বছরের শেষ দিনে প্রকাশিত হয়েছে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী ও জেএসএসি পরীক্ষার ফল। আর নতুন বছরের প্রথম দিনে শিক্ষার্থীদের হাতে সরকারিভাবে তুলে দেওয়া হয়েছে নতুন বই। দুটিই শুভপ্রদ ঘটনা। সব ভালোর বড় ভালো হলো দুটি পরীক্ষাতেই পাসের হার ও জিপিএ–৫–এ মেয়েরাই এগিয়ে। পিছিয়ে থাকা সমাজে বালিকারা যত ছোট থেকে শিক্ষায় এগিয়ে থাকবে, ভবিষ্যতের জন্য ততই তারা প্রস্তুত হতে পারবে। আমরা আমাদের আশার এই স্নিগ্ধ দীপশিখাদের অভিনন্দন ও ভালোবাসা জানাই।
দুই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে ৪৩ লাখ ছেলেমেয়ে। এদের এক অংশ প্রাথমিক শেষ করে মাধ্যমিকে পা রাখল। আরেক অংশ অষ্টম শ্রেণি শেষ করে নবম শ্রেণিতে উঠে এল। পাসের হার ও জিপিএ–৫ দুদিকেই এবারের ফল বেশ সন্তোষজনক। ২০১৯ সালে জেএসসিতে মেয়েদের পাসের হার ছিল ছেলেদের চেয়ে ২ শতাংশ বেশি। ৮৮ দশমিক ৩৩ অংশ। জিপিএ–৫ পাওয়ার হারেও তারাই এগিয়ে। এ ধরনের ভালো ফল জানায় যে সরকার, শিক্ষাকাঠামো এবং অভিভাবকেরা ছাত্রছাত্রীদের বিষয়ে এবার বেশি যত্নশীল ছিলেন। শিশুরাও তার প্রতিদান দিয়েছে। তবে ক্রীড়া ও অর্থনীতির মতো শিক্ষায়ও মেয়েদের এগিয়ে থাকা বোঝায়, বেগম রোকেয়ার ঐতিহ্য এখন আরও শক্তিশালী।
বাংলাদেশে একের পর এক সরকার এসেছে, অনেক কিছু বদলেছে, কিন্তু একটি ধারাবাহিকতা সবাই বজায় রেখে এসেছে। সেটা হলো শিশু ও নারীশিক্ষা বিস্তারে ধারাবাহিক প্রচেষ্টা। এটা একধরনের সামাজিক বিনিয়োগ। এই বিনিয়োগের সুফল এখন সমাজ পেতে শুরু করেছে। গত এক যুগে প্রাথমিক থেকে শুরু করে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকের ফলাফলে দেখা যায়, মেয়েরাই এগিয়ে। ২০১৯ সালের সরকারি ও বেসরকারি মেডিকেল কলেজের ভর্তি পরীক্ষায়ও এগিয়ে ছিলেন মেয়েরা। নিশ্চয়ই এসব পরিসংখ্যান আমাদের সমাজের সুপ্ত নারীশক্তির উত্থানেরই ইশারা দেয়।
কিন্তু এই অগ্রগতির ছবি প্রায়ই ফানেলের আকৃতি গ্রহণ করে। অর্থাৎ প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে যত মেয়েশিক্ষার্থী ভর্তি হয়, যতজন ভালো ফল করে, উচ্চশিক্ষার পর্যায়ে সেই সংখ্যা ও হার সংকুচিত হয়ে আসে। বহু প্রচেষ্টাতেও বাল্যবিবাহ সম্পূর্ণ রোধ করা যায়নি। সংসারে, রাজনীতিতে ও পেশাগত জীবনে নারীদের সামনে যে চিরাচরিত বাধাগুলো হাজির হয়, সেসব তাদের শিক্ষাজীবনের ওই সফলতার ধারা সব ক্ষেত্রে বজায় রাখতে দেয় না। শিক্ষাক্ষেত্রে তাদের দিতে হয় মেধা ও নিষ্ঠার পরীক্ষা আর বাস্তব জীবনে দিতে হয় আপস ও মেনে নেওয়ার পরীক্ষা। মেধা ও নিষ্ঠা তাদের এগিয়ে দিলেও আপস ও মেনে নেওয়ার সংস্কৃতি তাদের পিছিয়ে দেয়। এই দুই বিপরীত চিত্র আমাদের সমাজের অন্তর্গত সংকটেরই পরিচায়ক।
পরীক্ষার ফল নিয়ে উচ্ছ্বাস ও আস্থার পাশাপাশি দূরদর্শিতাও দরকার। বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে প্রাথমিক পর্যায়ের শিশুদের পরীক্ষা নেওয়া হয় না। পরীক্ষাভীতি থেকে সরিয়ে পড়ালেখাকে আনন্দময় করাই সেখানে লক্ষ্য। ইতিমধ্যে বাংলাদেশেও অনুরূপ চিন্তাভাবনা চলছে। পরীক্ষাভীতি, পরীক্ষার জন্য তৈরি হতে গিয়ে ক্লাসের বাইরে কোচিং–টিউশন ইত্যাদির পেছনে যে ব্যয়, তা–ও অনেক পরিবারের সন্তানদের পড়ালেখা থেকে দূরে সরায়। শিশুমনের বিকাশ, তার জ্ঞান ও বুদ্ধিবৃত্তিক উন্নয়নই যদি লক্ষ্য হয়, তাহলে পরীক্ষার চাপাচাপির চেয়ে বেশি মনোযোগ দেওয়া দরকার পাঠদান ও শিক্ষাসহায়ক কার্যক্রম আরও উন্নত করার দিকে। তার জন্য ভালো শিক্ষক ও ভালো পাঠ্যক্রম থাকা জরুরি।
যারা ভালো ফল করেছে আর যারা ততটা ভালো করেনি অথবা যে অল্পসংখ্যক শিশু খারাপ ফল করেছে, তাদের সবার জন্যই বার্তা একটি। তা হলো ভালোর চর্চা ধরে রাখার বিষয় এবং অপেক্ষাকৃত খারাপদের জন্যও রয়েছে ভবিষ্যতের সুযোগ। সবার আগে মা–বাবা ও অভিভাবকদের এটা বুঝতে হবে।