নয়নের জন্য ক্রোধ, নয়নদের জন্য শোক

বরগুনার নয়ন বন্ড তার নায়ক জেমস বন্ডের মতো হতে পারেনি। আদতে এ কালের এ সমাজে বাস করে তার বয়সী তরুণের পক্ষে জেমস বন্ডকে জানা সম্ভব নয়। সেকালের বাঙালি বন্ড দস্যু মোহন বা দস্যু বাহরামকে চেনাও তার কপালে ছিল না। সে পাড়ার বা জেলা শহরের যেসব মাস্তানকে অনুকরণ করে বড় হচ্ছিল, তাদের কারও পক্ষেই বন্ড-বাহরাম হওয়া সম্ভব ছিল না। তারা বর্তমান দূষিত রাজনীতির পরগাছা। একসময় কাজে লাগে, কিন্তু প্রয়োজন ফুরোলেই উপড়ে ফেলতে হয়। কখনো প্রয়োজনের চেয়ে বেশি বাড় বাড়লে ছেঁটে ফেলতে হয়। নয়নের পৃষ্ঠপোষকেরা রিফাত খুন হওয়ার পর থেকেই তার পাশ থেকে সরে গিয়েছিল। এখন তো নয়ন বন্ডপর্ব চুকে গেছে। 

আলোচিত খুনি নয়ন ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়েছে। রিফাত হত্যার প্রসঙ্গ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়ে পড়লে পুরো জাতি নয়ন ও তার দোসরদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে ফুঁসে উঠেছিল। আমাদের দেশে সুবিচারপ্রাপ্তি নিয়ে মানুষের মনে ঘোরতর সন্দেহ আছে। পুলিশের সততা ও দক্ষতা নিয়ে যে সংশয়, তা বিচার বিভাগ পর্যন্ত বিস্তৃত। আমার ধারণা, দূরদর্শী বিবেকবান মুষ্টিমেয় মানুষ ছাড়া দেশের বাদবাকি মানুষ এতে সন্তুষ্টই হয়েছে। জনমতের এই গতিপ্রকৃতি পুলিশ ও জননেতারা ভালোই জানেন। ফলে দীর্ঘসূত্রী বিচারের প্রতীক্ষা থেকে তাঁরা সবাইকে মুক্তি দিতে চান বিচারবহির্ভূত পন্থায়। যেহেতু নয়ন বন্ডের জন্য কারও সহানুভূতি নেই, তাই অল্প কিছু মানুষের উদ্বেগ নিয়ে মাথা ঘামানোরও কিছু নেই। 

হয়তো অধিকাংশ মানুষ খুশিই হয়েছে। রাষ্ট্র প্রাণহীন সত্তা, অনুরাগ-বিরাগের ঊর্ধ্বে জনগণের ইচ্ছায় আইন দ্বারা প্রতিষ্ঠিত একটি প্রতিষ্ঠান। জনগণ অবশ্য রাষ্ট্রের মতো অনুরাগ-বিরাগের ঊর্ধ্বে আইন দ্বারা পরিচালিত হয় না। জনগণ প্রায়ই এবং প্রধানত আবেগ দ্বারা চালিত হয়, আর আবেগ সাধারণত ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর অনুরাগ-বিরাগের দ্বারাই প্রভাবিত হয়। এ জন্যই রাষ্ট্রকে মানবিক অনুরাগ-বিরাগের ঊর্ধ্বে থেকে কঠোরভাবে আইনের দ্বারা পরিচালিত হতে হয়। আইনের পথ থেকে বিচ্যুত হলে বা সংসারের অনুরাগ-বিরাগের প্রভাবে চালিত হলে রাষ্ট্র নিজের চরিত্র হারাতে থাকে। এভাবে চলতে থাকলে রাষ্ট্রের বিভিন্ন অঙ্গের মধ্যকার পারস্পরিক সম্পর্ক ও সম্পর্কের ভারসাম্য নষ্ট হয়। চোখ বুজে বলে দেওয়া যায়, বর্তমান বাংলাদেশে প্রশাসনযন্ত্র বা নির্বাহী অঙ্গ অন্য দুই অঙ্গের চেয়ে শক্তিশালী, প্রভাবশালী ও ক্ষমতাশালী হয়ে উঠেছে। বিগত জাতীয় নির্বাচনে প্রভাবক ভূমিকা পালনের মাধ্যমে তারা জনপ্রতিনিধিদের চেয়েও প্রতিপত্তিশালী হয়ে উঠেছে। আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রকৃত অর্থে গণতান্ত্রিক হতে পারে কি না, তা তাত্ত্বিক তর্কের বিষয়। তবে রাষ্ট্রে আইনের শাসন যে দুর্বল হয়েছে বা হয়ে চলেছে, সে বিষয়ে সংশয় নেই। 

আইনের শাসনের অভাব বা দুর্বলতার ফাঁক গলে সমাজে নানা অনাচার তৈরি হতে থাকে। রাষ্ট্রের তিন অঙ্গের সম্পর্কে ভারসাম্যের সমস্যা তৈরির মতো আইনের ফাঁক গলে যেমন, ‘ক্রসফায়ার, বন্দুকযুদ্ধ বা গোলাগুলি’র সংস্কৃতি তৈরি হচ্ছে, তেমনি এসব পন্থায় যারা নিকেশ হচ্ছে, তারাও তৈরি হচ্ছে। হয়তো একদল আইনের আশ্রয়ে থেকে এ সংস্কৃতিতে অংশ নিচ্ছে, আরেক দল আইনপ্রণেতাদের প্রশ্রয়ে থেকে আইন ভাঙছে। কে বেশি দায়ী, কে আগে কে পরে—এই ইঁদুর-বিড়াল বা টম অ্যান্ড জেরি গেমে সময় ব্যয় না করে কাজের কথায় আসা যাক। 

জার্মান মহাকবি গ্যেটে একটি কবিতায় লিখেছেন, ‘আত্মনিয়ন্ত্রণই শুধু মহত্ত্বের নিশ্চয়তা দিতে পারে।/ সীমা মানতে পারার মধ্যে প্রজ্ঞার পরিচয় মেলে,/ এবং অন্য কিছু নয়, শুধুই আইনই পারে আমাদের স্বাধীনতা দিতে।’ 

ইশপের গল্পেও জানা যায় খরগোশ খুব তৎপর চৌকস হলেও আখেরে বিজয়ী হয় ধীরস্থির কচ্ছপ। কচ্ছপের আয়ুও খরগোশের দশ গুণ হবে। আমরা কথায় কথায় রাষ্ট্রের দীর্ঘজীবন কামনা করে থাকি। বলি—বাংলাদেশ দীর্ঘজীবী হোক। তাহলে কিন্তু খরগোশের মতো অতি দৌড়ঝাঁপ বা লম্ফঝম্ফ বাদ দিয়ে খানিকটা কচ্ছপের মতোই ধীরস্থির বা দূরদর্শী প্রজ্ঞার সঙ্গে পথ চলতে হবে। সেটা অবশ্য আইনের শাসনে চলার পথ, যেমনটা ইশপের কচ্ছপ চলেছিল। 

আইনের শাসনে আসতে হলে নয়ন বন্ড তৈরি হওয়ার যে সামাজিক ব্যাধি ছড়িয়ে পড়েছে, সেদিকে নজর দিতে হবে। নয়ন যদি রোগবাহী জীবাণু হয়ে থাকে, তাহলে তার বাহক বাতাস বা জল হলো দেশের বর্তমান রাজনীতি। আমি বহুবার লিখেছি, নতুন যুগ এসেছে, কালান্তর ঘটেছে, তার সঙ্গে খাপ খাইয়ে পরিবর্তন আনতে হবে রাজনীতিতে। প্রযুক্তি ও জ্ঞাননির্ভর এ কালে আগ্নেয়াস্ত্র বা বাহুবলে কাজ হবে না। সাময়িক লাভ হলেও আখেরে খেসারত অনেক বেশি গুনতে হবে। এ কালে বাহু নয়, মস্তিষ্কই খাটাতে হবে। এমনকি এ কালের যুদ্ধেও বাহুবল গৌণ, মুখ্য হলো মেধার দৌড়। মেধা-বুদ্ধি-প্রজ্ঞা লাগবে, ঘৃণা–প্রতিহিংসা–লোভে কাজ হবে না। কিন্তু যেখানে মানুষ তৈরি হচ্ছে, সেই পরিবার, বিদ্যালয় কিংবা সমাজ গঠন-পুনর্গঠনের বিষয়ে যত কথা হচ্ছে, তত কি কাজের কাজ কিছু হচ্ছে? 

যদি একজন নয়ন শৈশবে এমন একটা বাড়ি পেত, যেখানে সে শান্তভাবের গান শুনতে পেত, চমৎকার ছবিওয়ালা বই পেত, মজাদার গল্প শুনতে পেত, যদি ছোটবেলায় এমন একটি পাড়া পেত, যেখানে অনেক সমবয়সী খেলার সাথি থাকত, থাকত মাঠ ও তাতে দৌড়ানো ও খেলার স্বাধীনতা; যদি এমন একটি স্কুল পেত, যেখানে পড়া মুখস্থ করার পরিবর্তে সে খেলত, গাইত, আবৃত্তি করত, গল্প শুনত ও বলত, বড় বড় মনীষীদের জীবনকথা শুনত, নিজ হাতে এটা-ওটা বানাত; যদি কৈশোরে সে কোনো সংগঠন পেত, যেখানে নানা কাজে, প্রতিযোগিতায়, অনুষ্ঠানে অংশ নিতে নিতে নিজের অনেক গুণের খবর পেত, তৃপ্ত হতো নিজেকে ছাপিয়ে তার বড় হওয়ার সাধ, পেত হাততালি, বাহবা আর দু–একটা পুরস্কার; আর সেই বয়সে সে যদি এমন দু–চারজন বড় ভাই-আপুর সান্নিধ্য পেত, যারা তার শৈশব-কৈশোরে পাশে থেকে কখনো আনন্দ দিয়ে, কখনো আশ্বস্ত করে, কখনো চমক দিয়ে, কখনো চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে তার বড় হওয়ার পথকে সুগম করে দিত! 

আমি নিশ্চিত, নয়ন এমন শৈশব, এমন কৈশোর পায়নি। শিশুরা সবচেয়ে বেশি শেখে দেখে দেখে, তারা অনুকরণ ভালোবাসে। নয়ন তার দেখা জীবন থেকেই শিক্ষা নিয়েছিল। সেই শিক্ষা তাকে কেবল বাঁচতে দেয়নি তা নয়, জীবনে এবং মরণে তার কপালে ধিক্কারই এনে দিয়েছে। এটি আদতে মানবতার পরাজয়ের কাহিনি। এই পরাজয় বস্তুত এই সমাজের, এই রাষ্ট্রের। এটি বাংলাদেশের দীর্ঘজীবিতার পথ নয়। হোঁচট আর হুমড়ি খেলে পতনই ঘটে, অপঘাত মৃত্যুর শঙ্কা বাড়ে। 

তাই বলব, এভাবেই যদি আমরা চলতে থাকি, নয়নদের ‘বড়’ হতে দিই, তবে পরিণতি এ রকমই ঘটবে। এ কেমন বাস্তবতা: দেশের উন্নয়ন ঘটছে মহাসমারোহে আর মানুষের ঘটছে অবনতি! মনুষ্যত্বের ঘটছে পরাভব! সমাজের উন্নয়ন ছাড়া বস্তুগত বা বহিরঙ্গের উপরিকাঠামোর উন্নয়ন টেকসই হতে পারে না। নজর দিতে হবে মানবসম্পদ উন্নয়নের দিকে। পদ্মা সেতুর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হলো স্কুলশিক্ষার মানোন্নয়ন, শিশু-কিশোর ছেলেমেয়েদের জন্য আনন্দময় জীবন নিশ্চিত করার কাজ। ভাবুন তো স্কুলগুলোর কথা—মাঠ, মিলনায়তন, মঞ্চ ছাড়া; গান-আবৃত্তি-চারুকলা-নাটক ছাড়া; খেলাধুলা-সাঁতার কাটা-গাছে চড়া ছাড়া; অফুরন্ত অবসর, গল্প শোনার আসর, নানান অভিযান ছাড়া; নিজস্ব সকাল-জ্যোৎস্না-সুনীল আকাশ ছাড়া; একজন প্রিয় আপু, প্রিয় দাদা-ভাইয়া ছাড়া কীভাবে কতটি প্রজন্ম কেবল পড়া-পরীক্ষার চাপে এবং অযত্ন-বেখেয়ালে বেড়ে উঠেছে এ দেশে। 

নয়নের প্রতি ক্রোধ ছিল, ক্রোধ নিয়ে লিখতে লিখতে ওর মতো ছেলেদের জন্য বড্ড মন খারাপ হয়ে গেল। উদ্বেগ বাড়ল দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে।


আবুল মোমেন কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক