বৈচিত্র্য মেনে নিতে হবে
প্রতিদিনই কোনো না কোনো নিপীড়নের খবর আমরা পাই। কখনো কাউকে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়। কাউকে গুলি করে হত্যা কিংবা আহত করা হয়। আমরা নানাভাবে ক্ষমতার চর্চা করি। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, শারীরিক, জাতিগত, ধর্মীয়, লৈঙ্গিক ক্ষমতাসহ নানা ধরনের ক্ষমতা ব্যবহার করে আমরা একে অন্যকে পীড়ন করি। কেউ হয়তো মৃত্যুর আগেই কয়েকবার মরে অসম্মান, অবহেলায়। কেউ কেউ আত্মহত্যা করে। আত্মহত্যার পেছনেও থাকতে পারে নানা ধরনের ভয়াবহ নিপীড়ন।
২০ নভেম্বর ছিল আন্তর্জাতিক ট্রান্সজেন্ডার দিবস। একজন ব্যক্তি নারীও নয়, পুরুষও নয়—এমন লিঙ্গীয় পরিচয়ের কারণেও নিপীড়নের শিকার হতে পারে। নারী-পুরুষ এই দ্বিবিভাজিত খোপের মধ্যে পড়ে না বলে পৃথিবীতে অনেক মানুষ হত্যার শিকার হয়েছে; কারণ তাদের লিঙ্গীয় পরিচয় হত্যাকারীদের কাছে অগ্রহণযোগ্য। নারী ও পুরুষের বাইরেও মানুষের নানা ধরনের লিঙ্গীয় পরিচয় আছে। কিন্তু তাদের পরিচিতি সংখ্যাগরিষ্ঠ নারী-পুরুষ অনেকেই মেনে নিতে পারে না। তাই তাদের ওপর নেমে আসে ভয়াবহ নিপীড়ন। লিঙ্গীয় ভিন্নতার কারণে যেসব মানুষকে হত্যা করা হয়েছে, তাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর জন্যই ছিল দিনটি।
আন্তর্জাতিক সংগঠন ট্রান্সরেসপেক্ট ভার্সাস ট্রান্সফোবিয়া ওয়ার্ল্ডওয়াইড-এর রিপোর্ট অনুযায়ী, শুধু এই ভিন্ন লিঙ্গ পরিচয়ের কারণে গত বছরের ২০ নভেম্বর থেকে এ বছরের ২০ নভেম্বর পর্যন্ত হত্যা করা হয়েছে ৩৩১ জন মানুষকে। এর আগের বছর এই সংখ্যা ছিল ৩৬৯। ২০০৮ সাল থেকে এ পর্যন্ত ৩ হাজার ৩১৪ জন লিঙ্গবৈচিত্র্যের মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। বেশির ভাগ দেশেই এই ঘটনাগুলো ঘটছে এবং এর সঠিক সংখ্যা কত আসলে বলা খুব কঠিন। কারণ, যাদের হত্যা করা হয়েছে এবং সে হত্যার ঘটনাগুলো আইনগতভাবে নথিভুক্ত হয়েছে শুধু সে হিসাব ধরেই এ গণনা হয়েছে। এর বাইরে অনেক হত্যাই আছে, যা নথিভুক্ত হয়নি বা করতে দেওয়া হয়নি।
লিঙ্গবৈচিত্র্যের কারণে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র থেকে নানা ধরনের নিপীড়ন, বৈষম্য এবং অসমতার শিকার হয়ে অনেকেই আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন। এই ঘটনাগুলো হত্যার হিসাবে আসেনি। তাই বলা যায় যে এদের প্রকৃত মৃত্যুর সংখ্যা আরও অনেক বেশি। আমাদের দেশের লিঙ্গবৈচিত্র্যের মানুষদের আমরা অবহেলার চোখে দেখি, অশ্রদ্ধা করি, বৈষম্য করি, ভয় পাই। কেন?
এর মূল কারণ আমরা ভিন্নতাকে ‘অস্পৃশ্যতা’ মনে করি। তৃতীয় লিঙ্গের মানুষকে অস্পৃশ্য ভাবার ফলে আমরা তাদের প্রতি অসহিষ্ণু। অন্যদিকে যৌনতা, লিঙ্গবৈচিত্র্য ইত্যাদি নিয়ে আমাদের সমাজে আলাপ-আলোচনার ক্ষেত্রে অস্বস্তি ও আড়ষ্টতা কাজ করে। একাডেমিক জগতেও বিষয়টি নিয়ে বেশি আলোচনা হয় না। এই আলাপ–আলোচনার অভাবের ফলেও এ দেশে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের বিষয়ে অনেক ভ্রান্ত ধারণা দূর হতে পারছে না।
বাংলাদেশ সরকার ২০১৩ সালে এই মানুষদের ‘হিজড়া লিঙ্গ’ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। সরকারি সংজ্ঞানুযায়ী ‘এরা জন্মগতভাবে যৌন প্রতিবন্ধী ব্যক্তি, যাদের দৈহিক বা জেনেটিক কারণে নারী-বা পুরুষ কোনো শ্রেণিতে অন্তর্ভুক্ত করা যায় না এবং সমাজে এই জনগোষ্ঠী হিজড়া হিসেবে পরিচিত।’ এটি একটি ভুল সংজ্ঞা। ‘হিজড়া’ কোনো পরিচিত নয়, এটি একটি সংস্কৃতি। এই সংস্কৃতিতে কোনো কোনো লিঙ্গীয় বৈচিত্র্যের মানুষ বেড়ে ওঠে।
লিঙ্গবৈচিত্র্য সম্পর্কে রাষ্ট্রের এই ভুল ধারণা সাধারণ মানুষের ভ্রান্ত ধারণা দূর করার অন্তরায়। এর কারণে অনেক ইতিবাচক কর্মসূচি সফল হতে পারে না। যেমন, সরকার ট্রাফিক পুলিশ নিয়োগের ক্ষেত্রে কয়েকজন লিঙ্গীয় বৈচিত্র্যের মানুষকে নির্বাচন করেছিল। পরে তঁাদের ডাক্তারি পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয় এবং ডাক্তাররা রায় দেন যে তাঁরা ‘পুরুষ’, হিজড়া নন। তার মানে হলো এই লিঙ্গীয় বৈচিত্র্যের মানুষ সম্পর্কে সরকারি যে ভ্রান্ত বোঝাপড়া আছে, সেটিকেই মানদণ্ড মনে করা হয়েছে।
পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে এ বিষয়ে ধারণা ও বোঝাপড়া স্পষ্ট করতে হবে। একজন সন্তান নারী-পুরুষের বাইরেও ভিন্ন লিঙ্গীয় পরিচয়ের হতে পারে এবং এতে তাঁর নিজের কোনো ভূমিকা নেই। পরিবারকে এই বৈচিত্র্য মেনে নিতে হবে। তার সব অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। সন্তানকেও এই নির্ভরতার জায়গা দিতে হবে যে বৈচিত্র্য কোনোভাবেই তার প্রতিবন্ধকতা নয়, বরং বৈচিত্র্যই অহংকার। আর পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে বৈচিত্র্য ও ভিন্নতাকে সম্মান দিতে পারলেই আমরা এ ধরনের নিপীড়ন বন্ধ করতে পারব।
জোবাইদা নাসরীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক
[email protected]