বাজারেও আগুন, ধানখেতেও আগুন!
এখন পবিত্র রমজান মাস। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সরকারি নির্দেশে খোলা বাজারে নিত্যপণ্য বিক্রি হচ্ছে। আর অবধারিতভাবেই লম্বা লাইন ধরে মানুষেরা সেসব পণ্য কিনছে। লাইনের দৈর্ঘ্যই বলে দেয়, বাজারে আগুন। মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত তাই লাজ ভুলে লাইন ধরেছে। ন্যায্য মূল্যে নিত্যপণ্য কিনছে তারা। মধ্যম আয়ের দেশে এও এক দৃশ্য বটে।
তবে এটিই শেষ নয়। রয়েছে আরও দৃশ্য। এই যেমন টাঙ্গাইলের কালীহাতিতে মালেক শিকদার যে দৃশ্যের জন্ম দিলেন। নিজের সোনার ধানে নিজেই আগুন দিলেন। (ইত্তেফাক; ১২ মে ২০১৯) সোনার ধান পুড়ছে সোনালি আগুনে! এই দৃশ্যের কার্যকারণেও জড়িয়ে আছে, ওই ন্যায্যমূল্য শব্দটি। শহুরে বাজারের আগুন থেকে বাঁচতে মানুষ যে লাইন ধরছে টিসিবি ট্রাকের পেছনে, আর কালীহাতির ধানের খেতে যে আগুন লাগছে, দুটিই নাকি ন্যায্যমূল্যের জন্য। অথচ এর একটি সত্য হলে, আরেকটির জন্মই হওয়ার কথা নয়। অথচ কী দারুণ, বাজার অর্থনীতি এই দুটিকেই একসঙ্গে একই মাত্রায় সত্য হিসেবে হাজির করছে আমাদের সামনে।
টিসিবির ট্রাকে চালও বিক্রি হচ্ছে। অর্থাৎ ভোক্তারা বাজারে ন্যায্যমূল্যে চাল পাচ্ছেন না। বেশি দামে কিনতে হচ্ছে। আবার কৃষক পাচ্ছেন না ধানের দাম। সরকার যে দর ঠিক করে দিয়েছে, তাতে মালেক শিকদারের মতো কৃষকদের পাকা ধানের মাঠে আগুন দেওয়া ছাড়া কিছু করার থাকছে না। কারণ ধান তুলতে যে খরচ, তা দিয়ে উৎপাদন ব্যয়ই উঠে আসছে না। আর তাঁর নিজের শ্রমকে ‘অমূল্য বলে অ-মূল্যে’ই কিনে নেওয়া হচ্ছে। কৃষক এই ধান তুলে আর কী করবেন, ভেবে পাচ্ছেন না। ফলে মালেক শিকদারের মতো কৃষক প্রতিবাদ হিসেবে নিজের মাঠে নিজেই আগুন দিচ্ছেন। আবার একই এলাকার আরেক কৃষক নিজের ফসল বিনা মূল্যে এলাকাবাসীকে দিয়ে দিচ্ছেন। এই যে এত এত ঘটনা ঘটছে, তাতে কিন্তু কারও কোনো হেলদোল নেই। থাকবেই বা কেন, ন্যায্যমূল্য না পেয়ে কৃষকদের এমন প্রতিবাদ তো আর নতুন নয়। কোনো বছর মহাসড়কে আলু ঢেলে দিয়ে প্রতিবাদ জানান কৃষক, কোনো বছর টমেটো। আর টিভি কিংবা সংবাদপত্রে ফলাও করে প্রচার করা হয়, অমুক ফসলের ‘বাম্পার ফলনের’ সুখী সংবাদ। এ তো একেবারে সাজেশন পড়ে কমন পড়ার মতো বিষয়।
‘ভরা ফসলের মাঠে যদি মৃত্যু হয় তবে আর দুঃখ কিসে!/ জেনে যাব শেষ হলো বেদনার দিন-ফসল ফলেছে মাঠে,’ হায় রুদ্র যদি জানতেন ভরা ফসলের মাঠের দৃশ্যকল্পই আর এখন ‘বেদনার দিন’ শেষ হওয়ার নিশ্চয়তা দেয় না। ভরা ফসলের মাঠই বরং পুষে রাখতে পারে অঢেল দুঃখের বীজ। রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ জানতেন না, জানবার কথাও নয়, খরা বা বন্যায় ফসলহানির জন্য হামেশাই হাহাকার ওঠা এই দেশে একদিন কৃষককেই দিতে হবে আগুন নিজের পাকা ধানের মাঠে।
অবশ্য পাটের যুগে সোনালি আঁশে হরহামেশাই লাগত সোনালি আগুন। এখন আর লাগে না। তবে পাটকল শ্রমিকদের জীবনের আগুন কিন্তু জ্বলছেই। খুলনায় যা হঠাৎ করে জ্বলে উঠতে দেখা গেল কিছুদিন আগে। এখনো এর সুরাহা হয়নি। আর এরই মাঝে আগুন জ্বলে উঠল ধানখেতে। এই দেশের কোন অংশটি ঠিক আগুনের হাত থেকে বাঁচতে পারছে, ঠিক করে বলা মুশকিল। অথচ এমন কথা ছিল না নিশ্চিত। ‘কথা ছিল রক্ত-প্লাবনের পর মুক্ত হবে শস্যখেত,/.../ আমাদের তীর্থ হবে শস্যপূর্ণ ফসলের মাঠ।’ কিন্তু সে কথা আমরা কেউ রাখিনি। তাই একদিকে ফসল তুলবার শ্রমিকের উচ্চ মূল্যকে দুষতে হয় ন্যায্যমূল্য না পাওয়া কৃষককে, অন্যদিকে কাজ না পেয়ে নগরমুখী হতে হয় শুধু শরীরটাকেই সম্বল করা অগণিত মানুষকে। অথচ এ দুই–ই হতে পারত পরস্পরের উপশম। কিন্তু বাজার অর্থনীতি প্রেসক্রিপশনের উন্নয়ন দিয়ে এ দুইকেই লুট করে চলেছে দারুণ দক্ষতায়।
অথচ এই সবকিছুই সহজ হয়ে উঠতে পারত। যদি সত্যটির দিকে তাকানো যেত। যদি তাকানো যেত, আমাদের কৃষকদের কী করে বনসাই করার চেষ্টা করা হয়েছে, তার দিকে। সেই বহুল কথিত ‘সবুজ বিপ্লব’ থেকেই তো কৃষক তাঁর সঞ্চিত জ্ঞান থেকে বিযুক্ত হলেন। তাঁকে বিযুক্ত করা হলো। বর্ধিত জনসংখ্যার চাপ সামলাতে উচ্চ ফলনের কথা বলে এই সবুজ বিপ্লবের দাওয়াইটি দেওয়া হলো। অথচ প্রশ্ন করা হলো না বণ্টন ব্যবস্থাকে। কৃষক প্রথাগত বীজ ব্যবস্থাপনা থেকে সরে আসতে বাধ্য হলেন। জমিকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হলেন সার-কীটনাশক, উন্নত বীজ ও বিপুল সেচের চাহিদার হাতে। আর এর মধ্য দিয়ে কৃষক একসময় বাধ্য হলেন বড় বড় সংস্থা ও করপোরেশনের আনুগত্য মানতে। এই গল্পকে ‘ধান ভানতে শিবের গীত’ মনে হলেও, সত্যি হচ্ছে এ ভীষণভাবেই প্রাসঙ্গিক। সে কথা থাক। শুধু বলি, গত শতকের মাঝামাঝি থেকে যে সবুজ বিপ্লবের যাত্রা শুরু, তা বৈশ্বিক পুষ্টি নিরাপত্তা কতটা দিতে পেরেছে, আর কতটা দিতে পেরেছে কৃষক তথা উৎপাদক পর্যায়কে নিরাপত্তা, এ দুইয়ের হিসাব মেলালেই প্রাসঙ্গিকতার সূত্রটি পাওয়া যাবে।
মোট কথা হচ্ছে, এই বিযুক্তি ও নয়া কৃষি ফসল এনে দিল ঠিক, কৃষকের দিন ফেরাল না। বরং রাষ্ট্র ও সংস্থার ওপর তার নির্ভরশীলতা বাড়ল। এটা এতটাই যে, সবকিছুর নিয়ন্ত্রণ শেষ পর্যন্ত কেন্দ্রের হাতে চলে গেল। সার থেকে শুরু করে সবকিছুর জন্য কৃষককে তাকিয়ে থাকতে হয় ওই কেন্দ্রের দিকে। আর কেন্দ্র শুধু চিন্তিত তার লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে। ওই লক্ষ্যমাত্রা পূরণে যারা উদয়াস্ত খেটে চলে, তাদের নিয়ে নয়। এ এমনই এক নির্ভরশীলতা, যার চূড়ান্ত ধাপে এসে দেখা মেলে এমন জেরবার কৃষকের, যে নিজের ধানের খেতে আগুন দিতে বাধ্য হয়। কারণ রাষ্ট্র চাল উৎপাদন সক্ষমতা বৃদ্ধির প্রচার যতটা করতে আগ্রহী, তার কারিগরদের বাঁচাতে ততটা নয়। রাষ্ট্র ঠিক ততটুকু তাদের বাঁচাতে আগ্রহী, যতটুকু না বাঁচালে নয়। তাই ন্যায্যমূল্য না পেয়ে ধানচাষির পথে বসা ও প্রতিবছর চালের আমদানি একই সঙ্গে চলতে পারে।
অবশ্য রাষ্ট্রকে তো আরও অনেককেই বাঁচাতে হয়। এগুলো নিছক সমীকরণ ছাড়া আর কিছু নয়। যদি তা না হতো, সার-কীটনাশক ও সেচনির্ভরতার জালে আটকে ফেলা কৃষিতে যান্ত্রিকীকরণ অনেক আগেই ঘটত, যাতে করে ফসল তোলার সময়ে অত্যধিক মজুরির ব্যয় নিয়ে ভাবতে না হয় কৃষককে। যদি তা না হতো, লাখো শিক্ষিত বেকারের এই দেশে কৃষি-শ্রমিকের হাহাকার লাগত না। যদি তা না হতো, বাজারের আগুন আর ধানখেতের আগুন এভাবে একই সঙ্গে জ্বলতে পারত না। আর সেই আগুনের ছবি সামনে রেখে আমরাও এভাবে নিস্পৃহ বসে থাকতে পারতাম না, যদি না সেই সফল সমীকরণ না থাকত! একটু হলেও বেদনা হতো। ধবধবে সাদা ভাতের আড়াল থেকে একবার হলেও উঁকি দিত মালেক শিকদারদের ভীষণ বেদনার্ত চোখ।
ফজলুল কবির: সাংবাদিক
ই-মেল: [email protected]