২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

বিএনপিতে পদত্যাগ, অনাস্থা

মোরশেদ খান (বাঁয়ে) ও মাহবুবুর রহমান
মোরশেদ খান (বাঁয়ে) ও মাহবুবুর রহমান

সম্প্রতি দুজন জ্যেষ্ঠ নেতাসহ বিএনপির অন্তত ছয়জন নেতা দল থেকে পদত্যাগ করেছেন বলে খবর প্রকাশিত হয়েছে। পদত্যাগকারী নেতাদের মধ্যে আছেন সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও বর্তমানে দলের ভাইস চেয়ারম্যান মোরশেদ খান, দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান, সিলেটের মেয়র ও দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য আরিফুল হক। সিলেটের আরও তিনজন স্থানীয় নেতাও পদত্যাগ করেছেন। আওয়ামী লীগ নেতাদের দাবি, বিএনপি থেকে আরও অনেক নেতা পদত্যাগ করবেন।

এক সময় বিরোধী দল থেকে বড় কোনো নেতা পদত্যাগ করলে জল্পনা চলত তিনি সরকারি দলে যোগ দেবেন। বিশেষ করে জিয়া এরশাদের আমলে এর বহু নজির আছে। কিন্তু এখন বিরোধী দলের কোনো নেতা পদত্যাগ করে সরকারি দলে যাবেন, সেই পরিবেশ ও সম্ভাবনা কোনোটাই নেই। 

প্রথমত একটানা প্রায় ১১ বছর ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগে নেতার অভাব নেই। দ্বিতীয়ত আওয়ামী লীগ নিজেই ‘অনুপ্রবেশকারী’ আতঙ্কে আছে।

তাহলে বিএনপি থেকে বড় বড় নেতারা কেন পদত্যাগ করছেন? এর মধ্যে এমন নেতাও আছেন, যিনি বিএনপির দুঃসময়ে সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে জয়ী হয়ে দলকে ভরাডুবি থেকে রক্ষা করেছেন। বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের সঙ্গে মেয়র আরিফের দ্বন্দ্ব অনেক পুরোনো। কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব তাদের ঘোষিত নীতি অনুযায়ী তাঁকে জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে মিলেমিশে কাজ করার ‘সুপরামর্শ’ দিয়ে এসেছে। কিন্তু তিনি কোনোভাবেই জামায়াতের সঙ্গে গলাগলি করতে রাজি নন। ফলে বিগত সিটি নির্বাচনে আরিফুল হক একই সঙ্গে আওয়ামী লীগের বদরুদ্দিন আহমদ কামরানের পাশাপাশি জামায়াতের প্রার্থীর বিরুদ্ধে লড়াই করে জিতে আসতে হয়েছে। নির্বাচনের পরও তিনি জামায়াতবিরোধী অবস্থান অটুট রেখেছেন।
অন্যদিকে সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের সঙ্গে সদ্ভাব রেখে চলায় বিএনপির নীতিনির্ধারকদের কেউ কেউ তাঁর প্রতি নাখোশ ছিলেন। কিন্তু আরিফুল হকের যুক্তি হলো তিনি যা করেছেন, নগরবাসীর কল্যাণের জন্যই। সিলেটের অপর তিন নেতা তাঁকে অনুসরণ করেছেন মাত্র।

তবে বিএনপিতে এখন বেশি আলোচনা হচ্ছে মোরশেদ খান ও মাহবুবুর রহমানের পদত্যাগ নিয়ে। দলের পক্ষ থেকে মোরশেদ খানের পদত্যাগের কথা স্বীকার করলেও মাহবুবের বিষয়টি স্বীকার করা হয়নি। মাহবুব পদত্যাগপত্র দিয়েছিলেন ব্যক্তিগতভাবে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের কাছে, যিনি তাঁর স্ত্রীর ভাই।

বিএনপির নেতারা মনে করেন, মোরশেদ খান দীর্ঘদিন রাজনীতিতে নিষ্ক্রিয় আছেন। তাদের এ দাবি আংশিক সত্য। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর তিনি ব্যবসায়িকভাবে নানা সমস্যায় আছেন, এটি যেমন সত্য, তেমনি অসত্য নয় দলের নেতৃত্বের সঙ্গে তাঁর দূরত্ব তৈরি হওয়া। মহাসচিবের কাছে পাঠানো পদত্যাগপত্রে মোরশেদ খান লিখেছেন, ‘রাজনীতির অঙ্গনে আমার পদচারণা দীর্ঘকালের। কিন্তু দেশের রাজনীতি এবং দলের অগ্রগতিতে নতুন কিছু সংযোজন করার মতো সংগতি নেই। তাই ব্যক্তিগত কারণহেতু আমার উপলব্ধি সক্রিয় রাজনীতি থেকে অবসর নেওয়ার এখনই সময়।’

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে চট্টগ্রাম-৮ আসনে মনোনয়ন না পাওয়ায় দলের প্রতি ক্ষুব্ধ ছিলেন মোরশেদ খান। সেখানে মহানগর বিএনপির সিনিয়র সহসভাপতি ও চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা বিএনপির আহ্বায়ক আবু সুফিয়ানকে মনোনয়ন দেওয়া হয়। এর বাইরে চট্টগ্রামে দলের রাজনীতিতে তার অনুসারীদের বিভিন্ন পদ থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা বিএনপির আহ্বায়ক করা হয় সুফিয়ানকে। এসব নিয়ে দলের শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গে মোরশেদ খানের দূরত্ব তৈরি হয়।

নির্বাচনের পর প্রথম আলোর সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে মাহবুবুর রহমান বলেছিলেন, ‘যদি দলের নেতৃত্ব দিতে হয়, তারেক রহমানকে দেশে এসেই নেতৃত্ব দিতে হবে। বিএনপি আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি বলেই নির্বাচনে জয়ী হতে পারেনি। আমরা যদি জিয়ার চিন্তা-চেতনায় বিশ্বাস করি, তাহলে হতাশ হওয়ার কোনো কারণ নেই। তাঁকে নেতা মানলে তাঁর নীতি ও আদর্শও মেনে চলতে হবে।’ জামায়াতের সঙ্গে জোট করার বিরোধিতা করে তিনি বলেন, বিএনপি একটি জাতীয়তাবাদী দল। এই দল কেন জামায়াতের সঙ্গে ঐক্য করবে? বিএনপির উচিত জামায়াতের সঙ্গে জোটগত সম্পর্ক ছিন্ন করা।

বিএনপির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতা জানান, লন্ডনে এক সভায় ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান (তারেক রহমান) জিয়াউর রহমানকে বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদী জাতির পিতা আখ্যা দিয়ে এর সমর্থনে নেতা কর্মীদের কাছে প্রস্তাব রাখেন। এ সময় সভায় উপস্থিত নেতা কর্মীরা তারেক রহমানের প্রস্তাব কণ্ঠভোটে সমর্থন করেন। পরে বিষয়টি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে উঠে এলে এ বিষয়ে দ্বিমত প্রকাশ করে গণমাধ্যমে বক্তব্য দেন মাহবুবুর রহমান।

সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি দলের স্থায়ী কমিটির এক বৈঠকে চারজন নেতা মাহবুবুর রহমানের দ্বিমত করার বিষয়টি উত্থাপন করেন। এ নিয়ে ওই বৈঠকে দীর্ঘক্ষণ আলোচনা হওয়ার পর সিদ্ধান্ত হয়, মাহবুবুর রহমান যেন তাঁর দ্বিমতের বক্তব্যের বিষয়ে লিখিতভাবে দুঃখ প্রকাশ করেন। দু’দিন পর এ বিষয়ে জানতে স্থায়ী কমিটির এক সদস্য মাহবুবুর রহমানের বাসায় গেলে তিনি তাঁর দ্বিমত পোষণের বক্তব্যে অনড় থাকার কথা জানিয়ে দেন। এরপরই তিনি পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নেন। এটি দলীয় নেতৃত্বের প্রতি অনাস্থাও বটে।

বিগত কয়েক বছরে জ্যেষ্ঠ নেতাদের মধ্যে ভাইস চেয়ারম্যান শমসের মবিন চৌধুরী, মোসাদ্দেক আলীর বিএনপির ত্যাগের কারণ তারেক রহমানের সঙ্গে মতভেদ। ওই পদত্যাগী নেতাদের একজন ব্যক্তিগত আলাপে এই লেখককে বলেছিলেন, ‘তারেক রহমান দলে থাকলে আমি বিএনপি করব না।’ তখনো খালেদা জিয়া জেলের বাইরে এবং তারেক রহমান ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেননি। বিএনপিতে এই ধরনের মনোভাব পোষণ করেন, এ রকম নেতা আরও আছেন। তাঁরা মনে করেন, ২০০৭সালের বিএনপির বিপর্যয়ের জন্য যিনি প্রধানত দায়ী তাঁর নেতৃত্বে আর যাই হোক বিএনপিকে এগিয়ে নেওয়া যাবে না।

কিন্তু সমস্যা হলো দলের প্রধান কারাবন্দী খালেদা জিয়া এখনো বিএনপিতে তারেক ছাড়া আর কারও ওপর ভরসা করতে পারছেন না।

সোহরাব হাসান: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
[email protected]