ন্যাটো কি আর টিকবে?
মার্কিন নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট ন্যাটোর ভবিষ্যৎ কী? ন্যাটোর ৭০ বছর পূর্তির মুখে দাঁড়িয়ে এই প্রশ্নের উত্তর সন্ধান করতে হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের স্নায়ুযুদ্ধের সময় ন্যাটোর কার্যকারিতা ছিল পুঁজিবাদী বিশ্বে। স্নায়ুযুদ্ধের অবসান, প্রতিদ্বন্দ্বী ওয়ারশ জোটের বিলোপ, ফলে এককেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থার উদ্ভব, পরবর্তী সময় বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাসবাদের উত্থান, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে ন্যাটোর নেতৃত্বে লড়াই, এককেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থা পাল্টে দিয়ে বহুকেন্দ্রিক হওয়ার চেষ্টা, ব্রিটেনের ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে যাওয়া, ন্যাটো সদস্যের কারও কারও বহুকেন্দ্রিক ব্যবস্থায় শরিক হওয়ার ইচ্ছা, সব মিলে ন্যাটোর ভবিষ্যৎ এখন আলোচনার খোরাক।
বিশ্বে একধরনের পরিবর্তনের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। ইতিবাচক ও নেতিবাচক দুই অর্থেই। চরিত্রের দিক থেকে একদিকে লোকরঞ্জনবাদীদের উত্থান ঘটছে। দেশে দেশে ছদ্ম ফ্যাসিবাদ গেড়ে বসছে। আবার তামাম দুনিয়ায় মানুষ পথে নামছে। লেবানন থেকে চিলি, হংকং থেকে ইরাক–ইরান, আলজেরিয়াসহ সর্বত্র শাসন কাঠামো, অথনৈতিক ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করে বিক্ষোভ হয়েছে। শাসক ও শোষিতের চিরন্তর লড়াই আরও একবার খুব নিকটবর্তী না হলেও আসন্ন, এটা অনুমান করা যায়। কাঠামোগত দিক থেকে বহু মেরুকেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থার আভাস পাওয়া যাচ্ছে। মোদ্দা কথা হচ্ছে, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিবর্তন বিশ্বে জোটগত রাজনীতিতেও পরিবর্তন আনবে।
নয়া বিশ্বব্যবস্থায় ন্যাটোর ভূমিকা কী হবে, গ্রহণযোগ্যতা ও কার্যকারিতা কতটুকু থাকবে, এসব নিয়ে আলাপ–আলোচনা হচ্ছে। এত দিন এই আলাপ গবেষক ও বিশেষজ্ঞদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু সম্প্রতি ন্যাটোর শীর্ষস্থানীয় দেশগুলোর মধ্যে এই ধারণা সঞ্চারিত হয়েছে। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ নভেম্বরের শুরুর ‘দ্য ইকোনমিস্ট’কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ন্যাটোর ‘ব্রেইন ডেথ’ হয়েছে বলে মন্তব্য করেন। মাখোঁ ন্যাটোর কোনো আশা দেখছেন না। এর আগে ন্যাটোর ব্যয়ভার বহন নিয়েও ফ্রান্স, জার্মানি ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে মতদ্বৈততার সৃষ্টি হয়। জার্মান চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল ন্যাটোতে নিরাপত্তা ব্যয় জিডিপির কমপক্ষে ২ শতাংশ করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের আহ্বানকে প্রত্যাখ্যান করে বলেছিলেন, ইউরোপ নিজেই তার নিরাপত্তার বিষয়টি দেখভাল করতে পারবে। যদিও জার্মানি ব্যয় বৃদ্ধির প্রস্তাব গ্রহণ করেছিল। ফ্রান্স আবার জার্মানির ব্যয় বৃদ্ধির প্রস্তাবে ভেটো দেয়। মূলত জার্মানি ও ফ্রান্স উভয়েই নিজস্ব নিরাপত্তার ক্ষেত্রে ন্যাটোর ওপর নির্ভরতা কমাতে চাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে যদিও ইউরোপকে বরাবরই ন্যাটোর পক্ষ থেকে রাশিয়ার উত্থান ও আগ্রাসনের বিষয়টি সতর্ক করা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে ইউক্রেনের ঘটনাও মনে করিয়ে দেওয়া হচ্ছে। তবে ফ্রান্স ও জার্মানি রাশিয়ার সঙ্গে কৌশলত অবস্থানে থেকে সম্পর্কে ভারসাম্য আনার চেষ্টা করতে পারে। কারণ, ইউরোপ প্রাকৃতিক গ্যাসের জন্য রাশিয়ার ওপর নির্ভরশীল।
ন্যাটোর বিভাজন হয়তো এখন আরও স্পষ্ট হবে না। কিন্তু ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) নিরাপত্তার জন্য আলাদা সেনাবাহিনী গঠন করবে কি না, এ বিষয়টি এখন বেশ জোরালোভাবেই আলোচিত হচ্ছে। ব্রিটেন যদি শেষ পর্যন্ত ইইউ থেকে বেরিয়ে যায়, তবে ইউরোপের অন্য দেশগুলোর নিজস্ব নিরাপত্তার জন্য পৃথক নিরাপত্তা বাহিনী গঠন সহজ হবে। ব্রিটেন ইইউতে নিরাপত্তার বিষয়গুলোতে ন্যাটোর পক্ষেই ওকালতি করেছে। তাই ইইউর পক্ষে স্বাধীনভাবে নিরাপত্তাবিষয়ক সিদ্ধান্ত নেওয়া কঠিন ছিল। কিন্তু ব্রিটেনবিহীন ইইউ নিরাপত্তার ক্ষেত্রে অনেকটাই স্বাধীন সিদ্ধান্ত নিতে পারবে বলে মনে করা হচ্ছে।
ন্যাটো প্রসঙ্গে ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে বিভক্তি এখন প্রকাশ্য। ফ্রান্স ও জার্মানিসহ পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলো বিভিন্ন বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করলেও পূর্ব ইউরোপের দেশগুলো ন্যাটোর প্রতি এখনো আস্থাশীল। স্লোভাকিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী মিরোস্লাভ লাইচাক সম্প্রতি বার্লিন সফরের সময় ন্যাটোতে কোনো বিভক্তি বা সংকট নেই বলে মন্তব্য করেন। বরং মাখোঁ বরাবরই বিতর্কিত মন্তব্য করে নিজ দেশেই আলোচিত বলে তিনি জানান। স্লোভাকিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ন্যাটোর সদস্যরা ৫ নম্বর আর্টিকেলের প্রতি এখনো অবিচল আছে। এখানেই মাখোঁ প্রশ্ন তুলেছেন। তিনি বলেছেন, সদস্যদেশগুলোর অনেকেই সম্মিলিতভাবে হুমকি মোকাবিলায় ৫ নম্বর আর্টিকেল অনুসরণ করছে না। এখানে তিনি তুরস্কের উদাহরণ দিয়েছেন। তুরস্ক ন্যাটোর সদস্য হাওয়ার পরও নিজস্ব নিরাপত্তার কথা বলে রাশিয়ার কাছ থেকে এস-৪০০ মিসাইল ক্রয় করছে। তুরস্ক এই মিসাইল আপাতত ইরান, জর্ডান বা সিরিয়ার বিরুদ্ধে ব্যবহার করবে না। যদি কখনো করে তবে তা ইসরায়েলের বিরুদ্ধেই ব্যবহার করতে পারে। আবার তুরস্কে ন্যাটোর মিসাইলও নিয়োজিত আছে। রাশিয়ার সঙ্গে এরদোয়ানের মাখামাখি চোখে পড়ার মতোই। উত্তর সিরিয়া অভিযানে তুরস্ক রাশিয়ার সঙ্গে অলিখিত সমঝোতা করেছে বলে মনে করা হচ্ছে।
ন্যাটোর ৭০ বছর পূর্তি উপলক্ষে লন্ডনে যাওয়ার আগে এরদোয়ান স্পষ্ট করেই বলেছেন, সিরিয়ার কুর্দিদের সন্ত্রাসী হিসেবে ঘোষণা না করলে ন্যাটোর বাল্টিক নিরাপত্তা পরকিল্পনায় ভেটো দেবে তুরস্ক। সিরিয়ায় অভিযান নিয়ে এদিকে তুরস্ক ও ফ্রান্সের দ্বন্দ্ব এখন তুঙ্গে। পরস্পর দোষারোপের মুখেই এরদোয়ান ও মাখোঁ লন্ডনে ন্যাটোর বৈঠকে যোগ দেন। সেখানে হয়তো তাঁদের কথাও হয়েছে। কিন্তু বরফ কতটা গলেছে, সে বিষয়ে সন্দেহ আছে।
রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বাস্তবতাই ন্যাটোভুক্ত দেশগুলোকে বিভিন্ন পথে ঠেলে দিচ্ছে। স্নায়ুযুদ্ধের বাস্তবতা এখন আর নেই। তাই সম্মিলিত নিরাপত্তার কথা বলে ন্যাটোর অনেক দেশই ব্যয়ের বোঝা বহন করতে রাজি নয়। ৯/১১–এর পর সম্মিলিত নিরাপত্তার বিষয়টি জোরালোভাবে অনুভূত হলেও সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক মন্দা, বেকারত্ব বৃদ্ধি, জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি, এসবের কারণে লোকরঞ্জনবাদীদের উত্থান ইউরোপের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর অন্যতম মাথাব্যথার কারণ। এ অবস্থায় ইউরোপের দেশগুলো নিরাপত্তার নামে ন্যাটোর ব্যয় কতটা বহন করতে পারবে, সেটাও দেখার বিষয়। আঞ্চলিক জোটও ন্যাটোর বিভাজনে ভূমিকা রাখছে। ব্রেক্সিট ইস্যুতে ফ্রান্স, জার্মানি একজোট। যুক্তরাষ্ট্র প্রকাশ্যে ব্রিটেনের ব্রেক্সিটপন্থীদের সমর্থন করছে। আফগানিস্তান, ইরাক ও সিরিয়া ইস্যুতে তুরস্ক ন্যাটোকে এড়িয়ে ইরান ও রাশিয়ার সঙ্গে একধরনের অলিখিত জোট করেছে। জলবায়ু কূটনীতিতে ইইউ চীন ও ভারতের সঙ্গে কাজ করতে আগ্রহী। যুক্তরাষ্ট্র প্যারিস চুক্তি থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নিয়েছে। ইইউ প্যারিস চুক্তির বাস্তবায়ন চায়। চীনের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক বৃদ্ধি, ইরান, রাশিয়া, সিরিয়াসহ বেশ কিছু বিষয়ে ন্যাটোর সদস্যদের মধ্যে বিভাজন রয়েছে। উত্তর সিরিয়ার অভিযান বিষয়েও ন্যাটোর দেশগুলো একমত হতে পারেনি।
ন্যাটো ঘরের ভেতরে ও বাইরে দুই জায়গাতেই সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছে। ন্যাটোর অভ্যন্তরে একধরনের অস্থিরতা, অস্বস্তি কাজ করছে। ফ্রান্স-স্লোভাকিয়া, ফ্রান্স-তুরস্কের মধ্যে বাগ্যুদ্ধ সেই অস্বস্তিরই প্রতিফলন। অপর দিকে ইরাক ও সিরিয়ায় ন্যাটো জোট ইরান, রাশিয়ার অলিখিত জোটের সঙ্গে শেষ পর্যন্ত পেরে ওঠেনি। ইউক্রেনেও ন্যাটো সফল হতে পারেনি। আফগানিস্তানেও তালেবানদের সঙ্গে সমঝোতা করতে হচ্ছে। আলোচনা শেষ বলেও আবার তালেবানদের সঙ্গে বৈঠকে বসেছে। দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের প্রভাব ক্রমেই বাড়ছে। তাই প্রশ্ন উঠছে ন্যাটো কি তার শক্তিশালী অবস্থান হারাচ্ছে? ইউরোপের ক্রমেই দূরে সরে যাওয়া, রাশিয়া ও চীনের উত্থান ন্যাটোকে ঠুঁটো জগন্নাথে পরিণত করবে কি?
ড. মারুফ মল্লিক, ভিজিটিং রিসার্চ ফেলো, ইনস্টিটিউট অব অরিয়েন্ট অ্যান্ড এশিয়ান স্টাডিজ, ইউনিভার্সিটি অব বন