সংকট উত্তরণে প্রয়োজন তাকওয়া ও আত্মশুদ্ধি
ইসলাম পরিপূর্ণ জীবনবিধান। আল্লাহর প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস, প্রিয় নবীজি (সা.)–এর সর্বোত্তম আদর্শ অনুসরণ ও জীবনে সর্বক্ষেত্রে বাস্তবায়ন এবং স্বীয় কৃতকর্মের জন্য পরকালে জবাবদিহি, পুরস্কারের আশা ও শাস্তির ভয়, সর্বোপরি মানবকল্যাণ ও সৃষ্টির উদ্দেশ্য সাধনই ইসলামের মূল শিক্ষা। নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘পাপাচারী যখন পাপাচারে লিপ্ত হয়, তখন সে মুমিন থাকে না; তার ইমান তার থেকে আলাদা হয়ে যায়, যতক্ষণ না সে তওবা করে অনুতপ্ত হয়’ (বুখারি, তিরমিজি, মুসলিম ও ইবনে মাজাহ)।
আল্লাহ রাব্বুল আলামিন সুরা ফাতিহায় মানুষকে হেদায়াতের প্রার্থনা শিখিয়েছেন, ‘ইহদিনাছ ছিরাতল মুছতাকিম’, অর্থাৎ ‘আমাদের সঠিক সরল পথ দেখান’ (সুরা-১ ফাতিহা, আয়াত: ৪)। এরই পরিপ্রেক্ষিতে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘এই কোরআন মুত্তাকিদের জন্য হেদায়াত সঠিক–সরল পথনির্দেশ’ (সুরা-২ বাকারা, আয়াত: ২)।
তাকওয়া অর্থ আল্লাহর ভয়। যাঁর মধ্যে আল্লাহর ভয় আছে, তিনি মুত্তাকি বা পরহেজগার। মুত্তাকির অপরিহার্য ৫টি বৈশিষ্ট্য হলো, ‘গায়েব বা অদৃশ্যে বিশ্বাস, সালাত কায়েম বা নামাজ প্রতিষ্ঠা, জাকাত বা পবিত্র দান, এই গ্রন্থ কোরআন অনুসরণ ও পূর্ববর্তী গ্রন্থগুলোর প্রতি সম্মান আর আখিরাত বা পরকালের প্রতি আস্থা বিশ্বাস। এরাই আছে সঠিক পথে, এরাই হবে সফলকাম’ (সুরা-২ বাকারা, আয়াত: ৩-৫)।
একজন প্রকৃত মুমিন তাকওয়া দ্বারাই পরিচালিত হন। তাকওয়া মানুষকে পাপ থেকে দূরে রাখে এবং সত্কাজে অনুপ্রাণিত করে। কোরআন কারিমে বলা হয়েছে, ‘তোমরা যারা ইমান এনেছ, তারা তাকওয়া অর্জন করো’ (সুরা-৩৩ আহজাব, আয়াত: ৭০)।
তাকওয়া মানে সতর্কতা, সাবধানতা, আত্মরক্ষা। ষড়্রিপু তথা: কাম, ক্রোধ, লোভ, মদ, মোহ, মাৎসর্য হলো মানুষের মানবীয় গুণাবলির শত্রু। যেসব গুণ বা বৈশিষ্ট্য মানুষের জ্ঞানকে বাধাগ্রস্ত করে, তাদের বলা হয় রিপু বা শত্রু। মানুষের মধ্যে এরূপ ছয়টি রিপু বা শত্রু রয়েছে। এগুলো মানব প্রবৃত্তিরই অংশ। এসবের সুনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার মানুষকে সুসভ্য ও উন্নততর করে। এগুলোর যথেচ্ছ ও অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার মানুষকে পশুরও অধম করে দেয়।
তাজকিয়া বা আত্মশুদ্ধি অর্থ সূচিতা, পবিত্রতা, মানোন্নয়ন, শ্রীবৃদ্ধি ইত্যাদি। তাজকিয়া হলো অভ্যন্তরীণ পবিত্রতা, আত্মিক উন্নতি, চারিত্রিক উৎকর্ষ। মূলত তাজকিয়া হলো মানব চরিত্রের নেতিবাচক গুণাবলি, যথা লালসা, অন্যায় বাসনা, পরনিন্দা, মিথ্যা, হিংসা, পরশ্রীকাতরতা, আত্মপ্রচার, অহংকার, কার্পণ্য ইত্যাদি থেকে মুক্ত হওয়া। একজন মুমিনের প্রকৃত সাফল্য তাজকিয়ার ওপরই নির্ভরশীল। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘প্রকৃত তারাই সফল হলো, যারা আত্মশুদ্ধি অর্জন করল’ (সুরা-৯১ শামছ, আয়াত: ৯)।
হজরত ইব্রাহিম (আ.) দোয়া করেছিলেন এই বলে, ‘হে আমাদের পরওয়ারদেগার! তাদের মধ্য থেকেই তাদের নিকট একজন পয়গম্বর প্রেরণ করুন, যিনি তাদের কাছে আপনার আয়াতসমূহ তিলাওয়াত করবেন, তাদেরকে কিতাব ও হিকমাত শিক্ষা দেবেন এবং তাদের পবিত্র করবেন’ (সুরা-২ বাকারা, আয়াত: ১২৯)।
ইহসান বা সত্যদর্শন সম্পর্কে আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তোমরা এভাবে আল্লাহর ইবাদত করো যেন তোমরা তাঁকে দেখছ; যদি তোমরা তাঁকে দেখতে না–ও পাও, তবে নিশ্চয়ই তিনি তোমাদের দেখছেন’ (বুখারি, খণ্ড: ১, হাদিস: ৪৮)। পঞ্চেন্দ্রিয়—চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা, ত্বক ও দেহের প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গের সঠিক সংযত ব্যবহার নিশ্চিত করাই হলো ইবাদত।
দেহ ও মনের পূর্ণ অংশগ্রহণে ইবাদত পালন করলেই তা পরিপূর্ণ ও ফলদায়ক হবে। মুখের বা জবানের ইবাদত হলো কুবাক্য ও কুকথা না বলা; পরচর্চা, গিবত, শেকায়াত ও পরনিন্দা থেকে বিরত থাকা। চোখের ইবাদত হলো হারাম দৃশ্য দেখা থেকে বিরত থাকা। কানের ইবাদত হলো হারাম শ্রবণ থেকে বেঁচে থাকা। হাতের ইবাদত হলো হারাম ধারণ ও হারাম স্পর্শ থেকে দূরে থাকা। পায়ের ইবাদত হলো অন্যায় পথে গমন বা পদার্পণ না করা। মন ও
মস্তিষ্কের ইবাদত হলো পাপ ও অন্যায় চিন্তা কল্পনা ও পরিকল্পনা থেকে মুক্ত থাকা। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘নিশ্চয়ই শ্রবণ, দর্শন ও চিন্তন—এর সব কটি
সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে’ (সুরা-১৭ ইসরা, আয়াত: ৩৬)।
এই দেহ ও অঙ্গপ্রত্যঙ্গ রোজ হাশরে কিয়ামতের দিনে শেষ বিচারে আমাদের বিপক্ষে সাক্ষ্য দেবে। কোরআনের ভাষায়, ‘আজ আমি তোমাদের মুখে সিলমোহর করে দিলাম, তাদের হস্তসমূহ আমার সঙ্গে কথা বলবে, তাদের চরণগুলো সাক্ষ্য দেবে তাদের কৃতকর্মের’ (সুরা-৩৬ ইয়াসিন, আয়াত: ৬৫)।
অধ্যক্ষ মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী: বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতির যুগ্ম মহাসচিব ও আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজমের সহকারী অধ্যাপক
[email protected]