এর নাম নিয়তি। এর নাম কপাল। এই গত বছরও যাঁর গোলাভরা ধান আর গোয়ালভরা গরু ছিল, সেই তাঁকেই এখন রাত কাটাতে হচ্ছে পরের গোয়ালঘরে। পদ্মার করালগ্রাসে সব গেছে। জমাজমি গেছে। বসতভিটা গেছে। ভিটার সঙ্গে ঘরবাড়িও গেছে। সহায়সম্পদ বলে কিছু নেই। এখন চোখের সামনে অনিশ্চয়তার ছবি আর পেটে উদগ্র ক্ষুধা। অথচ মানসম্মানবোধ আর চক্ষুলজ্জার কারণে কারও কাছে হাত পাতাও যাচ্ছে না। তাই খেয়ে না-খেয়ে কোনোরকমে দিন পার হচ্ছে।
শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার অনেক অবস্থাপন্ন পরিবারকে গত জুলাইয়ে নদীশিকস্তি হওয়ার পর থেকে এমন মানবেতর অবস্থার মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে। কেউ হয়তো পাশের গ্রামে কারও জমিতে কোনোরকমে চালা তুলে মাথা গুঁজেছেন। কেউ হয়তো ছোটখাটো কোনো ঘর ভাড়া নিয়ে উঠেছেন। নদীভাঙনের শিকার হওয়া লোকজনের মধ্যে যাঁরা আগে থেকেই দিনমজুরি করে জীবিকা নির্বাহ করতেন, তাঁদের চেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছে একসময়ের সচ্ছল কৃষক পরিবারগুলো। তাঁরা দিনমজুরিও করতে পারছেন না, আবার কারও কাছে হাতও পাততে পারছেন না। গত বছর নদীভাঙনের সময় মানুষের স্বাভাবিক ও স্বতঃসিদ্ধ প্রবণতা অনুযায়ী সংবাদমাধ্যমে যথেষ্ট হইচই হয়েছে। ভাঙনে নিঃস্ব মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্য সব মহল থেকে উচ্চ রব তোলা হয়েছে। এরপর যথারীতি নতুন নতুন ঘটনাক্রম উদিত হওয়ায় সেই সবহারা মানুষের কথা বিস্মৃতির চাদরে ঢাকা পড়তে শুরু করেছে। অথচ নদীভাঙনের সেই ক্ষতস্থান এখনো সেরে তো ওঠেইনি, বরং সরকারি সাহায্য দেওয়া বন্ধ হওয়ায় তা আরও মর্মান্তিক অবস্থায় চলে গেছে।
গত বছরের আগস্টে পদ্মার ছোবলে নড়িয়ার হাজার হাজার পরিবার সর্বস্বান্ত হয়েছে। প্রথম আলোর প্রতিবেদনে রানু বেগম নামের এক বৃদ্ধার নিঃস্ব হওয়া এবং জীবনের শেষবেলায় এসে অভাবের মুখে পড়ার গল্প যে কাউকে আপ্লুত করবে। বাস্তবতা হলো নড়িয়ায় এখন কয়েক হাজার ‘রানু বেগম’-এর দেখা মিলবে, যাঁরা নদীভাঙনে সব হারিয়ে নিদারুণ কষ্টে জীবন যাপন করছেন। সরকারি হিসাবেই, নড়িয়ার তিনটি ইউনিয়ন ও পৌরসভার দুটি ওয়ার্ডে ভাঙনে অন্তত ছয় হাজার পরিবার গৃহহীন হয়েছে। বিলীন হয়েছে স্থানীয় বাজারের সাড়ে তিন শ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের তিনতলা দুটি ভবনও বিলীন হয়ে যায়।
জেলা প্রশাসন ক্ষতিগ্রস্ত ৫ হাজার ৮১টি পরিবারকে প্রতি মাসে ৩০ কেজি করে চাল দিচ্ছিল। গত নভেম্বরের পর তা দেওয়া বন্ধ হয়ে গেছে। এর আগে ২ হাজার ৮২৫টি পরিবারকে দুই বান্ডিল করে টিন ও ছয় হাজার করে টাকা দেওয়া হয়েছিল। তবে যেহেতু এই পরিবারগুলো দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির মুখোমুখি হয়েছে, সেহেতু ক্ষতিপূরণের ধরনও দীর্ঘমেয়াদি হওয়া দরকার। কদিন বাদেই ঈদ। এই মানুষগুলো কীভাবে ঈদ উদ্যাপন করবে, এই পরিবারের শিশুগুলোর গায়ে নতুন পোশাক উঠবে কি না, তা নিয়ে ভাবা দরকার।