এরশাদবিহীন জাতীয় পার্টির কী হাল হবে
১৯৮১ সালের ১৮ অক্টোবর লন্ডনের গার্ডিয়ান পত্রিকায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর চিফ অব স্টাফ লে. জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের একটি সাক্ষাৎকার ছাপা হয়। সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন:
দেশে ভবিষ্যতে আর যাতে কোনো অভ্যুত্থান ঘটতে না পারে, সে জন্য সামরিক বাহিনীকে সরাসরি দেশের প্রশাসনে জড়িত রাখতে হবে। এটি করলে সেনাবাহিনীর লোকদের মনে দেশের স্থায়িত্ব রক্ষার দায় চাপবে। প্রশাসনের সঙ্গে নিজেরা জড়িত আছে বলে দেশের ভালো–মন্দের দায়দায়িত্ব তারা এড়াতে পারবে না। এতে অন্তত ক্ষমতা দখলের জন্য অভ্যুত্থান ঘটানোর নতুন কোনো প্রয়াস দেখা যাবে না।
জেনারেল এরশাদ তখন থেকেই জোরেশোরে মার্কটাইম শুরু করে দিয়েছিলেন। তাঁকে বেশি দিন অপেক্ষা করতে হয়নি। ১১ ফেব্রুয়ারি ১৯৮২ কয়েকজন জ্যেষ্ঠ সামরিক কর্মকর্তা বঙ্গভবনে গিয়ে রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবদুস সাত্তারকে ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়ার দাবি জানান। সাত্তার সরকারের পতন হলে যে সামরিক সরকার আসবে, এটা সবারই জানা ছিল। ‘শত্রুর শত্রু আমার বন্ধু’—এ আপ্তবাক্যটি তখন আওয়ামী লীগ মনেপ্রাণেই গ্রহণ করে। জাতীয় সংসদে বিরোধী দলের নেতা আসাদুজ্জামান খান সরকারের পদত্যাগ দাবি করে বলেন, এই সরকারের ওপর সেনাবাহিনীর আস্থা নেই। এরশাদ যখন দরজায় কড়া নাড়ছেন, তখন প্রধান বিরোধী দল আওয়ামী লীগ সাত্তারের বিএনপি সরকারের প্রতি অনাস্থা জানায় এবং ৭ মার্চ ১৯৮২, বায়তুল মোকাররম মসজিদ প্রাঙ্গণে এক জনসভায় সরকার উৎখাতের আহ্বান জানায়। (সূত্র: বাংলার বাণী, ৮ মার্চ ১৯৮২)।
২৪ মার্চ ভোরবেলায় সামরিক বাহিনী ক্ষমতা দখল করে। জেনারেল এরশাদ নিজেকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ঘোষণা করেন। জাতীয় সংসদ ভেঙে দেওয়া হয়। সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা দখলের পক্ষে বিচারপতি সাত্তারকে দিয়ে বেতার ও টেলিভিশনে একটি ভাষণ দেওয়ানো হয়। ওই দিন এক ভাষণে জেনারেল এরশাদ বলেন, ‘জনগণের ডাকে সাড়া দিতে হইয়াছে। ইহা ছাড়া জাতির সামনে আর কোনো বিকল্প ছিল না।’
এরশাদ মিথ্যা বলেননি। ক্ষমতাসীন বিএনপির একটি বড় অংশ পরিবর্তন চাইছিল। তারা এরশাদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিল। বিএনপিবিরোধী প্রায় সব রাজনৈতিক দল সাত্তার সরকারের পতন চেয়েছিল। সামরিক শাসন জারির পরপরই আওয়ামী লীগপন্থী দৈনিক বাংলার বাণী এরশাদের ক্ষমতা গ্রহণকে স্বাগত জানিয়েছিল। শেখ ফজলুল করিম সেলিম সম্পাদিত এ পত্রিকায় মোনাজাতরত এক নারীর ছবি ছাপা হয়—সামরিক আইন জারি হওয়ায় তিনি আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করছেন।
এরশাদ ৮ বছর ৮ মাস ১২ দিন ক্ষমতার শীর্ষে ছিলেন। তাঁর সামনে সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা অধিগ্রহণের দুটি মডেল ছিল—একটি আইয়ুব খানের এবং অন্যটি জিয়াউর রহমানের। দুটি মডেলে মিল অনেক। প্রথমে ক্ষমতার চাবিটি হাতে নেওয়া; তারপর একটি রাজনৈতিক দল তৈরি করা, নির্বাচন দিয়ে উর্দি ছেড়ে রাজনীতিবিদ হয়ে যাওয়া এবং নানান দলের নেতা, আমলা, ব্যবসায়ী ও বুদ্ধিজীবীদের উৎসাহ, উৎকোচ-সুবিধা দিয়ে নিজের বলয় বিস্তৃত করা। এ ধরনের পালাবদলের সময় অনেক নামজাদা ব্যক্তিকে ‘দেশের ডাকে সাড়া দিতে’ দেখা যায়। এ ক্ষেত্রেও তার ব্যত্যয় ঘটেনি।
জিয়াউর রহমান সামরিক শাসনের অধীনে রাষ্ট্রপতি ও সংসদ নির্বাচনে বিরোধী দলগুলোকে অংশগ্রহণ করিয়ে রাজনৈতিক বৈধতা পেয়ে গিয়েছিলেন। ১৯৮৬ সালে একই পরিস্থিতিতে অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও তার মিত্ররা অংশগ্রহণ করায় এরশাদ রাজনৈতিক বৈধতা পেয়ে যান এবং তাঁর শাসন প্রলম্বিত হয়।
জিয়াউর রহমানের মডেলের সঙ্গে এরশাদ মডেলের একটি বড় পার্থক্য হলো, জিয়া পুরো সামরিক বাহিনীকে আস্থায় নিতে পারেননি। তাঁর বিরুদ্ধে দেড় ডজন অভ্যুত্থান হয়েছিল। শেষটিতে তিনি নিহত হন। এরশাদ এ ক্ষেত্রে ভাগ্যবান। আইয়ুব খানের মতো তিনিও পুরো সামরিক বাহিনীকে সঙ্গে পেয়েছিলেন। আইয়ুবের পতন হয়েছিল তাঁর নিয়োগ করা সেনাপতি ইয়াহিয়া খানের দ্বারা একটি সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে। আর এরশাদকে বিদায় নিতে হয়েছে তাঁর নিয়োগ করা সেনাপতি জেনারেল নূরউদ্দীন এবং তাঁর সহযোগীরা তাঁর ওপর থেকে ‘সমর্থন প্রত্যাহার’ করে নেওয়ায়। দুটি ঘটনার প্রেক্ষাপট তৈরি করে দিয়েছিল ‘গণ–আন্দোলন’। আইয়ুব ও এরশাদ দুজনই সেনাবাহিনীর ‘বোঝা’ হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন।
রাষ্ট্রপতি এরশাদ ক্ষমতার চূড়া থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে পড়ে গিয়েছিলেন। ৬ ডিসেম্বর ১৯৯০। গ্রেপ্তারও হয়েছিলেন। জেলে আটক অবস্থায় পরপর দুটি সাধারণ নির্বাচনে পাঁচটি করে আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে বিপুল ভোটে জয়ী হয়েছিলেন। শহুরে মধ্যবিত্তের একটি অংশ তাঁর প্রতি যত
বিরূপই থাকুক না কেন, দেশের অনেক জায়গায় তাঁর একটি সমর্থকগোষ্ঠী তৈরি হয়েছিল। এটি বিশ্লেষণের দাবি রাখে।
বাঙালির সনাতন মনস্তত্ত্বে ‘নির্বাচিত’ সরকারের প্রতি একধরনের পক্ষপাত আছে। এ কারণে ‘অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলকারী’ হিসেবে এরশাদের ভাবমূর্তি নিতান্তই নেতিবাচক। কিন্তু তাঁর শাসনামলের স্কোরকার্ডটি নিতান্ত হেলাফেলার ছিল না। এ দেশের মানুষ কাজের চেয়ে নীতিনৈতিকতার ধার বেশি ধারে। ভালো কাজ করে নির্বাচনী দরিয়া পার হওয়া যায় না সব সময়। রাজনীতি অনেক সময় মুখ্য হয়ে দাঁড়ায়। এরশাদ অনেক ভালো কাজ করেছেন। কিন্তু রাজনীতিটি করেছেন মন্দ।
এরশাদ–পরবর্তী যুগে কোনো রাজনৈতিক দল এককভাবে সরকার গঠন করতে পারেনি। অনেক আসনে অল্প ভোটের ব্যবধানে প্রার্থীর জয়-পরাজয় নির্ধারিত হয়। ফলে এরশাদ এবং তাঁর গড়া জাতীয় পার্টি অনেক আসনে ফল নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। এ জন্য তাঁকে নিয়ে রশি টানাটানি হয়েছে দুই বড় দলের মধ্যে। এমনও দেখা গেছে, কেউ যদি এরশাদকে বগলদাবা করেছে, অন্য দলটি তখন রওশন এরশাদকে আঁচলে বাঁধার চেষ্টা করেছে। বড় দুই দল—আওয়ামী লীগ ও বিএনপির ক্ষমতায় যাওয়ার সিঁড়ি হিসেবে এরশাদকে ব্যবহার করেছে এবং সফল হয়েছে আওয়ামী লীগ। ক্ষমতাচ্যুত হয়েও এরশাদ এভাবেই ক্ষমতার বৃত্তে প্রবল প্রতাপে ঘুরে বেড়িয়েছেন তিন দশক। তাঁর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে একটি অধ্যায়ের যবনিকা পড়ল।
প্রশ্ন হলো, এরশাদের অনুপস্থিতিতে জাতীয় পার্টির কী হাল হবে। দলটি কি টিকে থাকবে, ভাঙবে, নাকি নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে? ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করেছিল জাতীয় পার্টির সমর্থন নিয়ে। এরপরও দলটি তিন টুকরা হয়েছিল। আবারও দল ভেঙে যাওয়ার কারণগুলো তৈরি হয়েছে। এ দেশে সব রাজনৈতিক দলই কমবেশি ব্যক্তি বা পরিবারকেন্দ্রিক। শীর্ষ নেতৃত্বের অবর্তমানে দল যে ছন্নছাড়া হয়ে যায়, তার প্রমাণ এর আগে আওয়ামী লীগ ও বিএনপিতে দেখা গেছে। তারা ঘুরে দাঁড়াতে পেরেছিল, কারণ তাদের স্পষ্ট রাজনীতি ছিল। বর্তমান জাতীয় পার্টির কোনো রাজনীতি নেই। শুরুর দিকে এরশাদ ‘জাতীয়তাবাদী’ রাজনীতির ঝান্ডা তুলে ধরে বিএনপির জায়গাটি দখল করতে চেয়েছিলেন। সেটি সফল হয়নি। এখন তারা আওয়ামী লীগের অনুগত হিসেবেই সংসদে আছে।
একটি বিরোধী দল না থাকলে সংসদের মানমর্যাদা থাকে না। অনুগত একটি বিরোধী দল পেয়ে আওয়ামী লীগ অনেক স্বস্তিতে আছে। অন্য কোনো ‘মারমুখী’ দল ওই জায়গাটি নিয়ে নিক, ক্ষমতাসীন দল সেটি চাইবে না। জাতীয় পার্টির সংহতি রক্ষা করার দায় এখন আওয়ামী লীগ তথা প্রধানমন্ত্রীর হাতে। তাঁর মনে কী আছে, আমরা তা জানি না। তবে দল আবার ভাঙলেও তারা সবাই মহাজোটে থাকবেন, যেমন ভেঙে যাওয়ার পর জাসদের দুই গ্রুপ এখনো ১৪–দলীয় জোটে আছে। এই বিবেচনায় সরকারের বর্তমান মেয়াদে জাতীয় সংসদের মধ্যে ভারসাম্যে হেরফের হবে না। আর জাতীয় পার্টির নেতারা তো বেশ সুখেই আছেন। গাছের ডালে বসে সে ডালটি তাঁরা কি কেটে ফেলবেন? তাঁদের এখন ইশপের ওই গল্পটি আবারও পড়া দরকার—একতাই বল!
মহিউদ্দিন আহমদ: লেখক ও গবেষক
[email protected]