জুবীন গর্গরা রাজনীতি করতে চান!
‘পলিটিকস ন করিবা বন্ধু’ অসমিয়া ভাষায় জুবীন গর্গের একটা সুপারহিট গান। বাংলাদেশেও অনেকে গানটার কথা জানেন ইতিমধ্যে।
জুবীন এখনকার আসামের মিউজিক সেনসেশন। বহু ভাষায় গান আছে তাঁর। অভিনয়ও করেন। সংগীতপিপাসু অসমিয়া তরুণদের মধ্যে পাহাড়সম জনপ্রিয়তা তাঁর। বলিউডেও আছে তার রেশ। ফেসবুকে তাঁকে ফলো করছে এ মুহূর্তে ৯ লাখের বেশি মানুষ।
অসমিয়া গানে ভূপেন হাজারিকাকেই বাংলাদেশ ভালো চেনে-জানে। ২৬ জানুয়ারি, ভারতের সর্বশেষ প্রজাতন্ত্র দিবসে ভূপেনকে ‘ভারতরত্ন’ দিয়েছিল বিজেপি সরকার। বলা হয়, সেই ঘটনাকে বিদ্রূপ করেই জুবীন ‘পলিটিকস ন করিবা বন্ধু’ গান লেখেন সে সময়। ইউটিউব সাক্ষ্য দিচ্ছে, প্রায় ২৩ লাখ মানুষ গানটি ইতিমধ্যে দেখেছে। প্রথম ১০ দিনে ১০ লাখ শ্রোতা শোনে গানটি।
‘পলিটিকস ন করিবা বন্ধু’ গানে রাজনীতিকে তিরস্কার করেছিলেন জুবীন। কিন্তু ইতিহাসের বড় কৌতুক হলো, ভারতজুড়ে নতুন নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে ক্ষোভের মুখে এই সপ্তাহে জুবীন সরাসরি রাজনীতিতে যোগ দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। আসাম ও উত্তর-পূর্ব ভারতে অন্যতম টক অব দ্য টাউন জুবীনের এই ঘোষণা। অনেকে এ–ও বলছেন, দক্ষিণ এশিয়ার সমগ্র তরুণসমাজের সামনেই একই নিয়তি অপেক্ষা করছে।
জুবীন অবশ্য হঠাৎ করে নয়, অনেক দিন থেকে নাগরিকত্ব আইনের বিরোধিতাকারীদের মিছিল-সমাবেশে যান। বিজেপি জানত, নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিবাদ হবে আসামে। সেই বিবেচনা থেকেই আসামের সংগীত কিংবদন্তি ভূপেনকে ‘ভারতরত্ন’ দিয়ে রাখে লোকসভা নির্বাচনের আগে আগে।
ভারতের সর্বোচ্চ বেসামরিক খেতাব এটা। নিঃসন্দেহে ভূপেন হাজারিকা তা পাওয়ার মতো যোগ্যতাসম্পন্নও বটে। তবে ভারতরত্নের ৬৫ বছরের ইতিহাসে ভূপেন দ্বিতীয় অসমিয়া মাত্র। তা–ও আবার মৃত্যুর পরই কেবল তাঁকে সম্মানিত করার কথা মনে এল নয়াদিল্লির। সবচেয়ে বড় সত্য, তাঁকে এই খেতাব দেওয়ার পেছনে বিজেপির তরফ থেকে প্রবল রাজনৈতিক বিবেচনা ছিল। ভারতের নাগরিকত্বের আইনগত সংশোধনী ‘সিএবি’র বিরুদ্ধে অসমিয়া তরুণ-তরুণীদের শান্ত রাখতেই ভূপেনকে অসাধারণ ওই সম্মান দেখানো হয়।
এ সময় জুবীন তাঁর গানে ভক্ত-শ্রোতাদের বলছিলেন, ‘নোংরা রাজনীতি করার চেয়ে দুবেলা দুমুঠো খুঁটে খাওয়াও ভালো।’ তাঁর গানের ভাষায় ‘রাজনীতি, জাগ্রত জনতাকে দিগ্ভ্রষ্ট করছে।’ রাজনীতিবিদদের ‘পরিবর্তন’-এর বুলিকেও তিরস্কার করেন তিনি। কিন্তু বছর না ঘুরতেই জুবীন বুঝতে পেরেছেন, দক্ষিণ এশিয়ার সমাজজুড়ে ধর্ম ও জাতিবাদী উগ্রতার ময়লা-আবর্জনা সরাতে সরাসরি হাত না লাগিয়ে উপায় নেই। আসাম সীমান্তের চারদিকে জুবীন যেন ভক্তদের এক অমোঘ বার্তা দিলেন। রাজনীতির বিকল্প নেই।
তবে জুবীনের গল্পটি ওপরের বিবরণের মতো একেবারে সাদামাটাও নয়। বিজেপিকে কেন্দ্রে ও রাজ্যে ক্ষমতায় আনার পেছনে দুই-তিন বছর আগে তাঁরই বড় অবদান ছিল। আসামে যে ২০১৬ সালের নির্বাচনে বিজেপি চমকপ্রদ ফল করল, তার পেছনে এই সংগীত তারকার বড় ভূমিকা আছে। পরে অবশ্য তিনি আফসোস করেছেন সেই কাজের জন্য। এখন আরেক ধাপ এগিয়ে, রাজনৈতিকভাবে বিজেপিকে উত্তর-পূর্ব ভারতে চ্যালেঞ্জ করতে চান তিনি।
সেলিব্রিটিদের ঘিরে সব সময় বিতর্ক থাকে। অনেকের বিশ্বাস, তাঁরা বিতর্ক তৈরিও করেন। বিজেপির হয়ে ২০১৬ সালে নির্বাচনে ভূমিকা রাখলেও পরে ভূপেনের খেতাব নিয়ে বিদ্রূপ করায় জুবীনের বিরুদ্ধে হোজাই জেলার লঙ্কা থানায় মামলা করেন বিজেপি–ভক্তরা। দিসপুর থানায়ও জুবীনের বিরুদ্ধে একই ধরনের অভিযোগে একটা এফআইআর হয়।
এসব মামলা-মোকদ্দমায় ভূপেন উপলক্ষ মাত্র। নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে জুবীনের ধারাবাহিক সক্রিয়তাই মূল কারণ। উগ্র জাতীয়তাবাদ সমাজের গভীরে থাকা কোনো ‘গর্বের প্রতীক’কে আশ্রয় করেই বাঁচে। জুবীনের অবাধ্যতায় বিজেপি তাৎক্ষণিকভাবে তাঁর বিরুদ্ধে ভূপেনের ইমেজ ব্যবহার শুরু করে। যেহেতু পশ্চিমবঙ্গেও নাগরিকত্ব আইনের ব্যাপক বিরোধিতা আছে, তাই এবারের ভারতরত্নের তালিকায় ছিলেন বাঙালি প্রণব মুখার্জিও। তবে কলকাতায় বিজেপির খেতাবের রাজনীতি নিয়ে তেমন প্রতিবাদ হয়নি, যেমন ঘটিয়েছিলেন জুবীন গুয়াহাটিতে। এই ঘটনায় স্বভাবত জুবীন ও বিজেপির সম্পর্ক আপাতত শেষ হয়ে গেছে। কয়েক মাস থেকেই জনপ্রিয় এই অসমিয়া শিল্পী বিজেপির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে রাজনীতির ময়দানে পা ফেলছিলেন ধীরে ধীরে। চলতি সপ্তাহে পুরোপুরি ‘রাজনৈতিক মঞ্চ’ তৈরির ঘোষণাই দিলেন। ভারতের লোকসভা ও রাজ্যসভায় নাগরিকত্ব আইনের বিতর্কিত সংশোধনীগুলো পাসের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে জুবীনের এই ঘোষণা এল। স্বভাবত এখন ‘পলিটিকস ন করিবা বন্ধু’ গানের কথা ফিরিয়ে নিতে হবে জুবীনকে।
গুয়াহাটির চাঁদমারিতে জুবীন যে অনুষ্ঠানে এ সপ্তাহে রাজনৈতিক মঞ্চ গড়ার ঘোষণা দেন, সেখানে ‘আসু’র নেতারাও উপস্থিত ছিলেন। নিখিল আসাম ছাত্র ইউনিয়ন বা ‘আসু’ হলো একদা আসামের সবচেয়ে প্রভাবশালী অসমিয়া ছাত্রসংগঠন। এদের নেতৃত্বেই ১৯৮০-এর দিকে ‘বিদেশি খেদাও’ আন্দোলন শুরু, যা শেষ পর্যন্ত কল্পিত ‘বাংলাদেশি’বিরোধী আন্দোলনে পরিণত হয়েছিল। ওই আন্দোলনেরই ফসল আজকের এনআরসি। এক অর্থে লোকসভা-রাজ্যসভা পেরিয়ে আসা নতুন ভারতীয় নাগরিকত্ব আইনেরও পটভূমি তৈরি হয় ‘আসু’র ওই সহিংস আন্দোলন থেকে। আর এখন সেই আসামকেই এই আইনের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হচ্ছে। ভারতে সিএবির বিরুদ্ধে প্রথম ‘বন্ধ্’ হয়েছে আসামেই। প্রথম কারফিউও সেখানেই।
অসমিয়া সমাজের এই বিপরীতধর্মী চিত্রের এখানেই শেষ নয়। কয়েক বছর ধরে আসুর প্রতিষ্ঠাতাদের অনেকেই বিজেপির ঘনিষ্ঠ শক্তি হিসেবে কাজ করছেন। প্রদেশটির ক্ষমতায়ও তাঁরা। কিন্তু এখন আসু যদি জুবীনের পেছনে দাঁড়ায়, তাহলে সেটা আসামের রাজনীতির পুরো ছক পাল্টে দিতে পারে। সাধারণ অসমিয়ারা বিজেপিকে ‘বিশ্বাসঘাতক’ হিসেবে দেখছে এ মুহূর্তে। নতুন নাগরিকত্ব আইনের মাধ্যমে বিজেপি আসামে ‘বাঙালি হিন্দু’দের পুনর্বাসন করতে চাইছে, এমনটিই অনুমান অসমিয়াদের।
তবে জুবীনের রাজনীতিতে আসার ঘোষণা কেবল আসামেই নয়, সমগ্র ভারতেই একটি পালাবদলের সূচনাও বটে। এটা যতটা বিজেপিকে মোকাবিলা করে গড়ে উঠছে, তার চেয়ে বেশি সৃষ্টি হয়েছে কংগ্রেসের ব্যর্থতার শূন্যতা থেকে। জুবীন নিজেও বলছেন, তাঁর প্রস্তাবিত মঞ্চ একই সঙ্গে কংগ্রেস ও বিজেপিকে মোকাবিলা করবে। স্বভাবত এই সংগীত তারকার হুমকিতে বিজেপির মতোই আসাম কংগ্রেসও কিছুটা উদ্বিগ্ন।
স্বাধীনতার পর থেকে জাতীয় কংগ্রেস বহু যুগ একচেটিয়াভাবে আসাম শাসন করেছে। এখন একদিকে হিন্দুত্ববাদী বিজেপির উত্থান, অন্যদিকে মুসলমানদের পছন্দের দল মাওলানা আজমলের ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের সক্রিয়তায় তারা কোণঠাসা। জুবীন তাই কেবল বিজেপিকে নয়, কংগ্রেসকেও বিপদে ফেলতে পারেন। এমনকি অসমিয়াপ্রধান দল অসম গণপরিষদও এই সমীকরণে ভোট হারাতে পারে। মানুষ তাদের বিজেপির মিত্র হিসেবেই দেখছে।
জুবীনের আবির্ভাব তাই আসামের জটিল রাজনীতিতে নতুন এক ‘পলিটিকস’! নাগরিকত্ব আইন আসামে অবিশ্বাস্য দ্রুততায় এক রাজনৈতিক শূন্যতা তৈরি করেছে। হয়তো পুরোনোদের দিয়ে সেই শূন্যতা পূরণ করা যাবে না আর। প্রশ্ন হলো, পুরো দক্ষিণ এশিয়ার ক্ষেত্রেও তা–ই ঘটতে চলেছে কি না। এত দিন রাজনীতি না করতে চাওয়া ‘জুবীন প্রজন্ম’ পুরো দক্ষিণ এশিয়ার ফ্যাসিবাদী লক্ষণগুলো রুখতে কতটা সমর্থ? বিরাজনীতিকরণের এত দিনকার স্মার্টনেসে কি তাদের মোহভঙ্গ হতে চলেছে? নাকি জাতিবাদী রাজনীতির নতুন স্ফুলিঙ্গ হয়ে উঠবে তারা?
আলতাফ পারভেজ: দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ইতিহাস বিষয়ের গবেষক