২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

টিভি দেখে শেখা খুন ও বিনোদনের বাচ্চা জকি

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

শিশুরা মায়ের পেটে জন্মায় ঠিকই, কিন্তু তাদের মনমানসিকতা গড়ে দেয় অন্য কেউ—টেলিভিশন, ইউটিউব, রিয়েলিটি শো, বিজ্ঞাপন। আর এসব বিনোদন এমনই শিক্ষণীয় যে, শিশুদের কেউ কেউ খুনের শিক্ষাটাই পায়। অথচ পাঠ্যপুস্তকে লেখা থাকে, ‘জীবে দয়া করে যেইজন, সেইজন সেবিছে ঈশ্বর’। মা-বাবা শেখান, সত্য বলবে, কারও ক্ষতি করবে না, বন্ধুকে ভালোবাসবে। শিশুদের অনেকেই আর বইপুস্তক কিংবা অভিভাবকের থেকে শেখে না, তাদের ফ্রেন্ড, ফিলোসফার অ্যান্ড গাইড হলো ভিজ্যুয়াল বিনোদন মাধ্যম। সেখান থেকে কী শেখে, তার এক ভয়াবহ কাহিনি প্রকাশিত হয়েছে প্রথম আলোয় তারা তিনজনই শিশু। তিনজন মিলে যখন তাদেরই আরেক বন্ধুকে হত্যার পরিকল্পনা করল, তখনো তারা শিশুই ছিল। সেই বোকা ও হতভাগ্য শিশুটিকে হত্যার চিন্তায় যখন আখখেতে নিয়ে গেল, তখনো তারা শিশুই ছিল। আখখেতের মধ্যে বন্ধুটিকে তারা বলে, আখের গোড়ার নতুন কুশি তুলে বাড়িতে লাগালে আখের গাছ হবে। এই বুদ্ধিটাও শিশুমনে খেলেছিল যে আখের গোড়া তুলতে বন্ধুটি পেছন ফিরলে তার মাথায় লোহার রডের বাড়ি দিয়ে মেরে ফেলবে। ঠিক সেটাই তারা করে। অসহায় শিশুটিকে যখন তারা পিটিয়ে রক্তাক্ত করেও মেরে ফেলতে পারছিল না, তখন শিশুর মতোই ভয়ে তারা পালায়। পরে পুলিশের কাছে ভয়ে ভয়ে তাদের একজন স্বীকার করে, ‘স্যার আমার কিছু হবে না তো?’ তার এই কথার মধ্যে শিশুসুলভ সারল্যই প্রকাশ পায়। পুলিশের আশ্বাসে শিশুর মতোই বিশ্বাস হয় তাদের। তখন সত্য বলে দেয়, ‘আরাফাতের লাশ কোথায় আছে আমি জানি, কিন্তু আমি কাছে যেতে পারব না।’

বাকি বর্ণনা খবর থেকেই পড়া যাক: এরপর রাত ১১টায় ওই শিশুর দেখানো জায়গায় পৌঁছায় পুলিশ।...তাদের কথামতো আখখেতের ভেতরে উপুড় হয়ে পড়ে থাকা অবস্থায় আরাফাতকে পাওয়া যায়। মাথায় অনেকগুলো আঘাতের চিহ্ন, বাঁ কানের অনেকটা অংশ কাটা। রক্তে ভেসে যাচ্ছে চারপাশ। মারধরের পর দীর্ঘ ১৩ ঘণ্টা ধরে রক্তক্ষরণ হয়। অস্ফুট স্বরে বলছিল, ‘আপনারা কারা? আমাকে একটা বালিশ দিন আমি একটু ঘুমাব। আমার আব্বু আম্মু কোথায়?’ এত রক্তক্ষরণের পরও শিশুটি বেঁচে ছিল।

যে শিশুটি বেঁচে ছিল তার ভেতরের শিশুসত্তাটি কি আগের মতো নিদাগ-নিষ্পাপ থাকতে পারবে? যে তিন শিশু তাকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত, পরিকল্পনা এবং আন্তরিকভাবে তা বাস্তবায়ন প্রায় করে ফেলেছিল, তারাও কি আর শিশু থাকতে পারবে? তাদের শৈশবকে হত্যা করল কে? কে তাদের কাউকে ঘাতক আর কাউকে নিহত বানাবার কিনারে ঠেলে এনেছে? সেই পেছনের শক্তিটির নাম কি পুলিশের এজাহারে থাকবে? তাকে কি বিচারের মুখোমুখি করা সম্ভব হবে? পুলিশ তো শিশু তিনটিকে কিশোর সংশোধন কেন্দ্রে পাঠিয়ে দিয়ে খালাস; কিন্তু এটা কি ওই চার শিশু এবং তাদের পরিবারগুলোর প্রাপ্য ছিল?

শিশু তিনটি ভারতীয় টেলিভিশনে ‘ক্রাইম প্যাট্রোল’ দেখে হত্যার নকশা করেছিল। ভারতীয় এই টেলিভিশন শো-তে পুলিশের কাছে মীমাংসিত কোনো ভয়ংকর অপরাধের কাহিনি সিনেমাটিক কায়দায় দেখানো হয়। ‘সত্য’ ঘটনা অবলম্বনে দেখানো সেসব গল্প দর্শকদের মনে রোমাঞ্চ জাগায়, ভয় জাগায়, অপরাধীর প্রতি ঘৃণা জাগায়। আবার অনেকে সেখান থেকে শেখে অপরাধের নিখুঁত কায়দা-কৌশল। শিশুরা নাহয় অপরিণামদর্শী, কিন্তু সাবালক মানুষও কি একই পথে যাচ্ছে না?

গত ৩০ অক্টোবরের খবর। নেত্রকোনার আবদুল্লাহ খান (২৫) ওই একই ক্রাইম প্যাট্রোল টিভি শো-তে দেখানো মডেল ধরে একের পর এক শিশুকে অপহরণ করে মুক্তিপণের ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। ষষ্ঠ শিশুকে অপহরণের পর ভাগ্যের ফেরে তিনি ধরা পড়েন। এহেন আবদুল্লাহ জিজ্ঞাসাবাদে পুলিশকে জানান, ভারতীয় টিভি সিরিজ ‘ক্রাইম প্যাট্রোল দেখেই এ কাজ শুরু করেছিলেন তিনি।

ঘটনা মাত্র দুটি না। অজস্র ঘটনা আছে। হিন্দি টিভির সিরিয়ালের দর্শকেরা মনে করতেই পারেন, ওই সব সিরিয়ালে দেখানো পরিবারগুলোর মতো সব পরিবারেই প্রত্যেকে প্রত্যেকের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্ররত। বিনোদন তাই আর নির্দোষ নেই। আমরা মধ্যপ্রাচ্যে শিশুদের উটের জকি করা নিয়ে প্রচুর কথা বলেছি, সেটা বন্ধও হয়েছে। কিন্তু টেলিভিশনে শিশুদের বিনোদনের জকি করাটা দিব্যি উপভোগ করছি।

মনের নাম মহাশয়, যা সওয়াও তা-ই সয়। বিজ্ঞাপনে শিশু, বিনোদনেও শিশু। যেকোনো চ্যানেলে ১০টি বিজ্ঞাপনের কমপক্ষে সাতটিতেই তাদের নিষ্পাপ মুখে বসানো হয় ব্যবসায়ী বুলি। সরল ও সুন্দর শিশুর জবানে-অভিনয়ে পণ্যের সুখ্যাতি দেখে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে, ব্যবসা সত্য না, মুনাফা সত্য না, পণ্যাসক্ত শৈশবই সত্য। অভিভাবকেরা অর্থ পাচ্ছেন, শিশুটিও স্টার হচ্ছে। আর ঘরের শিশুরা ভাবছে, ওই শিশুটির মতো আমারও খ্যাতি দরকার, টাকা দরকার। আর দরকার ওই সব বিজ্ঞাপিত পণ্য। মা-বাবারা তাদের আবদারে হার মানেন। শিশুরাও হয়ে যায় ওই সব পণ্যের স্থায়ী ক্রেতা। পণ্যায়িত সমাজে একটি নতুন শিশুর জন্ম তাই একজন সম্ভাব্য ক্রেতারও জন্ম। এ যুগে মিডিয়াই এখন আমাদের চোখ-কান-মন। মায়ের ছেলে বা বাবার মেয়েটি ঘরে শেখে, স্কুলে শেখে, টিভি দেখেও শেখে। কিন্তু কী শেখে আসলে?

ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহারের নিন্দা হয়, শিশু ও তাদের প্রতি বড়দের কোমল আবেগের বাণিজ্যিক ব্যবহারও নিন্দনীয়। দেশি চ্যানেলগুলো এই পথে নবীন বলে রয়েসয়ে দেখায়। কিন্তু ভারতের হিন্দি চ্যানেলগুলো যে রকম তুখোড় দক্ষতা অর্জন করেছে, তাতে ভাষা ও সীমানা পেরিয়ে তার ডাক আমাদের ঘরে ঘরে সচিত্র বাজছে। হিন্দি সিরিয়ালের পাশাপাশি শিশুদের নাচ-গানের প্রতিযোগিতা তথা রিয়েলিটি শো বাংলাদেশেও দারুণ জনপ্রিয়। বাংলাদেশে দর্শকের মন্দায় পড়া মেধাহীন অনুষ্ঠানকারেরা বাধ্য হচ্ছেন তাঁদের অনুকরণ করতে। দৃশ্য বা ইমেজের ক্ষমতা এতই সর্বজনীন যে, ভিন্ন ভাষা ও সংস্কৃতির ঘের তা অনায়াসেই ভেঙে ফেলছে।

ওই সব অনুষ্ঠান আমাদের শৈশবের নতুন কুঁড়ির নাচ-গান নয়। ধুমধাড়াক্কা হিন্দি ছবির চটুল গানের সঙ্গে ততোধিক চটুল নাচ। দূর থেকে দেখলে মনে হবে বুঝি বলিউডি তারকারাই মঞ্চ কাঁপাচ্ছে, দর্শকের মনে ঢেউ তুলছে। সেই পোশাক, সেই বিশেষ ভঙ্গি, সে রকম শরীর চঞ্চল করা কথা ও সুর। একটি তিন-চার বছর বয়সী বালিকা অসম্ভব কসরত করে যে নাচটি করে, ফিল্মের দৃশ্যে তা করেছিল স্বল্পবসনা কোনো হার্ট থ্রব নায়িকা। দুধের বয়সী বাচ্চাদের ‘চুম্মা চুম্মা দে দো’ গানের সঙ্গে নাচা কি নিরীহ বিনোদন? দুটি বালক-বালিকাকে প্রেমঘন গানে নাচানো কি সভ্যতা? বহুদিনের বহু অনুশীলনে তারা এসব শিখেছে। আর আমরা চোখ ভরে দেখে মন ভরে মজে যাচ্ছি। ফেসবুকে এমনসব গান-নাচ-পোশাকের শিশুদের ভিডিও ভাইরাল হচ্ছে। তারা অনেকে নিজেরাই ইউটিউব বা টিকটকে এসব ভিডিও আপলোড করছে। এ ধরনের বিনোদন সমাজের বাছবিচারের ক্ষমতাকে করে দিচ্ছে অবশ।

বড়রাও এসব অনুষ্ঠানের দর্শক। শিশুদের মতো তাঁদেরও কি ক্ষতি করা হচ্ছে না? এ আনন্দ কতটা নির্মল, কতটা নিরীহ? সিনেমার প্রেমঘন দৃশ্যে যে গান বা নাচ সাবালক দর্শককে অবলোকনসুখ দেয়, শিশুর কণ্ঠ ও দেহ ব্যবহার সে ধরনের বিনোদনে সুখ পাওয়া বা দেওয়া অরুচিকর শুধু না, অন্যায়ও। শিশু ধর্ষণ ও নির্যাতনের মাত্রা বেড়ে যাওয়ার পেছনে এ ধরনের অরুচিকর বিনোদনও কি দায়ী না?

এভাবে শিশুদের একাধারে ‘খুদে প্রাপ্তবয়স্ক’ বানানো হয়, অন্যদিকে তারা হয় বড়দের ‘আনন্দের পুতুল’। অমিতাভ বচ্চনের ‘পা’ ছবিতে ছোট্ট একটি শিশুর প্রোজোরিয়া নামের দুরারোগ্য রোগে বুড়িয়ে যাওয়ার বেদনায় দর্শক কাঁদে। আর বিনোদনের ছলে ছোট মনে বড়র ভাব সংক্রমণের রোগটিকে কী বলব? বললে ‘সেক্সুয়ালাইজেশন অব চাইল্ডহুড’ বা ‘শৈশবের যৌনকরণ’ই বলতে হয়। সংস্কৃতির ক্ষতি এক প্রজন্মে শেষ হয় না। বহু প্রজন্মে তা চলে।

গল্পের হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা জাদুর বাঁশি বাজিয়ে শিশুদের চুরি করে নিয়ে গিয়েছিল, আর আজ শিশুদের শৈশবিক কোমলতা চুরি হচ্ছে বড়দের বেহুঁশ বিনোদনের খায়েশে। সেই বাঁশি বাজাচ্ছে জাদুর বাক্স টেলিভিশন। বোকা বাক্সটি এখন আর বোকা নেই। বোকা বাক্সের কারিগরেরা আমাদের শিশুদের কাউকে করে তুলছে খুনি, কাউকে বানাচ্ছে বিনোদনের জকি। বড়রা কি খেয়াল করছি? আগেকার উটপাখি মুখ লুকাতো বালিতে, এখন বোধ হয় তারা মুখ লুকায় টিভির স্ক্রিনে। মুখ তো লুকাতেই হবে। কারণ আমরা শিশুদের মাঠ–বাগান–বন্ধু ও আমুদে পরিবার না দিতে পারি, বিনোদনে রঙিন স্ত্রিন তো দিয়েছি!

ফারুক ওয়াসিফ: প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক।
[email protected]