য হলো, সৎ কাজে আদেশ ও মন্দ কাজে নিষেধ। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তোমরাই শ্রেষ্ঠ উম্মত, মানবজাতির কল্যাণের জন্য তোমাদের আবির্ভাব ঘটানো হয়েছে; তোমরা সৎ কাজের নির্দেশ দান করো, অসৎ কার্যে নিষেধ করো এবং আল্লাহকে বিশ্বাস করো।’ (সুরা-৩ আলে ইমরান, আয়াত: ১১০)।

ইজতেমা অর্থ হলো সম্মেলন বা সম্মিলন। এর মূল আরবি উচ্চারণ হলো ‘ইজতিমা’; বাংলায় ইজতেমা বা এজতেমা লেখা হয়। বিশ্ব ইজতেমা হলো বিশ্বসভা, বিশ্ব সম্মেলন বা আন্তর্জাতিক সমাবেশ। বিশ্ব ইজতেমা নামের দুটি শব্দের প্রথমটি বাংলা, দ্বিতীয়টি আরবি শব্দ; যা উর্দু, ফারসি ও হিন্দিতে ব্যবহৃত হয়।

কলেমা, নামাজ, ইলম ও জিকির, ইকরামুল মুসলিমিন, তাছহিহে নিয়াত ও তাবলিগ—এই ছয় মূলনীতির ভিত্তিতে পরিচালিত ‘তাহরিকুছ ছলাত’ বা ‘নামাজ আন্দোলন’ নামে প্রতিষ্ঠিত বর্তমানে ‘তাবলিগ জামাত’ নামে পরিচিত মসজিদকেন্দ্রিক দাওয়াতি কর্মধারার তিন দিনব্যাপী বার্ষিক কর্মশালা সমাবেশ, যা রাজধানী ঢাকার অদূরে টঙ্গীর তুরাগ নদের তীরে প্রতিবছর সাধারণত জানুয়ারি মাসে সম্পূর্ণ স্বেচ্ছাশ্রমে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। বর্তমানে এতে বিশ্বের ১৩৫টির বেশি দেশের মুসলমান অংশগ্রহণ করেন। এতে লাখো লোকের সমাগম হয়ে থাকে।

১৯২০ সালে দিল্লির নিজামুদ্দিন নিবাসী দারুল উলুম দেওবন্দের পাস করা আলেম মাওলানা ইলিয়াস (রহ.) ‘তাহরিকুছ ছলাত’ বা নামাজ আন্দোলন নামে ‘ইমান’ ও ‘আমল’-এর এই দাওয়াতি কার্যক্রমের কর্মপদ্ধতি প্রবর্তন করেন। বিশ্ব তাবলিগের সদর দপ্তর এখনো সেখানে অবস্থিত। বাংলাদেশে তাবলিগের প্রধান কেন্দ্র হলো ঢাকার রমনার কাকরাইল জামে মসজিদ।

আখেরি অর্থ শেষের, মোনাজাত মানে দোয়া বা প্রার্থনা। আখেরি মোনাজাত অর্থ হলো সমাপনী দোয়া, যে দোয়ার মাধ্যমে অধিবেশন সমাপ্ত করা হয়। তুরাগের তীরে টঙ্গী ময়দানে তাবলিগ জামাতের তিন দিনব্যাপী বিশ্ব ইজতেমার শেষ দিনে বিদায়লগ্নে যে সুদীর্ঘ সম্মিলিত দোয়া বা মোনাজাত করা হয়, তা-ই আখেরি মোনাজাত নামে পরিচিত।

হাদিস শরিফে রয়েছে, ‘দোয়া ইবাদতের মগজ বা মূল।’ (বুখারি ও মুসলিম)। তাই দোয়া ও মোনাজাতের গুরুত্ব অপরিসীম। বিশেষ বিশেষ সময়ে এবং কোনো কাজের
শুরুতে ও শেষে দোয়া করা সুন্নত। সম্মিলিতভাবে দোয়া করা মোস্তাহাব। কোনো মজলিশে কোনো একজনের দোয়া কবুল হলে তাঁর সৌজন্যে আল্লাহ তাআলা সবার দোয়া কবুল করবেন আশা করা যায়। নির্ধারিত ইবাদত যথা ফরজ, ওয়াজিব ও সুন্নতের গুরুত্ব ও মাহাত্ম্য সর্বাধিক এবং এগুলো সবার আগে পালনীয়। অনির্ধারিত ইবাদত নফল ও মুস্তাহাবের স্থান এর পরে। ফরজ, ওয়াজিব ও সুন্নত বাদ দিয়ে নফল বা মুস্তাহাব আমল করা জ্ঞানবানদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়।

ইমান ও ইসলামের সুফল লাভের জন্য প্রথমত সব হারাম ও মাকরুহ কাজ বর্জন করতে হবে; দ্বিতীয়ত সব ফরজ, ওয়াজিব ও সুন্নত আমলসমূহ পালন করতে হবে; তৃতীয়ত নফল ও মুস্তাহাব আমল দ্বারা আল্লাহর নৈকট্য হাসিলের জন্য সচেষ্ট থাকতে হবে। আল্লাহ আমাদের সবাইকে দুনিয়ার শান্তি ও পরকালের মুক্তি দান করুন।

দাওয়াত ও তাবলিগ মূলত দ্বীনি তালিম বা শিক্ষা আদান-প্রদানের অন্যতম মাধ্যম। তাই একে শিক্ষাসফরও বলা যায়। হজরত মুসা (আ.) আল্লাহর নির্দেশে সত্যজ্ঞান অন্বেষণে বের হওয়ার প্রাক্কালে সঙ্গীকে বলেছিলেন, ‘আমরা হয়তো দুই নদ–নদীর মিলনস্থলে উপনীত হব; নয়তো অনন্তকাল চলতে থাকব।’ অতঃপর যখন তাঁরা উদ্দিষ্ট গন্তব্য পেয়ে গেলেন এবং হজরত খিদির (আ.)–এর সাক্ষাৎ লাভ করলেন তখন বললেন, ‘আমি কি আপনার সঙ্গী হতে পারি? আপনাকে অনুসরণ করে সেই জ্ঞানের কিঞ্চিৎ লাভ করার জন্য যা আল্লাহর পক্ষ থেকে আপনাকে সত্যের সন্ধানে দেওয়া হয়েছে।’ (সুরা-১৮ কাহাফ, আয়াত: ৬০ ও ৬৬)।

দ্বীন শিক্ষা ও দ্বীন প্রচার-প্রসারে হিজরত ও নুসরত জরুরি। হিজরত মানে আপন এলাকা ত্যাগ করে অন্যত্র যাওয়া। নুসরত হলো দ্বীনি কাজে আসা ব্যক্তিকে সহযোগিতা করা। ইসলামের শুরু থেকেই এই ধারা বিদ্যমান।

মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী: বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতির যুগ্ম মহাসচিব ও আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম–এর সহকারী অধ্যাপক
smusmangonee@gmail,com