যৌন ও প্রজনন-স্বাস্থ্য শিক্ষা: কৈশোর ও তারুণ্যের অধিকার
>গত ২০ অক্টোবর ২০১৯, প্রথম আলোর আয়োজনে এবং ইউনাইটেড ফর বডি রাইটস ও কিংডম অব নেদারল্যান্ডসের সহযোগিতায় ‘যৌন ও প্রজনন–স্বাস্থ্য শিক্ষা কৈশোর ও তারুণ্যের অধিকার’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। আলোচকদের সংক্ষিপ্ত বক্তব্য আজ ১ নভেম্বর জাতীয় যুব দিবস উপলক্ষে এই ছাপা হলো।
সূচনা বক্তব্য
আব্দুল কাইয়ুম: সহযোগী সম্পাদক, প্রথম আলো
সঞ্চালক
ফিরোজ চৌধুরী: সহকারী সম্পাদক, প্রথম আলো
আলোচনায় সুপারিশ
• যৌন ও প্রজনন–স্বাস্থ্য সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণা দূর করতে এই প্রজন্মকে বিজ্ঞানভিত্তিক তথ্য দিতে হবে
• শিক্ষক প্রশিক্ষণ কারিকুলাম ও বিএড কোর্সে জেন্ডার, যৌন ও প্রজনন–স্বাস্থ্য অধিকার শিক্ষা অন্তর্ভুক্ত করা
• জেএসসি ও জেডিসি পরীক্ষায় শারীরিক শিক্ষা স্বাস্থ্য অন্তর্ভুক্ত করলে শিক্ষার্থীরা এ বিষয়ে গুরুত্ব দিয়ে জানবে
• যৌন নির্যাতন প্রতিরোধে স্কুলে শারীরিক শিক্ষা বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে
• সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন উদ্যোগের মধ্যে সমন্বয় করতে হবে
• কারিকুলাম বাস্তবায়ন ও অংশগ্রহণমূলক করতে শিক্ষা–প্রশিক্ষণসহ প্রয়োজনীয় শিক্ষা উপকরণ সরবরাহ করা প্রয়োজন
• তৃতীয় লিঙ্গ ও শারীরিক-মানসিক প্রতিবন্ধী কিশোর–কিশোরীদের বিবেচনায় রেখে কারিকুলাম তৈরি করা দরকার
• যৌন নির্যাতন প্রতিরোধে স্কুলে শারীরিক শিক্ষা বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে
• শিক্ষা ক্ষেত্রে শারীরিক শিক্ষার পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ্যসেবা প্রয়োজন
আলোচনা
আব্দুল কাইয়ুম
আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় কিশোর ও তরুণদের যৌন ও প্রজনন–স্বাস্থ্য শিক্ষায় খুব বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয় না। এর ফলে একটা নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। কেননা কিশোর-কিশোরীরা সচেতন থাকে না। অনেক বিষয় সম্পর্কে তারা জানতে পারে না। অথচ এটা এমন কোনো বিষয় না যে খোলামেলা আলোচনা করা যাবে না। অনেক পরিবারই এসব বিষয়ে আলোচনা করতে সংকোচবোধ করে।
পাঠ্যবইয়ে এসব বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। কিন্তু যৌন প্রজনন–স্বাস্থ্যের অধ্যায় এলেই অনেক শিক্ষক বিষয়টি বাড়িতে পড়ে নিতে বলেন। কীভাবে এর সমাধান করা যায়, তা নিয়েই আজকের আলোচনা।
রাশেদা কে চৌধূরী
যৌন ও প্রজনন–স্বাস্থ্য শিক্ষা কিশোর-তরুণদের অধিকারের জায়গা থেকে দেখলে অনেক বিষয় এসে যায়। একটা হলো এগিয়ে যাওয়ার কিছু জায়গা অন্যটি হলো আমাদের চ্যালেঞ্জ ও প্রতিকারের জায়গা।
যেকোনো উন্নয়নকাজেই চ্যালেঞ্জ থাকতে পারে। আমি একটি জায়গায় দৃষ্টি আকর্ষণ করব। বাংলাদেশের মেয়েদের কি আসলে কৈশোর বলে কিছু আছে? একটি কিশোরকে যতটুকু গুরুত্ব দেওয়া হয়, একজন কিশোরীকে ততটুকু গুরুত্ব দেওয়া হয় না।
কিশোর বয়সের সমস্যা ও সম্ভাবনা দুটোই আলোচনা করা দরকার। আমরা বেশ কিছু সংগঠন মিলে মাঠপর্যায় থেকে এ–সংক্রান্ত কিছু তথ্য সংগ্রহ করেছিলাম। এসবের বেশির ভাগই ছিল কিশোর-কিশোরীদের চিন্তাভাবনাসংক্রান্ত।
কল্লোল চৌধুরী
১০ থেকে ১৯ বছর বয়সের জনগোষ্ঠী মোট জনসংখ্যার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ। বর্তমানে বাংলাদেশের মেয়েদের বিয়ের গড় বয়স ১৬ দশমিক ১ বছর। ২০ বছরের কম বয়সীদের ক্ষেত্রে প্রতি ১ হাজার নবজাতকের জন্মদানে ৩১ জনের মৃত্যু হয়।
কিশোরীরা নিজ পরিজন দ্বারা এমনকি বিবাহিত নারীরা স্বামীর দ্বারা যৌন নির্যাতনের শিকার হন। যৌন ও প্রজনন–স্বাস্থ্য অধিকারের ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য ও আর্থসামাজিক কিছু ঝুঁকি রয়েছে।
এগুলো হলো বাল্যবিবাহ, অল্প বয়সে গর্ভধারণ, পুষ্টি ব্যবস্থার অপর্যাপ্ততা, অর্থনৈতিক নিরাপত্তা না থাকা ইত্যাদি। ইউনাইট ফর বডি রাইটস কিশোর–কিশোরী ও যুব জনগোষ্ঠীকে নিয়ে বর্তমানে ১২টি উপজেলায় কাজ করছে।
পাঠ্যক্রমে থাকলেও জেএসসি ও জেডিসি পরীক্ষায় প্রজনন–স্বাস্থ্য শিক্ষার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত হয় না বলে বিদ্যালয়ে এর গুরুত্ব কমে আসছে। সঠিক ও বিজ্ঞানসম্মত তথ্য না জানার ফলে কিশোর–কিশোরীরা বিভ্রান্তিতে ভোগে।
শিক্ষক প্রশিক্ষণ কারিকুলামে যৌন ও প্রজনন–স্বাস্থ্যসেবা অধিকার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। সাধারণ শিক্ষা, মাদ্রাসা, কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষায়ও যৌন ও প্রজনন–স্বাস্থ্য এবং অধিকার বিষয়টি রাখতে হবে।
প্রজনন–স্বাস্থ্যে শারীরিক বিষয় ছাড়াও মানসিক দিকও রয়েছে। শিক্ষকদের কাউন্সিলিং বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিলে বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মনো-সামাজিক সহায়তা প্রদানে ভূমিকা রাখতে পারেন।
মাশফিকা জামান সাটিয়ার
যৌন ও প্রজনন–স্বাস্থ্য শিক্ষা পাওয়া আমাদের সবার অধিকার। এটা মানবাধিকার, যেটা প্রত্যেকেরই পাওয়া উচিত। আমাদের তরুণদের জীবনকে সুস্থ ও স্বাভাবিক করাটা খুব জরুরি। কারণ, তাদের ওপর অনেক গুরুদায়িত্ব। আমাদের বর্তমান অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য বাংলাদেশকে ‘এশিয়ার টাইগার’ বলা হচ্ছে। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে তরুণদের কাজে লাগাতে হবে। সে জন্য তাঁদের গুণগত মানসম্পন্ন ও জীবনমুখী শিক্ষা দেওয়া খুব জরুরি।
আমাদের প্রজন্ম ছিল বইকেন্দ্রিক। যথেষ্ট ব্যবহারিক জ্ঞান না থাকায় আমাদের অনেক বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছিল।
বাংলাদেশের শিক্ষার এই ধরন পরিবর্তন হওয়া খুব জরুরি। জীবন দক্ষতাভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থা হওয়া জরুরি। একজন মানুষ নিজে সুস্থ না থাকলে তিনি তঁার পরিবার, সমাজ ও দেশের জন্য কীভাবে কাজ করবেন।
সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনের জন্য স্বাস্থ্য অধিকার নিশ্চিত করা জরুরি। সে ক্ষেত্রে যৌন ও প্রজনন অধিকার সম্পর্কে সহযোগিতা না পেলে তাঁরা কোনো ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পারবেন না।
মানসিক স্বাস্থ্যকেও আমরা গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করি। বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে আমাদের আইন রয়েছে। এসব আইনের প্রয়োগে আমরা কিছু প্রতিবন্ধকতা পাচ্ছি। এসব আইন ও নীতিমালা যেন ভালোভাবে প্রয়োগ করা হয়।
ইউ এম হাবিবুন নেসা
ইউনাইট ফর বডি রাইটস কথাটা শুনলেই সবাই চমকে ওঠে। এ কর্মসূচির মাধ্যমে তিন শতাধিক যুবার সঙ্গে আমি কথা বলার সুযোগ পেয়েছি। এ ছাড়া নারীপক্ষের অন্য কর্মসূচির মাধ্যমে আমরা যুবদের সঙ্গে কথা বলেছি।
এখনকার কিশোর–কিশোরীরা অনেক খোলামেলাভাবে বলতে পারে, যা আমাদের সময় ছিল না। এরা পরবর্তী প্রজন্মকে নেতৃত্ব দেবে। তারা তাদের শিশুকে জন্মের পরপরই শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ নাক, কান ইত্যাদি সম্পর্কে শেখাবে।
আমরা যে রকম লজ্জা পেতাম, তারা সে রকম লজ্জা পাবে না। সেই সাহস ইউনাইট ফর বডি রাইটস তাদের দিয়েছে। তাই আমি স্বপ্ন দেখছি যে চিন্তাচেতনার দিকে দিন দিন বড় পরিবর্তন আসবে।
নব্বইয়ের দশকের গোড়ার দিকে নারীপক্ষ বলেছিল, ‘শরীর আমার সিদ্ধান্ত আমার’।
২০১২-১৩ সালের দিকে আমরা যৌন ও প্রজনন–স্বাস্থ্য নিয়ে একটি গবেষণা করেছিলাম। বাংলা, ইংরেজি ও মাদ্রাসা কারিকুলাম গবেষণাটি করা হয়েছিল। বইয়ের যৌন ও প্রজনন–স্বাস্থ্যসংক্রান্ত অধ্যায়টি শিক্ষকেরা পড়ান না।
তাঁরা বাড়ি থেকে পড়ে আসতে বলেন। পরীক্ষায় এ–সংক্রান্ত প্রশ্ন করা হলে শিক্ষকেরা বাধ্য হতেন পড়াতে এবং বাচ্চারাও পড়ত। ফলে তাদের জড়তা কেটে যেত। নিজের যৌন ও প্রজনন অঙ্গ চেনা, এটাকে সুস্থ রাখা সবার অধিকার। নারীর দেহের সঙ্গে সম্ভ্রমের কোনো সম্পর্ক নেই।
নূর মোহাম্মদ
আজকের বিষয় হলো যৌন ও প্রজনন–স্বাস্থ্য শিক্ষা কৈশোর ও তারুণ্যের অধিকার। আমি অধিকার বিষয়টির ওপর গুরুত্ব দিতে চাই। আমরা কিশোর-তরুণদের অধিকারের কথা বলছি। কিন্তু প্রায়ই আমরা তাদের বলি, বড় হও, শিখে ফেলবে। এই বেড়ে ওঠার মধ্যেই সে অনেক সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে।
যৌন ও প্রজনন–স্বাস্থ্য অধিকার এমন যে সে যখন বেড়ে ওঠে, তখন তার মনে অনেক প্রশ্ন আসে। সে বুঝতে পারে না যে কোথায় গেলে এসবের উত্তর পাবে। বইয়ে যেটুকু তথ্য আছে, তা পড়ানো হচ্ছে না।
মা–বাবার কাছ থেকে জানতে চাইলে বলেন, চুপ করো, সময়ে জানতে পারবে। তাদের এসব বিষয় জানতে দিতে হবে। ইউনিসেফ ২০১৭ সালে একটা গবেষণা (স্টাডি) করেছিল।
গবেষণায় এসেছে ১৮ বছরের আগে ৫৫ শতাংশ মেয়ের বিয়ে হচ্ছে। এর মধ্যে ২২ শতাংশের বিয়ে হয় ১৫ বছরের আগে। তাদের সংসারজীবনে ঠেলে দিচ্ছি। অথচ কোনো তথ্য জানতে দিচ্ছি না।
এটা একধরনের পরিহাস। তাদের তথ্য জানার অধিকার আছে। ঠিক তেমনি সমস্যা জানার পর সেবা পাওয়ার অধিকারও রয়েছে। কিশোর-তরুণদের এসব তথ্য জানার সুবিধা দিতে হবে।
মনিমুক্তা ইসলাম
আমি ইউনাইটেড ফর বডি রাইটস কর্মসূচিতে যুক্ত। এখানে যুক্ত হওয়ায় যৌন ও প্রজনন–স্বাস্থ্যবিষয়ক অনেক বিষয় সম্পর্কে জানতে পারি। এ–সংক্রান্ত বিভিন্ন প্রশিক্ষণ পাই। যেগুলো আমি আমার বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করি। যৌন ও প্রজনন–স্বাস্থ্য বিষয়ে নিজে সচেতন হই এবং অন্যদের সচেতন করতে পারি।
আমার এক বান্ধবীর অল্প বয়সে বিয়ে হয়। অল্প বয়সে বিয়ে হওয়ায় এবং তার পরিবার রক্ষণশীল হওয়ায় সে পরিবার পরিকল্পনার বিষয়ে আলোচনা করতে পারে না। তারপর সে নিজে পরিবার পরিকল্পনার বিভিন্ন পদ্ধতি গ্রহণ করতে থাকে।
কয়েকবার ইমার্জেন্সি পিল খায়। পরবর্তী সময়ে খাবার নিয়ম না জেনেই নিয়মিত জন্মবিরতিকরণ পিল খায়। কিছুদিন সেবনের পর সে অসুস্থ অনুভব করে। সে সেটা খাওয়া বন্ধ করে দেয় এবং তার মাসিক অনিয়মিত হয়ে যায়। অনিয়মিত মাসিক দীর্ঘদিন চলার ফলে তার জরায়ু সংক্রমিত হয়। এরপর ইউবিআর পরামর্শক থেকে পরামর্শ নিয়ে সে এখন সুস্থ আছে।
আমাদের সমাজে ১২-১৩ বছর বয়স হলেই বিয়ের বয়স হয়েছে বলে ধরা হয়। কিন্তু যৌন ও প্রজনন–স্বাস্থ্য সম্পর্কে যেসব তথ্য আমাদের জানা দরকার, তা আমরা জানতে পারি না।
শিক্ষকেরা পাঠ্যবইয়ের এ–সংক্রান্ত অধ্যায়টি এড়িয়ে যান। আগে থেকে যৌন ও প্রজনন–স্বাস্থ্য সম্পর্কে জানা থাকলে অনেক ঝুঁকি থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।
মো. আল আমিন
প্রচলিত ধারণা ও কুসংস্কারের কারণে মেয়েরা নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। আমারা সাধারণত সিনেমা, নাটকে মেয়েদের উত্ত্যক্ত করতে দেখি। অনেক তরুণ এর মাধ্যমে প্রভাবিত হয়। এসব ধারণা ও কুসংস্কার দূর করতে হলে যৌন ও প্রজনন–স্বাস্থ্য শিক্ষা প্রয়োজন। এসব বিষয় নিয়ে দুই বছর ধরে কাজ করায় আমি এর প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করতে পেরেছি।
কিন্তু আমরা এই শিক্ষাগুলো কোথা থেকে পাব? তরুণ বয়সে শিক্ষার্থীরা যদি এসব সম্পর্কে না জানতে পারে, তাহলে তারা সমাজ পরিবর্তন করতে পারবে না।
প্রাতিষ্ঠানিকভাবে যৌন ও প্রজনন–স্বাস্থ্য সম্পর্কে জানার অধিকার সবার আছে। সে জন্য যৌন ও প্রজনন–স্বাস্থ্য সম্পর্কে সবাইকে জানতে দিতে হবে।
জুলিয়া আহমেদ
আমি যৌন ও প্রজনন–স্বাস্থ্য শিক্ষার চ্যালেঞ্জগুলোর ওপর গুরুত্ব দিতে চাই। যৌন ও প্রজনন–স্বাস্থ্য—দুটো বিষয়ই খুব সংবেদনশীল। অথচ স্বাস্থ্য ও শিক্ষার ক্ষেত্রে এটা সেভাবে আলোচনা হচ্ছে না।
স্কুলের শিক্ষকেরা বিষয়গুলো জানেন কিন্তু তাঁদের পারদর্শিতার ক্ষেত্রে কিছু অসুবিধা রয়েছে। কারণ, আমাদের প্রশিক্ষণগুলো সেভাবে সাজানো হচ্ছে না।
কিছু কিশোর কেন্দ্র করা হয়েছে। কিন্তু এসব কেন্দ্রে কিশোর-কিশোরীরা যাচ্ছে না। ওদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে যে কেন্দ্রগুলো তাদের উপযোগী করে করা হয়নি।
আলোচনায় এসেছে অনেকেই পরিবার পরিকল্পনার কথা জানেন না। কোনো পদ্ধতি নিতে পারছেন না। তাই এই তথ্যগুলো সবাইকে জানাতে হবে।
রোকেয়া কবীর
আলোচনায় কিছু সমস্যা ও সমাধানের কথা এসেছে। অনেক দিন ধরে কাজ করে পাঠ্যপুস্তকে ধীরে ধীরে এ–সংক্রান্ত বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। কিন্তু শিক্ষকেরা পড়ান না। আমাদের মানসিকতায় কিছু পরিবর্তন আনতে হবে।
|
মূল সমস্যা হলো, আমরা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করছি যারা, তারা বেশির ভাগই ষাট-সত্তরোর্ধ্ব। অনেক পুরোনো চিন্তাভাবনা নিয়ে আমরা আজকের প্রজন্মের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করছি।
বডি রাইটসের কথা বললে অনেকেই নারীবাদী বলেন। আশির দশকের শেষের দিকে আমি নারীবাদী কি না, তা অনেকে জানতে চাইতেন। যৌন প্রজনন অঙ্গ কেবল মা-বাবা হওয়ার জন্য প্রয়োজন নয়। এটা হরমোন ও শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া নির্ধারণ করে।
তাই এটাকে সেদিক থেকেও আমাদের দেখতে হবে। বেসরকারি সংস্থার ব্যক্তিদের কাজ হচ্ছে বিভিন্নভাবে সচেতনতা তৈরি করা।
সালেহ আহমেদ
আমাদের দেশে তরুণের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ। এর মধ্যে একটা অংশ ভিন্ন যৌন পরিচয়ের (তৃতীয় লিঙ্গ)। এই মানুষগুলো আমাদের দেশের মানুষ। আমাদের তরুণ জনগণের মধ্যেই তাঁরা আছেন। কিন্তু কেন জানি তাঁদের নিয়ে কথা বলতে আমরা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি না। কিছুদিন আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের সঙ্গে আমরা হিজড়াদের নিয়ে একটি গবেষণা করেছি।
সেখানে এসেছে যে এদের বড় একটা অংশ মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগছে। এদের মধ্যে হতাশার পরিমাণ এত বেশি যে তাদের আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়ে গেছে। তাদের কিছু বিশেষ চাহিদা আছে, যেগুলো অপূর্ণ রয়ে যায়। এই জায়গা নিয়ে আমরা একদমই কথা বলি না। ২০১৩ সালের শেষ নাগাদ বাংলাদেশ সরকার হিজড়া জনগোষ্ঠীকে তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।
প্রকাশিত গেজেটে হিজড়া কারা, সে বিষয়ে কোনো উপযুক্ত ব্যাখ্যা দেওয়া হয়নি।
সরকারি বিভিন্ন কাজে তৃতীয় লিঙ্গ পরিচয় নির্ধারণে অসামঞ্জস্যতা রয়েছে। দাপ্তরিক কাজে কোন শব্দটি (হিজড়া, তৃতীয় লিঙ্গ ও অন্যান্য) ব্যবহার হবে, তা ঠিক করে দিতে হবে।
সাবিনা ফয়েজ রশিদ
আলোচনায় অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এসেছে। পাঠ্যপুস্তকে যৌন ও প্রজনন শিক্ষা সম্পর্কিত বিষয়টি বারবার এসেছে। যৌন ও প্রজনন–স্বাস্থ্য বিষয়টি জীববিজ্ঞান সম্পর্কিত।
কিশোর-কিশোরীদের অনেক রকমের আবেগময়, সামাজিক ও মানসিক স্বাস্থ্যসংক্রান্ত সেবার প্রয়োজন রয়েছে। আমরা দেখেছি কিশোর-কিশোরীরা তাদের জীবনের কথা বলার সময় উত্ত্যক্তকরণ, যৌন হয়রানি ও সম্পর্ক প্রত্যাখ্যান নিয়ে কথা বলে।
ছেলে ও মেয়ে উভয়ের মধ্যে এ বিষয়টি লক্ষ করা যায়। কিশোর হওয়ার সামাজিক ও মানসিক দিক বিবেচনায় রাখা গুরুত্বপূর্ণ। মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়টি বিশ্বব্যাপী আলোচিত হচ্ছে। যৌন সক্রিয়তা ও ধূমপানকে অনেক ছেলেই সামর্থ্যবান পুরুষের প্রতীক মনে করে। অনেক মেয়ে চুপচাপ থাকাকে ভালো মেয়ের লক্ষণ মনে করে।
ইভ টিজিং বলে কোনো কিছু নেই। এটা হলো যৌন হয়রানি। ছেলেদের মাধ্যমে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে মেয়েদের ওপর। এটা মূলত বোঝার অভাবে হচ্ছে।
মেয়েদের সঙ্গে যে রকম কথা বলছি, ছেলেদের সঙ্গেও সে রকম কথা বলতে হবে। তা না হলে মেয়েদের ওপর দ্বিগুণ বোঝা দেওয়া হয়।
যৌন ও প্রজনন শিক্ষার পাশাপাশি তাদের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কথা বলতে হবে। কিশোর-কিশোরীদের কাছে পৌঁছাতে সোশ্যাল মিডিয়া, ইউটিউব, ভিডিও, কার্টুন ও বিকল্প চ্যানেলগুলোর ব্যবহার বাড়াতে হবে।
আলতাফ হোসেন
যৌন অধিকার মানবাধিকারের একটি অংশ। যৌনতা মানব জীবনের জন্য অপরিহার্য ও মূল্যবান। আজ থেকে ২০ বছর আগেও আমরা কিশোরদের নিয়ে কাজ করেছি। যখন এসব বিষয় নিয়ে সহকর্মীদের সঙ্গে আলোচনা করতাম, তখন তাদের সঙ্গে আমার একটা পার্থক্য ছিল।
আমি প্রথমে আমাকে, আমার দেশ, কৃষ্টি, সাহিত্য, সভ্যতা, সংস্কৃতি ইত্যাদি সম্পর্কে জানব। এরপর কিশোরদের সঙ্গে সমাজে তাদের দায়িত্ব ও করণীয় নিয়ে আলোচনা করব। আমি দেখেছি, যেকোনো পাঠ্যক্রমে এটাকে সময় নষ্ট করা বলে মনে করা হয়। এটার সঙ্গে আমি সম্পূর্ণ দ্বিমত পোষণ করি।
কিশোর–কিশোরীদের কৃষ্টি, সভ্যতা ও নান্দনিকতাবোধ জাগিয়ে তোলা প্রয়োজন। পরিপূর্ণ বিকাশের জন্য একজন মানুষের মধ্যে নান্দনিকতাবোধ জাগালে তার মধ্যে অনেক ভালো চিন্তার বিকাশ ঘটবে এবং সেগুলো বিকশিত হবে।
এর ফলে তার মধ্যে জীবনদক্ষতা বৃদ্ধি, মতপ্রকাশের ক্ষমতা ও পরমতসহিষ্ণুতা গড়ে ওঠে। যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণাগুলো সরাতেই এই প্রজন্মকে বিজ্ঞানভিত্তিক তথ্য দিতে হবে।
শার্মিন ফরহাত ওবায়েদ
যৌন ও প্রজনন–স্বাস্থ্যের কথা বললেই স্বাস্থ্যসেবার কথা চলে আসে। আমরা যদি সঠিক তথ্য ও শিক্ষা না পাই, তাহলে স্বাস্থ্যসেবা সেভাবে কাজ করে না। তাই আমাদের শিক্ষার ওপর জোর দেওয়া দরকার
অনেকের অভিজ্ঞতায় শিক্ষদের দক্ষতা বৃদ্ধির কথা এসেছে। কিন্তু শুধু প্রশিক্ষণ দিলে হবে না। এই ধরনের স্পর্শকাতর ইস্যু নিয়ে সেশন পরিচালনার জন্য শিক্ষা উপকরণ প্রয়োজন।
তাহলে শিক্ষকেরা সেই প্রশিক্ষণ কাজে লাগাতে পারবেন। এ ছাড়া এই কারিকুলাম একটি সমন্বিত প্যাকেজ হওয়া দরকার, যেখানে তৃতীয় লিঙ্গ, শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধীদের জন্য তথ্য থাকবে। কারণ, তাদেরও এ শিক্ষার চাহিদা অাছে।
আমাদের সময় দারিদ্র্য ছিল একটা চ্যালেঞ্জ। এখনকার কিশোর–কিশোরীদের চ্যালেঞ্জ অনেক। কৈশোর বয়সে প্রজনন–স্বাস্থ্য নিয়ে কৌতূহলের শেষ নেই। এই ইন্টারনেটের যুগেও সঠিক এবং বিজ্ঞানসম্মত তথ্যপ্রাপ্তি একটা বড় চ্যালেঞ্জ এই খাতে আমরা যারা কাজ করছি, তাদেরও এ বিষয়ে ধারণাগত পার্থক্য রয়েছে। এর সামঞ্জস্য থাকা দরকার। সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন উদ্যোগের সমন্বয় প্রয়োজন। তাহলে আমরা লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারব।
ইকবাল হোসেন
তারুণ্যকে সামনে নিয়ে যাওয়ার জন্য যাঁরা কাজ করেন, তাঁরা কোনো পরিকল্পনা করার সময় যেসব সমস্যায় পড়েছেন, সেসব সমস্যা মাথায় রেখে পরিকল্পনা করেন।
যেমন আমরা যখন স্কুলে ছিলাম তখন যৌন ও প্রজনন–স্বাস্থ্যসংক্রান্ত অধ্যায়টির পাতা বন্ধ করে রাখা হতো। এখনো আমরা সেই কথাই বলছি। স্কুলের ছেলেমেয়েরা এসব নিয়ে কী ভাবছে, তা জানতে আমরা কিছুদিন আগে স্কুলে যাই। ছেলেমেয়েদের সঙ্গে আলাদা করে কথা বলার পরিকল্পনা করা হয়। কিন্তু স্কুলে গিয়ে দেখা যায়, ছেলেমেয়েদের সঙ্গে আলাদা করে কথা বলতে হয়নি। তারা একসঙ্গেই কথা বলেছে। তারা বলেছে, আমরা অনেক কিছুই এখন জানি।
কিন্তু কোথায় সঠিক তথ্য আছে, সেটা জানি না। অনেকেই বলে যৌন ও প্রজনন–স্বাস্থ্য সম্পর্কে যথেষ্ট কনটেন্ট পাঠ্যবইয়ে নেই। কনটেন্ট আরও বেশি দিলেও এর কোনো সমাধান হবে না।
৫ থেকে ১০ লাখ টাকা খরচ করে স্কুলের গেট তৈরি করা হয়। অথচ স্কুলে পরিচ্ছন্ন বাথরুম নেই। এটা টাকাপয়সার দৈন্য নয়, মানসিক দৈন্য।
প্রবীর কুমার ভট্টাচার্য্য
প্রজনন ও যৌন শিক্ষা নিয়ে সমাজ যে পরিবর্তনের দিকে যাচ্ছে, তা লক্ষণীয়। আমরা বসে আছি, তা নয়। আমরা চেষ্টা করছি। এর পাশাপাশি আপনারাও চেষ্টা করছেন এবং সে জন্যই আমরা আশাবাদী। আমাদের একটি কিশোর–কিশোরী শিক্ষার্থী কর্মসূচি রয়েছে।
ইউএনএফপিএর সঙ্গে আমাদের কিছু কর্মসূচি রয়েছে। ২৫০টি প্রতিষ্ঠানে প্রথম পর্যায়ের কর্মসূচি শেষ হয়ে এখন দ্বিতীয় পর্যায়ের কর্মসূচি চলছে। এই কর্মসূচি অনেকটা সফল। তবে সরকারের একার পক্ষে সব করা সম্ভব হয় না।
আমরা যদি সবাই মিলে একসঙ্গে কাজ করি, তবে অবশ্যই এই সমস্যা থেকে উত্তরণ ঘটবে। আমি আরও আশাবাদী এ জন্য যে আমার স্ত্রী স্যানিটারি ন্যাপকিনের কথা আমাকে বলতে লজ্জা পেত।
অথচ আমার মেয়ে আমাকে বলে যে বাবা আমার এটা লাগবে। আমরা চাই আরও দ্রুত পরিবর্তন আসুক।
রাশেদা কে চৌধূরী
দুটো বিষয়ে আলোচনা এসেছে। একটি হলো শিক্ষা। অন্যটি কৈশোর ও তারুণ্যের অধিকার। শিক্ষা, কৈশোর ও তারুণ্যের অধিকার নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। এই জায়গা থেকে শুরু করলে সবাই সহযোগী হবে।
সরকার হলো একটা জাহাজের মতো। খালে-বিলে যেতে পারে না। এসব জায়গায় পৌঁছানোর জন্য আমাদের মতো সহযোগীদের দরকার। সেটা উন্নয়ন সহযোগী, বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ও মানবাধিকার সংগঠন হতে পারে।
কিশোর-কিশোরীরা কোনো না কোনোভাবে যৌন ও প্রজনন–স্বাস্থ্য সম্পর্কে জেনে যাচ্ছে, যাবে। কিন্তু তাদের সময়মতো জানার সুযোগ দিতে হবে।
যাঁরা শেখাবেন, অর্থাৎ শিক্ষকেরা এই শিক্ষা দেওয়ার ব্যাপারে কতখানি ইচ্ছুক, তা নজর দেওয়া দরকার।
আমরা জানাই বা না জানাই শিক্ষার্থীরা কিন্তু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে শিখে যাচ্ছে। তথ্য উন্মুক্ত হলেই যে খারাপ হয়ে যাবে, এই ধারণা ঠিক না। কৃষ্টি ও সংস্কৃতির নামে যেন অপব্যবহার না হয়, সে বিষয়ে সচেতন হতে হবে।
ফিরোজ চৌধুরী
কিশোর ও তরুণদের জন্য অত্যন্ত দরকারি একটি বিষয় নিয়ে আজকের গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হলো। আলোচনায় যৌন ও প্রজনন-স্বাস্থ্য শিক্ষা সম্পর্কিত অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উঠে এসেছে।
আশা করা যায়, এই গোলটেবিল বৈঠক থেকে পাওয়া পরামর্শ নীতিনির্ধারকের ভূমিকা নির্ধারণে কাজে লাগবে। আলোচনায় অংশ নেওয়ার জন্য প্রথম আলোর পক্ষ থেকে সবাইকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই।
যাঁরা অংশ নিলেন
রাশেদা কে চৌধূরী: নির্বাহী পরিচালক, গণসাক্ষরতা অভিযান
প্রবীর কুমার ভট্টাচার্য্য: পরিচালক, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর
মাশফিকা জামান সাটিয়ার: সিনিয়র পলিসি অ্যাডভাইজর, সেক্সুয়াল অ্যান্ড রিপ্রোডাক্টিভ হেলথ অ্যান্ড রাইটস অ্যান্ড জেন্ডার
ইকবাল হোসেন: শিক্ষা বিশেষজ্ঞ, ইউনিসেফ
রোকেয়া কবীর: নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘ (বিএনপিএস)
নূর মোহাম্মদ: নির্বাহী পরিচালক, পপুলেশন সার্ভিসেস অ্যান্ড ট্রেনিং সেন্টার (পিএসটিসি)
ইউ এম হাবিবুন নেসা: সদস্য, নারীপক্ষ
সাবিনা ফয়েজ রশিদ: ডিন, ব্র্যাক জেমস পি গ্রান্ট স্কুল অব পাবলিক হেলথ
আলতাফ হোসেন: নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন ফর প্রিভেনশন অব সেফটিক অ্যাবোরশন
সালেহ আহমেদ: নির্বাহী পরিচালক, বন্ধু সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার সোসাইটি
শার্মিন ফরহাত ওবায়েদ: কর্মসূচি সমন্বয়ক, ইউবিআর অ্যালায়েন্স বাংলাদেশ
কল্লোল চৌধুরী: যুগ্ম পরিচালক (স্বাস্থ্য), দুস্থ স্বাস্থ্যকেন্দ্র (ডিএস কে), ইউবিআর প্রোগ্রাম
জুলিয়া আহমেদ: ইনডিপেনডেন্ট কনসালট্যান্ট, রিপ্রোডাক্টিভ হেলথ রাইটস
মনিমুক্তা ইসলাম: যুব প্রতিনিধি, ইউবিঅার প্রোগ্রাম, সাভার
মো. আল আমিন: যুব প্রতিনিধি, ইউবিআর প্রোগ্রাম, গাজীপুর