সিরীয় যুদ্ধের চোরাবালিতে এরদোয়ান?
অপারেশন পিস স্প্রিং নাম নিয়ে প্রায় দেড় বছর পর আবার সিরিয়ায় অভিযান শুরু করল তুরস্ক। আগের মতোই ট্রাম্প-এরদোয়ান ফোন আলাপের পর শুরু হয় এই অভিযান। তবে এই অভিযানের পরিধি ও লক্ষ্য আগের চেয়ে ভিন্ন। শরণার্থীদের জন্য ‘নিরাপদ অঞ্চল’ গঠন ও সন্ত্রাসীদের তুরস্কের সীমানা থেকে দূরে রাখা এই অভিযানের লক্ষ্য। আগের অভিযান ছিল আফরিনে, ফোরাত নদীর পূর্ব দিকে, যেখানে কুর্দিদের ভরসাস্থল এবং হাতিয়ারের জোগানদাতা ছিল রাশিয়া। এই অভিযানও ফোরাত নদীর পূর্ব দিকে কিন্তু এখানে কুর্দিদের মিত্র ও হাতিয়ারের জোগানদাতা ভিন্ন, আমেরিকা। আফরিন অভিযানে ওয়াশিংটনের এক ধরনের পরোক্ষ সমর্থন থাকলেও, ফোরাত নদীর পূর্ব দিকের এই অভিযানে ওয়াশিংটন থেকে ভিন্ন ভিন্ন বিবৃতি এসেছে। অভিযানে ট্রাম্পের একক সবুজ সংকেত থাকলেও কংগ্রেস থেকে শুরু করে রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাটদের সমর্থন নেই বরং আসে শক্ত প্রতিবাদ। কারণ, তাঁরা মনে করেন, কুর্দিরাই একমাত্র টেকসই মিত্র, যারা আমেরিকানদের সাহায্য করেছে আইএসকে পরাজিত করতে। তাই আঙ্কারার এই অভিযানে নীরবতা পালন অথবা সমর্থন দেওয়া ‘টেকসই’ মিত্রের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতার সমান।
ওয়াশিংটনের মিত্রতার পুরস্কারস্বরূপ কুর্দিরা এখন মধ্যপ্রাচ্যের বড় রাজনৈতিক খেলোয়াড়। তারা নিয়ন্ত্রণ করছে ইরাক ও সিরিয়ার ভূখণ্ডের একটি অংশ। কিন্তু সিরিয়ায়, তুরস্কের সীমান্ত লাগোয়া অঞ্চলে, ফোরাত নদীর পূর্ব দিকের অঞ্চলে এক ধরনের আধা রাষ্ট্র কায়েম করেছে তারা। আর এটা সম্ভব হয়েছে ওয়াশিংটনের নির্বিচারে অস্ত্র সরবরাহ ও সেনা প্রশিক্ষণ থেকে শুরু করে সব ধরনের সুযোগ ব্যবহারের মধ্য দিয়ে। নতুন এই রাষ্ট্রের আবির্ভাবের মধ্যে আঙ্কারা তাদের জাতীয় নিরাপত্তার হুমকি দেখছে। কারণ এই সেমি-রাষ্ট্রের কর্তারাই আমেরিকানদের তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী সংগঠন, পিকেকের নেতা, যাঁরা তুরস্কের বিরুদ্ধে তিন দশক ধরে যুদ্ধে লিপ্ত।
ওবামা আমলের শেষ সময় থেকেই আঙ্কারা শরণার্থীদের জন্য সিরিয়ার অভ্যন্তরে একটি ‘নিরাপদ অঞ্চল’ গড়ে তোলার প্রস্তাব দেয় সিরীয় শরণার্থীদের পুনর্বাসনের লক্ষ্যে। আঙ্কারা সব আর্থিক দায়িত্ব নেওয়ার কথাও জানায়। কিন্তু ইউরোপ-আমেরিকা গরজ দেখায়নি। ওবামা প্রকাশ্যেই এই প্রকল্প বাতিল করে দিয়েছিলেন কিন্তু ট্রাম্পের একধরনের পরোক্ষ সায় ছিল এই প্রকল্পে। ট্রাম্প নির্বাচিত হওয়ার পর থেকেই আঙ্কারা উঠেপড়ে লেগে যায় এই প্রকল্প বাস্তবায়নে। কারণ শরণার্থীদের বোঝায়, তুরস্কের অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা ভেঙে এক ধরনের নাভিশ্বাস তৈরি হয়েছিল। যে নাভিশ্বাস এরদোয়ানের প্রায় দুই দশকের একচ্ছত্র শাসনকে হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে। তাই অতিসত্বর শরণার্থীদের অন্য কোথাও স্থানান্তর না করে গেলে তুরস্কের রাজনৈতিক মাঠে বড় ধরনের পরিবর্তন হবে, যা এরদোয়ানের সুদিনের সমাপ্তি আনতে পারে।
সেই চিন্তা থেকেই এরদোয়ান বৈশ্বিক নানান মঞ্চে তাঁর ‘নিরাপদ অঞ্চলের’ কথা তুলে ধরেছেন বিভিন্ন সময়ে। এরদোয়ান বারবার ইউরোপীয়দের আশ্বস্ত করার চেষ্টা করেছেন, সিরিয়ার অভ্যন্তরে একটি ‘নিরাপদ অঞ্চল’ ইউরোপের শরণার্থী সমস্যার সমাধানে দেবে। কিন্তু শরণার্থী সমাধান থেকে সিরিয়ার যুদ্ধে উভয় পক্ষের কাছে অস্ত্র বিক্রিতে বেশি লাভ ঠাওর করতে পেরে ইউরোপীয়রা নিরাপদ অঞ্চলের প্রকল্প বাতিল করে দেন। কিন্তু এরদোয়ান থেমে থাকেননি। গত মাসে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে এরদোয়ান তাঁর পরিকল্পিত ‘নিরাপদ অঞ্চলের’ মানচিত্র আবার উপস্থাপন করেন। এরদোয়ানের মানচিত্র বিশ্বকে দেখিয়েছে, তিনি কীভাবে সিরিয়ার অভ্যন্তরে ৪৮০ কিলোমিটার দীর্ঘ এবং ৩০ কিলোমিটার প্রশস্ত একটি নিরাপদ অঞ্চল গড়তে চান এবং সেই অঞ্চলে তুরস্কে থাকা ৪০ লাখের বেশি শরণার্থীর অর্ধেক অর্থাৎ ২০ লাখ শরণার্থীকে পুনর্বাসন করতে চান। কিন্তু ‘নিরাপদ অঞ্চল’ নিয়ে নিন্দুক এবং ইউরোপীয়রা বলছেন অন্য কথা। তাঁদের ভাষায়, এরদোয়ান কুর্দিদের উচ্ছেদের লক্ষ্য নিয়েই এই অভিযানে নামছেন।
অভিযানের পক্ষে ইউরোপীয় ইউনিয়ন আনুষ্ঠানিক কোনো বিবৃতি না দিলেও আঙ্কারার রয়েছে ন্যাটোর সমর্থন। রাশিয়া অনেকটা ধীর নীতি অবলম্বন করলেও সিরিয়ার সার্বভৌমত্বের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের আহ্বান জানিয়েছে আঙ্কারার প্রতি। তবে সন্দেহাতীত ভাবে বলা যায় যে পাশ্চাত্যের নব্য এই মিত্রদের উচ্ছেদের এই যাত্রা আঙ্কারাকে আন্তর্জাতিক মহলে সঙ্গীহীন করবে। বিশেষ করে ওয়াশিংটনে। রাশিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা এবং এস- ৪০০ ক্রয়, ২০১৬ সালের ব্যর্থ সেনা অভ্যুত্থানসহ মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক মানচিত্র বদলের পরিকল্পনায় আঙ্কারার প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের খবর ওয়াশিংটনে নীতিনির্ধারকদের বড় অংশকে আঙ্কারাবিরোধী বানিয়েছে। একমাত্র ব্যতিক্রমী প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। ট্রাম্পের সুনজরে ছিল আঙ্কারা, যা আঙ্কারাকে রেহাই দেয় অর্থনৈতিক অবরোধ থেকে। কিন্তু সমালোচকদের ভাষ্য, আঙ্কারার প্রতি ট্রাম্পের ‘সুনজর’ ওয়াশিংটনের অবস্থান দুর্বল করেছে বিশ্ব রাজনীতিতে। সেই শঙ্কা থেকেই ট্রাম্পের বিদায়ের পর ওয়াশিংটন-আঙ্কারা দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের অবয়ব নিয়ে চিন্তিত রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা।
ট্রাম্প অভিযানের জন্য এমন সময়ে সবুজ সংকেত দিলেন, যখন ট্রাম্প ও এরদোয়ান উভয়েই অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে প্রায় কোণঠাসা। দুর্নীতির প্রশ্নে ডেমোক্র্যাটরা ট্রাম্পের অভিশংসন প্রক্রিয়া শুরু করেন৷ অভিশংসন প্রক্রিয়ার শুরু ট্রাম্পের ক্ষমতার প্রতি প্রথম কোনো সংঘবদ্ধ হুমকি। সমালোচকেরা বলছেন, ট্রাম্প তাঁর বিরুদ্ধে শুরু হওয়া অভিশংসন প্রক্রিয়া থেকে মনোযোগ সরাতে এরদোয়ানকে সিরিয়ায় হামলার সবুজ সংকেত দিয়েছেন। একই ভাবে গত স্থানীয় নির্বাচনে ইস্তাম্বুল, আঙ্কারাসহ বড় বড় শহরে হেরে এরদোয়ানের অবস্থা রাজনৈতিক ভাবে বেশ কাহিল।
পরিষ্কারভাবে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক মানচিত্রে যেকোনো পরিবর্তন তুরস্ককে স্থায়ীভাবে অস্থিতিশীল করবে। সেই ধারণা থেকেই ‘নিরাপদ অঞ্চল’ গড়ে তুলে নিজেদের সার্বভৌমত্ব রক্ষার কৌশল নিয়েছে তুরস্ক। এই কৌশল একই সঙ্গে আঙ্কারাকে সিরিয়ার যুদ্ধের চোরাবালিতে আটকে দিচ্ছে। সিরিয়ার যুদ্ধের মধ্যে আফগানিস্তান ও ভিয়েতনাম যুদ্ধের ছায়া বিদ্যমান, যেখানে বিশ্বের শক্তিমান কর্তারা ঘুঁটি নাড়ছেন; সময়ের পরিবর্তনে মিত্র বদল করছেন আর ভুগছে সাধারণ মানুষ। আফগান যুদ্ধে জিহাদের নামে পাশ্চাত্য যেভাবে মুসলমানদের ধর্মীয় অনুভূতি ব্যবহার করে সোভিয়েত পতনে গতি দিয়েছিল, ঠিক একই ভাবে কুর্দিদের ব্যবহার করে মধ্যপ্রাচ্যের নতুন রাজনৈতিক মানচিত্র গঠনে ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে মার্কিনরা। অভিযান অপারেশন পিস স্প্রিং সেই পরিকল্পনায় সাময়িক বাধা হতে পারে কিন্তু থামিয়ে দিতে পারবে কি না, তা ভবিষ্যৎ ই বলে দেবে।
রাহুল আনজুম: ইস্তাম্বুলে বসবাসরত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞানের প্রাক্তন শিক্ষার্থী।