আমার ছেলে খুন হয়েছে, আপনারা কি নিরাপদ?
আমার তরতাজা তরুণ সন্তান নির্মমভাবে খুন হয়েছে আর অনেকে আমাকে সান্ত্বনা দিতে এসে বলেছেন, ‘দেখেন গতকালও ছিনতাইকারীর ছুরিতে এক তরুণ নিহত হয়েছেন। ট্রেন থেকে ফেলে দিয়েছে আরেক তরুণকে।’ কী অদ্ভুত, কী নিষ্ঠুর তুলনা! সন্তানহারা পিতামাতার শোকের তুলনা হয় না। যার যার বুকের ধন যায়, কী ভয়াবহ শোকের আঘাত তাঁরা পান, তা কাউকে বোঝানো যাবে না। কিন্তু আমার ছেলের বয়সী আরও কয়েকজনকে মেরে ফেলা হয়েছে, সেই মৃত্যু দেখে আমাকে সান্ত্বনা পেতে হবে! মনে করতে হবে, আমিই একাই এমন শোকের শিকার নই, আরও রয়েছেন আমার মতোন দুর্ভাগা বাবা, ফাগুনের মার মতোন মা! হায়, আমরা এ কোন দেশে বাস করছি! কোন মৃত্যু উপত্যকায়!
হ্যাঁ, আমি নিহত তরুণ সাংবাদিক ইহসান ইবনে রেজা ফাগুনের দুর্ভাগা পিতা, আবারও লিখছি নিজ সন্তানের কথা। যে বাড়ি ফেরার পথে ২১ মে খুন হয়েছে অমানুষদের হাতে।
ফাগুন, তার সাংবাদিকতার জীবন শুরু করেছিল মাত্র ২১ বছর বয়সে। জন্মের পর জ্ঞান হতেই দেখেছিল দাদা সাংবাদিকতায়, বাবাও তা-ই। আরেক দাদাও ছিলেন নামকরা একজন। বংশ পরম্পরায় হয়তো সেও চলে এসেছিল এ পেশায়। বলতে গেলে, সাংবাদিকতায় চতুর্থ প্রজন্ম ছিল ফাগুন। হঠাৎ করেই কিংবা পথ ভুলে তার এ পেশায় চলে আসা নয়।
ফাগুন তার ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছিল, I’d rather die like a man, than live like a coward...। সে ‘কাওয়ার্ড’ হয়ে বাঁচতে চায়নি হয়তো। সে তার স্বল্পকালীন সাংবাদিকতার জীবনে কখনো আপস করেনি। বাচ্চা একটি ছেলেকে প্রলোভন দেখানো হয়েছিল যাতে সে একটি খবর নামিয়ে নেয় অনলাইন থেকে। প্রলোভনে টলেনি সে। নামিয়ে নেয়নি খবরটি। অবলীলায় লোভনীয় সেই প্রলোভন প্রত্যাখ্যান করেছিল ফাগুন। তারপর তাকে শাসানো হয়েছিল দেখে নেওয়ার। তাতেও সে ভয় পায়নি, কারণ সে কাওয়ার্ড হিসেবে বেঁচে থাকতে চায়নি। অথচ ওর বয়েসি কেন, অনেক বয়স্ক মানুষেরই ওই লোভ সামলানো কঠিন হতো বলে জানি। হ্যাঁ, আমি এমনই এক সাংবাদিক ইহসান ইবনে রেজা ফাগুনের বাবা। শোকে ভেঙে পড়া একজন মানুষ, সঙ্গে গর্বিতও। গর্বিত এই ভেবে, আমার শিক্ষাটা বৃথা যায়নি। ফাগুন তার ক্ষুদ্র জীবনে যত দিন বেঁচেছে, মানুষের মতোই বেঁচেছে, কাপুরুষের মতো নয়।
বয়সে অল্প হলেও সে কতটা ভালো ছিল তার কাজে, তা লিখেছেন প্রিয় ডটকমের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক তানজিল রিমন। তাঁর লেখার শিরোনাম ছিল, ‘ইংরেজি পত্রিকায় ভুল কেন, প্রশ্ন করেছিল ফাগুন।’ রিমন তাঁর লেখায় বলেছেন, ‘ফাগুন একটি বিশুদ্ধ ইংরেজি সংবাদমাধ্যম গড়তে চেয়েছিল।’ এটা কি তার ভুল ছিল? একজন ২১ বছরের ছেলে, যার হৈ-হল্লা করে দিন কাটানোর কথা, হুল্লোড় করার কথা। সে তা না করে, পড়াশোনার পাশাপাশি যোগ দিয়েছিল চাকরিতে, তাও সংবাদমাধ্যমে।
ফাগুন হত্যার পর অনেকে লিখলেন, ‘আর কোনো সন্তান যেন এ দেশে সাংবাদিকতায় না আসেন।’ খ্যাতনামা সাংবাদিক, লেখক মাসকাওয়াথ আহসান লিখলেন, ‘মৃত্যু উপত্যকায় ফাগুনের মৃতদেহ।’ নবারুণ ভট্টাচার্য হয়তো সেই আক্ষেপেই বলেছিলেন, ‘এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না/ এই জল্লাদের উল্লাসমঞ্চ আমার দেশ না/ এই বিস্তীর্ণ শ্মশান আমার দেশ না’।
অনেকে বলবেন, আমি সন্তান হারানোর শোকে এমনটা বলছি। তাঁদের প্রশ্ন করি, আমার সন্তানকে না হয় মেরে ফেলা হয়েছে, আপনার সন্তানটি নিরাপদ তো? হন্তারকদের পরবর্তীতে টার্গেট আপনার সন্তান নয় তো? আমি না হয় সাধারণ একজন মানুষ, ছা-পোষা সাংবাদিক। এ দেশে অনেক বড় বড় মানুষ রয়েছেন, যাঁরা নিরাপত্তা নিয়ে ঘোরেন, পুলিশি প্রটোকল রয়েছে। তাঁদের সবার সন্তানের জন্যই কি তেমন নিরাপত্তা রয়েছে? তাঁরা কি ঘোরার সময় পুলিশ প্রটোকল পায়? তাদের জীবন কি নিরাপদ? কেউ যদি ভাবেন তিনি নিরাপদ, তারা কি ঘোরের মধ্যে বাস করছেন না?
আমিও নিজেই নিজেকে এমন প্রশ্ন করি, কেন আমি? আমার কেন পুত্রশোক সইতে হবে! নিজ সাংবাদিকতার জীবনে সব সময় মজলুমের পাশে থেকেছি। কলামও লিখছি দীর্ঘদিন ধরে। সেই কলামে সব সময় মানুষের পক্ষে বলার চেষ্টা করেছি। কোনো পক্ষপাতিত্ব, অন্ধ আনুগত্যের ধার ধারিনি। তবে কেন আমার সন্তান এমন হত্যাকাণ্ডের শিকার হবে। আমার মতোন একজন সাংবাদিকের সন্তান, যে নিজেও কিনা সাংবাদিকতা করে, সে কেন নিশ্চিন্তে বাড়ি ফিরতে পারবে না। কেন যেকোনো মা-বাবার সন্তান বাড়ি থেকে বের হয়ে নিরাপদে বাড়িতে ফিরে আসবে না, প্রশ্নটা সে জায়গাতেই। আমরা কেন এত অরক্ষিত, কেন এত অনিরাপদ? এ কোন দেশে বাস করছি আমরা! তবে কি সত্যিই আমাদের দেশটি ক্রমে মৃত্যু উপত্যকা হতে চলেছে?
সবশেষে বলছি, সামনে ঈদ। আমারও আনন্দ করার কথা। আমার ছেলের কিনে আনা খাদি কাপড়ের পাঞ্জাবি তৈরি হয়েছে। আমরা বাপ-ছেলে সেই পাঞ্জাবি পরে নামাজে যাব, এমনি প্রত্যাশা ছিল। আমি চাই, আমার এই প্রত্যাশা ভঙ্গের ব্যাপারটি যেন অন্য কোনো মা-বাবার সঙ্গে না ঘটে। সবাই যেন নিজ সন্তানকে বুকে করে আনন্দে ঈদ করতে পারে। নামাজে গিয়ে পরম করুণাময়ের কাছে বলতে পারে, ‘হে পরোয়ারদিগার তুমি ভালো রেখো সবাইকে, কারও মা-বাবার বুক তুমি খালি কোরো না। কারণ এ কষ্ট সইবার ক্ষমতা কোনো মা-বাবার ক্ষুদ্র বুকেরই নেই।’
লেখক: সাংবাদিক ও কলাম লেখক।