এবারের সংকট একেবারেই অন্য রকমের
রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের মানুষের কাছে অচেনা কোনো জনপদবাসী নয়। তারা আমাদের দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের প্রতিবেশী মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের মানুষ। জাতিসংঘের বিশ্লেষণমতে, তারা বিশ্বের সবচেয়ে নিপীড়িত জাতিগোষ্ঠী। দীর্ঘকাল গণতান্ত্রিক আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী অং সান সু চি আজ কার্যত গণতন্ত্রের খলনায়কদের খপ্পরে। রোহিঙ্গারা ১৯৮২ সালের আইনে নিজ দেশে হারিয়েছে নাগরিকত্ব। অথচ অষ্টম শতাব্দী থেকে তাদের ওই অঞ্চলে বসবাস করার ঐতিহাসিক তথ্যাদি প্রচুর।
২৫ লাখ মানুষের এই সম্প্রদায়ের প্রায় সবাই মুসলমান। এদের মধ্যে এখন মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে বসবাস করছে মোট ৪ লাখ। আর সেখান থেকে বিতাড়িত হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয়প্রাপ্তদের নিবন্ধিত সংখ্যাই ১১ লাখ। নিকট প্রতিবেশী বলে তারা যখনই বিপন্ন হয়, তখনই তাদের আশ্রয়ের প্রথম পছন্দ আমাদের দেশটি। বিভিন্ন সময়ে কিছু বিচ্ছিন্ন দেশান্তরের ঘটনা বাদ দিলে ১৯৭৮ এবং ১৯৯২ সালে এসেছিল যথাক্রমে প্রায় ২ লাখ ও ৩ লাখ। ১৯৭৮ সালের সবাই ফেরত গেছে। ১৯৯২ সালের প্রায় ২০ হাজার রয়ে যায়। তারপর ২০১৭ সালের আগস্টে রাখাইনে তাদের ওপর যে তাণ্ডব এল, তার তুলনা নেই। প্রশ্ন থাকে, এরা কেন বারবার আসে?
স্বেচ্ছায় কেউ অনিশ্চিত পথে পা বাড়ায় না। সে দেশটি কেড়ে নিয়েছে তাদের নাগরিকত্ব। প্রবেশাধিকার নেই সেখানকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। গতিবিধিও নিয়ন্ত্রিত। তা সত্ত্বেও মাটি কামড়ে পড়ে ছিল। কিন্তু এবার সামরিক বাহিনী ও পুলিশের নেতৃত্বে স্থানীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ রোহিঙ্গাপল্লিগুলোতে নারকীয় হামলা চালায়। এমএসএফ নামের সংস্থার হিসাবে, এ হামলায় ৭৩০টি শিশুসহ ৭ হাজার ৭০০ রোহিঙ্গা প্রাণ হারিয়েছে। সম্ভ্রমহানি ঘটেছে বহুসংখ্যক নারীর। পুড়িয়ে দেওয়া হয় তাদের বাড়িঘর। তাই ব্যাপকভাবে প্রতিবেশী দেশে পালিয়ে আসা ছাড়া বিকল্প তাদের সামনে ছিল না।
১৯৭৮ ও ১৯৯২ সালে আসা রোহিঙ্গাদের সংখ্যা এত বেশি ছিল না। তাদের দেওয়া তথ্যানুসারে, এবার তাদের ওপর নিপীড়নের মাত্রা আগের দুবারের চেয়ে অনেক বেশি ছিল। আর ১৯৭৮ সালে তাদের নাগরিকত্বও ছিল। সেসব কাগজপত্র দেখেই প্রত্যাবাসন করা হয়। ১৯৮২ সালে সামরিক শাসকেরা আইন সংশোধন করে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব বাতিলের যে ব্যবস্থা করেন, তা থেকে ফেরার জন্য মিয়ানমারের নতুন গণতান্ত্রিক নেতৃত্ব শুরুর দিকে কিছুটা উদ্যোগ নিয়েছিলেন। গঠিত হয়েছিল কফি আনান কমিশন। তাঁরা প্রতিবেদনও দিয়েছিলেন। তাতে রোহিঙ্গাসহ সব জনগোষ্ঠীর নৃতাত্ত্বিক স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখে একটি বহুত্ববাদী সমাজ গঠনের সুপারিশ ছিল। দুর্ভাগ্যক্রমে সে প্রতিবেদনটি পেশের পরপরই রোহিঙ্গাদের জীবনে নতুনভাবে কালরাতের সূচনা হয়। এর কোনো সুরাহা আজও হয়নি।
এখন জনবহুল উন্নয়নমুখী একটি দেশের ওপর ১১ লাখ রোহিঙ্গার বোঝা। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এ মানবিক ডাকে সাড়া দিয়েছে। এতে বাংলাদেশের বোঝা কিছুটা হালকা হলেও মূল সমস্যা মেটেনি। দেশের পর্যটনের জন্য খ্যাত টেকনাফ উপত্যকার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশে রোহিঙ্গাদের ঠাঁই দিতে হয়েছে। ফলে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে বনভূমি আর পরিবেশের। এখানকার স্থানীয় অধিবাসীরা এ ভোগান্তির শিকার। গ্রামীণ অবকাঠামো ভেঙে তছনছ। যেসব রাস্তা তৈরি করা হয়েছিল, রিকশা, অটো ইত্যাদি চলার জন্য সেগুলো দিয়ে এখন চলাচল করছে ত্রাণসামগ্রীবাহী ভারী ট্রাক। কক্সবাজার–টেকনাফ মহাসড়ক ভেঙেচুরে জেরবার। পাঁচ লাখ স্থানীয় জনগোষ্ঠীর ঘরে আজ প্রায় দুই বছর ধরে ১১ লাখ অতিথি।
তিন দফাতেই রোহিঙ্গা শরণার্থীশিবির পরিচালনা ও প্রত্যাবাসনকাজ পর্যবেক্ষণের সুযোগ হয়েছে এই নিবন্ধকারের। ১৯৭৮-৭৯ সময়ে ক্যাম্প ইনচার্জ হিসেবে সরাসরি দায়িত্ব পালন। তখন ১৩টি ক্যাম্পে বিভক্ত ছিল রোহিঙ্গারা। ক্যাম্পের অভ্যন্তরে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা–কর্মচারী ছাড়া অন্য কেউ প্রবেশে ক্যাম্প ইনচার্জের অনুমতি নিতে হতো। জাতিসংঘ উদ্বাস্তুবিষয়ক হাইকমিশন (ইউএনএইচসিআর) এবং অক্সফাম (স্যানিটেশন কাজে দায়িত্বপ্রাপ্ত) প্রতিনিধি ছাড়া আর কোনো বিদেশি বিনা অনুমতিতে ক্যাম্পে ঢুকতে পারতেন না। তেমনি রোহিঙ্গাদের বাইরে যেতে হলে লিখিত অনুমতি নিতে হতো। পুলিশ–আনসার তদারক করত এ ব্যবস্থা। ১৯৯২ সালে রোহিঙ্গা কার্যক্রমের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা-পরবর্তী সময় কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ পেয়ে দেখেছি, ব্যবস্থাপনা প্রায় একই রকম ছিল। ওই দুবারই বাংলাদেশের মূল জোর ছিল প্রত্যাবাসনে। প্রাথমিক ক্যাম্প ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম শেষ হওয়ার পরপরই চলত এ কাজ। কেন্দ্রীয় পর্যায়ে মাঝেমধ্যে বৈঠক হতো। তবে স্থানীয় পর্যায়েই প্রতিপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ চলত নিয়মিত। ক্যাম্প কর্মকর্তারা তালিকাভুক্ত রোহিঙ্গা নিয়ে নিয়মিত নাফ নদীর অপর তীরে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের কাছে সমর্পণ করে চলে আসতেন এপারে। কর্মচাঞ্চল্য আর সমস্যা সমাধানের দিকে যাচ্ছে দেখে খুব ভালো লাগত। কিন্তু খুব বিচলিত বোধ করি, যখন দেখি এবারের সমস্যাটি সমাধানের দিকে যাওয়ার সুস্পষ্ট কোনো লক্ষণ নেই। অবশ্য এবার নিবন্ধকারের অবস্থান একটি আন্তর্জাতিক সংস্থার পক্ষে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর চাহিদা নিরূপণসহ প্রাসঙ্গিক বিষয়াদি।
মনে হচ্ছে ১৯৭৮ ও ১৯৯২ সালের সমস্যা ছিল অনেকটা স্থানীয় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ধরনের। সেখানকার স্থানীয় প্রশাসন ও পুলিশ ছিল রোহিঙ্গাদের বিপরীতে। ফলে নিপীড়নের শিকার হয়ে তারা এপারে চলে আসত। তাদের স্থায়ীভাবে উচ্ছেদের কোনো কেন্দ্রীয় পরিকল্পনা তখন ছিল না। ২০১৭ সালে ঘটে যাওয়া গণহত্যা, গণধর্ষণ, সামরিক বাহিনীকে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে ব্যবহারে একটি কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্তের নমুনা লক্ষণীয় হয়। দুঃখজনক, পৃথিবীর একাধিক শক্তিধর রাষ্ট্রও এ রোহিঙ্গা উচ্ছেদ অভিযানে মিয়ানমারকে অন্তত নৈতিক সমর্থন দেয়। রোহিঙ্গাদের আবাসভূমি আরাকান অঞ্চলটির ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব রয়েছে। সেখানে অনেকের রয়েছে অনেক ধরনের স্বার্থ। আর এর বলি রোহিঙ্গারা। এ বিশাল জনগোষ্ঠীকে বিতাড়নের দুই বছর পর চীনের সহায়তায় মিয়ানমার প্রত্যাবাসনের একটি উদ্যোগ নেয়। এর আগেও এরূপ একটি ব্যর্থ প্রয়াস চলেছিল।
এবার ২২ আগস্ট যাওয়ার কথা ছিল ৩ হাজার ৪৫০ জনের। একজনও যায়নি। মূলত নাগরিকত্বহীন অবস্থায় আবারও অনিশ্চিত জীবনের পথে পাড়ি জমাতে তারা নারাজ। প্রত্যাবাসন শুরুর প্রস্তাবিত দিনের সংখ্যাটা কম ছিল না। সফল হলে ক্রমান্বয়ে বাড়ত। তবে এ বিষয়ে সচেতন ব্যক্তিরা মনে করছেন, মিয়ানমার প্রত্যাবাসনে আন্তরিক নয়। আর আমরা ভুল কূটনীতির শিকার। পাশ্চাত্যের জোরদার একতরফা সমর্থন কেউ আমরা কাজে লাগাতে পারছি না। সমস্যাটির সঙ্গে বিশ্বরাজনীতি আজ জড়িয়ে গেছে।
এ দেশে রোহিঙ্গাদের শিবির ব্যবস্থাপনাও খুব নাজুক। সম্ভবত অধিকসংখ্যক হওয়ায় ক্যাম্পগুলোতে কোনো কার্যকর নিয়ন্ত্রণ নেই। যে কেউ আসা–যাওয়া করছে। রোহিঙ্গারাও যখন-তখন যাচ্ছে বাইরে। কয়েক শ এনজিওর কাজ কতটা যৌক্তিক, এ প্রশ্ন অনেকের। আমরা রোহিঙ্গাদের ঝুঁকির মুখে ঠেলে দিতে পারি না, এটা সত্যি। তেমনি সে ঝুঁকি কমানোর জন্য ইউএনএইচসিআরের ওপর কোনো চাপও দিতে পারছি না কেন, এটা বোধগম্য নয়। সম্ভবত আমাদের কূটনৈতিক নালাগুলো আজ পানিশূন্য। চীন মিয়ানমারের একনিষ্ঠ বন্ধু ও সমর্থক। আমাদের সঙ্গেও তাদের বন্ধুত্ব রয়েছে। তবে সেটাকেও আমরা তেমন কাজে লাগাতে পারিনি।
এই লোকগুলো মিয়ানমারের নাগরিক অধিকার ফিরে পেলে প্রত্যাবাসন তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হতে নিজে থেকেই ভিড় করবে অনেকেই। এ প্রচেষ্টা কতটা এবং কবে ফলপ্রসূ হবে, সেটা অজ্ঞেয়। আর কোনো রোহিঙ্গাকে তৃতীয় দেশে প্রত্যাবাসনের উদ্যোগও আমাদের জানামতে নেওয়া হয়নি। ভুটান থেকে বিতাড়িত প্রায় এক লাখ নেপালি উদ্বাস্তুকে কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র ও অস্ট্রেলিয়া মিলে স্থান করে দিয়েছিল। তেমনি এ ধরনের কিছু ব্যবস্থা রোহিঙ্গাদের জন্যও সম্ভব। আর আগের দুবারের রোহিঙ্গা সমস্যায় তাদের সংখ্যা, এ দেশে চলে আসার প্রেক্ষিত, মিয়ানমার সরকারের ভূমিকা, আন্তর্জাতিক পটভূমি থেকে এবারেরটি সম্পূর্ণ পৃথক ও বহুমাত্রিক। তাই এর সমাধানের প্রচেষ্টায় এ বিষয়গুলো বিবেচনায় নিতে হবে।
আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব
[email protected]