শিক্ষাঙ্গনে দুই বছর দলীয় রাজনীতি বন্ধ থাক
স্নাতক পর্যায়ের ছাত্রছাত্রীদের ব্যক্তি হিসেবে রাজনীতি করা, রাজনৈতিক মতাদর্শে অনুরক্ত বা আকর্ষিত হওয়া, কোনো রাজনৈতিক সংগঠনের সদস্যপদ গ্রহণ, সে সুবাদে নেতৃত্বের বিভিন্ন সিঁড়ি আরোহণ—সবটাই আইন ও সংবিধানসম্মত এবং সুষ্ঠু সমাজ বিকাশের সহায়ক রীতি ও পদ্ধতি। তাহলে বাংলাদেশে এ মুহূর্তে ছাত্ররাজনীতি ও ছাত্রসংগঠন নিয়ে জাতির এত ভয়াবহ উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা কেন? তাৎক্ষণিক কারণ হিসেবে বলা যায়, বিপর্যস্ত শিক্ষাব্যবস্থা ও শিক্ষাঙ্গনের ভয়াবহ রূপ, কিছু অপরাজনৈতিক শক্তি ও ব্যক্তি কর্তৃক কোমলমতি শিক্ষার্থীদের বিপথগামী করা, শিক্ষার্থীদের ওপর একশ্রেণির রাজনৈতিক লেবাসধারী গুন্ডা-পান্ডার শারীরিক-মানসিক নির্যাতন, নিরীহ ছাত্রছাত্রীদের জীবনের নিরাপত্তাহীনতা এবং সর্বোপরি শিক্ষা প্রশাসনের নির্লজ্জ দলবাজি, অদক্ষতা, নির্লিপ্ততা, দুর্বল নৈতিকতা এবং ক্ষেত্রবিশেষে চরম অসহায়ত্ব।
এ দুই অবস্থার দুই ধরনের প্রকৃতি ও প্রেক্ষাপট। প্রথমটি কেতাবি ধারণা বা তত্ত্ব। দ্বিতীয়টি দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা। এ দুয়ের মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে এই অবস্থা থেকে উত্তরণের উপায় হিসেবে অনেকে মতামত দিচ্ছেন, শিক্ষাঙ্গন থেকে ‘দলীয় রাজনীতি’ নিষিদ্ধ করে দিলেই অবস্থার উন্নতি হতে পারে। সবাই একবাক্যে স্বীকার করবেন, এই অরাজক অবস্থা হঠাৎ করে এক–দুই মাস বা বছরে সৃষ্টি হয়নি। তিলে তিলে গড়ে ওঠা এ মহাদানবীয়তার আশ্রয়-প্রশ্রয়, যার দায় আমাদের সবার। তাই সবাইকে অত্যন্ত সতর্ক ও সুচিন্তিত পদক্ষেপ নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। শুধু রাজনীতি বন্ধের ফাঁকা বুলি দীর্ঘস্থায়ী ফলাফল দেবে না। রাজনীতি সত্যিকার অর্থে অনেক ক্যাম্পাসেই এখন নেই, তাই বলে টেন্ডারবাজি, সন্ত্রাস, হল-হোস্টেলের সিট দখল, ভিন্নমতাবলম্বীদের দমন-পীড়ন বন্ধ হয়নি। আবার রাজনীতি এমন একটি প্রক্রিয়া, যা কারও নির্দেশে বন্ধ হয় না, কারও নির্দেশে শুরুও হয় না। তবে রাজনীতিকে শুদ্ধ ও সুস্থ ধারায় বিকাশের উদ্যোগ নেওয়া যায়। যে বুয়েট ক্যাম্পাসে নির্মম হত্যাকাণ্ডটি সংঘটিত হলো, সে ক্যাম্পাসে সত্যিকার অর্থে কোনো রাজনীতি ছিল না। ছিল সরকারি দলের তকমাধারী একদল বিকৃত মানসিকতার ছাত্রনামধারীর ত্রাসের রাজত্ব।
বুয়েটে আবরারের হত্যাকাণ্ডের আগে অনুরূপ ঘটনা আর ঘটেনি, তা নয়। নির্যাতিত হয়ে ক্যাম্পাসও ছেড়েছে অনেকে। অভিযোগও হয়েছে, কিন্তু প্রতিকার হয়নি। প্রতিবাদ, প্রতিরোধ কিংবা মিডিয়ায় প্রকাশিতও হয়নি। তবে ক্যাম্পাসে সবাই তা কমবেশি জানত। শুধু বুয়েট নয়, চুয়েট, রুয়েট, কুয়েট, ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়—কোনো প্রতিষ্ঠানই এই দুর্বৃত্তায়নের বাইরে নেই বা ছিল না। নির্যাতনের রকম ও ধরনে উনিশ-বিশ ছিল। আবরারের মৃত্যু কারও কারও কাছে এখনো দুর্ঘটনা। কয়েকজন অতিরিক্ত ‘পান’ করায় এমন অঘটন ঘটে গেল বলে প্রকাশ্যে মৃদু আক্ষেপ দেখেছি। কোনো কোনো দুর্ঘটনা বা অঘটন ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দেয়, যেমন ছোট্ট একটি স্ফুলিঙ্গ দাবানল সৃষ্টি করে। যেমনটি হয়েছিল ঢাকার রাজপথে বেপরোয়া বাসের চাকায় পিষ্ট হয়ে দুজন কিশোর ছাত্রের মৃত্যু–পরবর্তী লাগাতার সড়ক অবরোধ এবং মন্ত্রী, এমপি, পুলিশ কর্মকর্তাসহ অনেকের বৈধ কাগজপত্র ছাড়া যানবাহন শনাক্তকরণ, ভিআইপিদের উল্টো পথে চলা গাড়িগুলোকে সোজা পথ দেখিয়ে দেওয়া। জাঁদরেল ভিআইপিদের রাজপথে কিশোরদের কাছে মাফ চাওয়া। একইভাবে স্বতঃস্ফূর্ত কোটাবিরোধী আন্দোলনের কথাও স্মরণ করা যেতে পারে। বুয়েটের সর্বশেষ দুর্বৃত্তপনার নির্মম বলি আবরারও জীবন দিয়ে দেশের সব ছাত্রছাত্রী, তাদের পিতামাতা, ভাইবোন, চিন্তাশীল সাধারণ মানুষ, দেশের শিক্ষকসমাজ, সরকার—সবার চিন্তা–চেতনায় প্রবলভাবে আঘাত করেছে। তাই বিষয়টি নিয়ে বাস্তবানুগ পদক্ষেপ চাই।
বাংলাদেশে ছাত্ররাজনীতি ও রাজনৈতিক ছাত্রসংগঠনের নিজস্ব ইতিহাস এবং সমৃদ্ধ ঐতিহ্য রয়েছে। ১৯৩০ থেকে ১৯৪৭ পাকিস্তান আন্দোলন পর্বে মুসলিম ছাত্রলীগ, পাকিস্তান সময়ে ১৯৪৮ সালে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ, ১৯৫০–এর দশকে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক কর্মকাণ্ডে নিজেদের সীমাবদ্ধ না রেখে জাতীয় রাজনৈতিক বিষয়ে অনেক বেশি সমর্পিত হয়। সেটাই হয়তো ছিল সময়ের দাবি।
স্বাধীনতার পর থেকে ছাত্ররাজনীতি ক্রমাগতভাবে সহিংস হয়ে ওঠে। সে সহিংসতায় সব সময় ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠন এগিয়ে থাকত। সাম্প্রতিক সময়ে শিক্ষাঙ্গনে প্রকৃত অর্থে কোনো রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড নেই। রাজনৈতিক দলের ছত্রচ্ছায়ায় এখন যা হয়, তার নিকৃষ্ট নমুনা জাতি ইতিমধ্যে দেখেছে। পত্রিকান্তরে জানা গেল, স্বাধীনতার পর থেকে ক্যাম্পাসে প্রায় ১৫১টি লাশ পড়েছে। তবে দাঙ্গা-হাঙ্গামা, আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার, পাঠদান বিঘ্নিত হওয়া, হল-হোস্টেল খালি করা, নারী নির্যাতন ইত্যাদি ক্যাম্পাসের স্বাভাবিক অনুষঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ছাত্রনেতাদের ক্যাম্পাস ঘিরে ব্যবসা–বাণিজ্য, বখরা-কমিশন, নেশা ও মাদকসেবন এবং মাদক ব্যবসা; সর্বোপরি কলেজ–বিশ্ববিদ্যালয়ে সমান্তরাল প্রশাসন পরিচালনার কথাও শোনা যাচ্ছে। উৎকণ্ঠিত জাতি এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণ চায়। এসব অরাজকতার কারণে শিক্ষাব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে।
এর প্রতিকারে সরকারের পাশাপাশি সমাজের বিভিন্ন অংশের মানুষকে দায়িত্ব নিয়ে এ প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত হতে হবে। প্রথম দায়িত্ব বর্তায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহের কর্মকর্তাদের ওপর। যে মৌলিক বিষয়ে সব শিক্ষককে ঐকমত্যে আসতে হবে, তা হলো শিক্ষকদের আত্মমর্যাদাবোধ ও শিক্ষকসুলভ ব্যক্তিত্ব প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার এবং দলকানা ও দলদাসসুলভ মানসিকতা পরিহার। যে শিক্ষাঙ্গনে অপেশাদার, দলকানা, দলদাস শিক্ষকদের আধিপত্য থাকবে, সে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্ররাজনীতি ও শিক্ষকরাজনীতি উভয়ই কলুষিত হতে বাধ্য। এ অবস্থায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো নিম্নলিখিত কার্যক্রম শুরু করতে পারে।
১. পাঠদান নিয়মিতকরণ, ক্লাসে ছাত্র-শিক্ষক উভয়ের উপস্থিতি নিয়মিতকরণ এবং পাঠপ্রক্রিয়াকে উপভোগ্য ও আনন্দদায়ক করার যাবতীয় উদ্যোগ গ্রহণ। ছাত্র-শিক্ষক সবার জন্য উপযুক্ত প্রণোদনার ব্যবস্থা করা।
২. ক্যাম্পাসের নিয়মনীতি, আইনশৃঙ্খলা, শিষ্টাচার কঠোরভাবে অনুসরণ নিশ্চিত করা। অমান্যকারীদের যথাযথ শাস্তি বিধান।
৩. হল-হোস্টেল প্রশাসনে নিয়মনিষ্ঠ, নিরপেক্ষ, দক্ষ ও কর্মঠ ব্যক্তিদের নিয়োগ এবং তাঁদের যথাযথ সহায়তা নিশ্চিত করা।
৪. ইতিমধ্যে ক্যাম্পাসে যেসব অনিয়ম, র্যাগিংয়ের নামে নির্যাতন, বাড়াবাড়ি হয়েছে, সেসব বিষয়ে তদন্ত করে নির্যাতিত ও নির্যাতনকারীদের চিহ্নিতকরণ এবং অপরাধের মাত্রা ও ধরন অনুসারে দণ্ড প্রদান এবং ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ প্রদান।
৫. প্রতিষ্ঠানের আইনগত ক্ষমতার আওতায় নিয়মনীতি প্রয়োগ করে ক্যাম্পাসে দলীয় রাজনীতি অন্তত আগামী দুই বছরের জন্য সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করে দেওয়া।
৬. ২০২০ সালের মধ্যে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সর্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে ছাত্র সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান নিশ্চিত করা।
৭. ছাত্র সংসদ নির্বাচনে দলভিত্তিক প্রচারণা প্রার্থীর অযোগ্যতা হিসেবে পরিগণিত করা।
৮. প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে দলনিরপেক্ষ শিক্ষকদের প্রক্টরিয়াল বডি, প্রভোস্ট, হাউস টিউটর, হোস্টেল সুপার ইত্যাদি দায়িত্ব দেওয়া।
৯. প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রম বৃদ্ধি করা।
১০. পড়াশোনা, গবেষণা, প্রশাসনসহ নানা সৃজনশীল উদ্যোগের জন্য ছাত্র-শিক্ষক উভয়কে পুরস্কৃত করা।
সরকার ও দেশের দায়িত্বশীল সব রাজনৈতিক দল শিক্ষাঙ্গনের এই অস্থির সময়কে সুস্থির করার জন্য রাজনৈতিক স্বার্থ বা দলীয় বিবেচনার ঊর্ধ্বে উঠে একটি ঐকমত্যে উপনীত হবেন, এটি জাতির প্রত্যাশা। শিক্ষাঙ্গন ব্যবস্থাপনায় বাইরের হস্তক্ষেপ বন্ধ করে নিরপেক্ষ প্রশাসনকে সব আইনি সহায়তা দিতে হবে। এ জন্য প্রয়োজনে সরকারের পক্ষ থেকে একটি সর্বদলীয় কমিটি করে সম্ভাব্য করণীয়সমূহ আলোচিত হতে পারে। এ ক্ষেত্রে শিক্ষাঙ্গনকে সন্ত্রাসমুক্ত করার জন্য রাজনৈতিক দলসমূহ ঐকমত্যের মাধ্যমে ক্যাম্পাসে দলীয় কার্যক্রম বন্ধ করে দিতে পারে। ক্যাম্পাসে বিভিন্ন সমসাময়িক রাজনৈতিক, সামাজিক, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিষয় নিয়ে তর্ক-বিতর্ক হবে। ছাত্রছাত্রীরা অন্তত ক্যাম্পাসের ক্ষুদ্র পরিসরে দলীয় প্রচারণার বদলে মুক্তমনে রাজনীতি নিয়ে তর্ক-বিতর্ক করবে। দলীয় ছাত্র ফোরাম দেশে থাকতে পারে, তারা ক্যাম্পাসের বাইরে নিজ নিজ দলের জন্য কাজ করবে। স্নাতক পর্যায়ের ছাত্রছাত্রীরা ইচ্ছা করলে সরাসরি তাদের পছন্দমতো রাজনৈতিক দলের সদস্যপদ গ্রহণের অধিকারী হবে। যারা সরাসরি রাজনৈতিক দলের সদস্য হবে, তারা আর ছাত্র সংসদ নির্বাচনে অংশ নেবে না। উন্নত ও স্থিতিশীল গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে রাজনৈতিক দল, ছাত্রসমাজ এবং ক্যাম্পাসের মধ্যে যেভাবে রাজনীতির মিথস্ক্রিয়া হয়, আমরা আমাদের রাজনীতিকে সেই সভ্য ও সংস্কৃতির পথে প্রবাহিত করতে পারি। এতে বিরাজনীতিকরণ যেমন হবে না, আবার সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের স্বাধীন মতপ্রকাশ, নেতৃত্বের বিকাশ উপযোগী ক্যাম্পাসে মানবিক ও উন্মুক্ত পরিবেশ ফিরে আসবে।
বিরাজনীতিকরণ ও অতিরাজনীতিকরণ—দুটিই সমাজের জন্য ক্ষতিকর। আমাদের উচিত দুই চরম অবস্থার মধ্যবর্তী অবস্থানে সমাজকে রাখার চেষ্টা করা। আমরা বর্তমানে অতিমাত্রায় দলীয়কৃত একটি সমাজের বাসিন্দা। এ এক ভয়ংকর সমাজ। ছাত্রসমাজকে এ ভয়ংকর প্রবণতা থেকে মুক্ত করতে হবে।
ড. তোফায়েল আহমেদ: কুমিল্লার ব্রিটানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। স্থানীয় সরকার ও শাসন বিশেষজ্ঞ
[email protected]