ধানের দাম নাই: জাগো বাহে কোনঠে সবায়
কুড়িগ্রামের এক কৃষক বাপ অনেক হাউস করে তাঁর ছেলেকে শহরের কলেজে পাঠিয়েছিলেন। দল না করায় কলেজের ছাত্রাবাসে তার ঠাঁই হয়নি। মেসে থাকতে হয় তাকে। মেসে খরচ বেশি, নিরাপত্তা কম। কৃষক বাবা তাতেও রাজি ছিলেন। ছেলের মাথা আছে, পড়াশোনা করুক। সাধারণভাবে চলে ছেলে। তাতেও মাসে লাগে চার হাজার। এত দিন কষ্টেশিষ্টে ভেঙে ভেঙে মাসে হাজার চারেক পাঠাতেন বাপ। এ মাসে সাকল্যে এক হাজার টাকা পাঠিয়ে মাফ চেয়েছেন কৃষক বাপ। যেন তাঁর অপরাধ, তাই মাফ চান অপরাধী!
বাপ কখন ছেলের কাছে মাফ চান? ধানের দাম পড়ে গেলে আর শ্রমের মজুরি না পেলে অসহায় বাপদের অপরাধী হওয়া ছাড়া আর উপায় কী?
এদিকে টাঙ্গাইলে আরেক দিশেহারা কৃষক ধানের দাম না পেয়ে রাগে-দুঃখে নিজের পাকা ধানখেতে নিজেই আগুন ধরিয়ে দিয়েছেন। ১২ মে দুপুরে টাঙ্গাইলের কালিহাতী উপজেলার পাইকড়া ইউনিয়নের বানকিনা গ্রামের কৃষক আবদুল মালেক সিকদারের খেতে আগুন দেওয়ার সে ছবি এখন সংক্রামিত সব মাধ্যমে। হতে পারে এটা একটা নিছক দৃষ্টিকাড়া মার্কা প্রতিবাদ। হতে পারে টাঙ্গাইলের লোকজন, যাঁরা টাঙ্গাইলের ছেলের কৃষিমন্ত্রী হওয়াটা পছন্দ করেননি, তাঁদের গোপন যোগসাজশ। হতে পারে বিদেশি মদদপুষ্ট দেশবিরোধী শক্তির এটা একটা অভিনব চাল। আবার প্রতিদ্বন্দ্বিতায় মত্ত করপোরেট কেরামতদের এক চমকে দেওয়া কারসাজিও হতে পারে এটা। ফটো তোলার পরেই আগুন নিভিয়ে দেওয়া হয়েছে। আর আগুনের খবর রাষ্ট্র হওয়ার ১২ থেকে ১৩ ঘণ্টার মধ্যেই এক করপোরেট দোকান কৃষক আবদুল মালেক সিকদারের বাকি সব ধান কিনে নিয়ে তাঁকে উদ্ধার করার অঙ্গীকার করেছে। দু-এক দিনের মধ্যে সেসব কাণ্ডের ছবি ছাপা হবে কাগজে, দেখানো হবে চ্যানেলে।
এসবের একটা বা সব কটিই যদি সত্য হয়, তারপরও এ কথা তো স্বীকার করতেই হবে ‘ঘটনা সত্য’। এবার ধানের দাম একেবারেই নেই। নানা অঞ্চলের কৃষকের সঙ্গে আলোচনার গড় করলে সরল হিসাবে এ বছর এক বিঘা বোরো জমি চাষ করতে কৃষকের খরচ হয়েছে প্রায় সাড়ে ১৩ হাজার টাকা। সে জমিতে ধান উৎপাদন হয়েছে ১৫ মণের মতো। প্রতি মণ ধান ৫০০ টাকা দরে বিক্রি করে কৃষক পাচ্ছেন সাড়ে ৭ হাজার টাকা। প্রতি বিঘায় কৃষকের লোকসান ৬ হাজার ২০০ টাকা। কোথাও কোথাও লোকসানের হার বিঘাপ্রতি হাজার টাকা। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে হিসাব নেওয়ার সময় টাঙ্গাইলের এক তরুণ কৃষক সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধিকে জানিয়েছেন, বীজতলা থেকে শুরু করে প্রতি মণ ধান ঘরে তুলতে হাজার টাকার অনেক বেশি খরচ হয়। কিন্তু ধান বিক্রি করছেন তার অর্ধেক দামে। এবার তাঁরা পথে বসে গেছেন।
শ্রমিকসংকট বাড়ছেই
এবার চড়া মজুরিতেও কিষান (ধান কাটা শ্রমিক) মিলছে না। পাওয়া গেলেও সবাই মজুরি চাইছেন নগদে। আগে কিষান বা কৃষিশ্রমিকেরা সারা দিন ধান কেটে পাঁচ কেজি চাল পারিশ্রমিক হিসেবে নিতেন। কৃষকের হাতে এ সময় নগদ টাকা থাকে না। তাই ধান বা চাল দিয়ে মজুরি শোধের রেওয়াজ ছিল। সে জায়গায় এখন সকাল আটটা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত ধান কাটার জন্য ৭০০ থেকে ১ হাজার টাকা মজুরি চাইছেন কিষান। ধানের ন্যায্য দাম না পেলে কোথা থেকে দেবেন নগদে মজুরি? এখন এক মণ ধান বেচেও কৃষক কৃষিশ্রমিকের পারিশ্রমিক দিতে পারছেন না।
আগাম নগদে রেখেছেন জমি। জমির মালিক এখন বিঘাপ্রতি পাঁচ হাজার থেকে সাত হাজার টাকা হাতিয়ে নেন চাষের শুরুতেই কৃষকের কাছ থেকে। কৃষক সেই টাকা আর বীজ-সার-সেচের টাকা আনেন এনজিওদের ঋণ প্রকল্প থেকে বা দাদনে চড়া দরে সুদসহ শোধ দেওয়ার অঙ্গীকারে। সে টাকা ফেরতের তাগাদা শুরু হয়েছে ইতিমধ্যেই।
দাম কেবলই পড়তির দিকে
এপ্রিলের শেষ সপ্তাহেও বাজারে নতুন ধান স্থানভেদে ৬০০ থেকে ৬৫০ টাকা মণে বিক্রি হয়েছে। আর এখন দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে নতুন চিকন ধান মাত্র ৫০০ থেকে ৫৫০ টাকা মণে বিক্রি হচ্ছে। গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে ধানের দর কমেছে ২৩ থেকে ২৫ শতাংশেরও বেশি।
সুনামগঞ্জে ব্রি–২৮ জাতের প্রতি মণ ধান ৫০০ থেকে ৫১০ টাকা, ব্রি–২৯ জাতের ধান ৪৫০ থেকে ৪৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। নেত্রকোনার অতিথপুর বাজারে যে ধান কদিন আগে মণপ্রতি ৫০০ থেকে ৫১০ টাকায় বিক্রি হয়েছে, এখন সেটাই বিক্রি করতে হচ্ছে ৪৫০ থেকে ৪৮০ টাকা দরে।
কেন এমন হচ্ছে
ধানের বাজার এখন ফড়িয়া আর চালকল মালিকদের হাতের মুঠোয়। সারা দেশের ধান-চালের বাজারে ফড়িয়ারা গুজব ছড়াচ্ছে, সরকার বিদেশ থেকে বেশি চাল আমদানি করায় গুদামে জায়গা নেই। তাই এবার বেশি ধান-চাল কিনতে পারবে না।
চালকলের মালিকেরা ধান ওঠার সময় ধান না কেনার ভান করে দামটা কমিয়ে রেখে সস্তা দরে ধান কেনার কৌশল গ্রহণ করেন। এবার তাঁরা একজোট হয়ে একেবারেই ধান কিনছেন না বলা চলে। অজুহাত—গুদামে জায়গা নেই, আগের মৌসুমের ধানই বিক্রি হয়নি, নতুন ধান দিয়ে করব কী?
সরকারিভাবে চাল কেনার ঘোষণা থাকলেও এখনো কেনার তোড়জোড় কোথাও শুরু হয়নি। সংবাদমাধ্যমকে কৃষিমন্ত্রী বলেছেন, ‘ফলন ভালো হলে দাম পড়ে যায়। এতে কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হন। এটা আমরা জানি। চাল রপ্তানি করে দাম বাড়ানো যায়। তবে এ নিয়ে মতবিরোধ আছে। কারণ, হঠাৎ সংকট দেখা দিলে ভয়ংকর বিপদ হবে। আমরা চিন্তা করছি কৃষকদের জন্য কিছু একটা করার। সারা দেশে বোরো ধান কাটা হচ্ছে। আমরা চেষ্টা করছি কৃষকদের ন্যায্যমূল্য দিতে। ধানের দাম নিয়ে সরকারের মধ্যে আলোচনা হচ্ছে।’
কী করা যায়
কৃষককে বাঁচাতে হলে কৃষিকে টেকাতে হলে নিষ্প্রাণ তাত্ত্বিক আলোচনা নয়, এখনই কিছু করা দরকার। কৃষিমন্ত্রী রপ্তানির কথা বলেছেন।
কৃষিবিদদের সংগঠন বাংলাদেশ কৃষি ও কৃষক বাঁচাও ফোরামের মহাসচিবের মতে, ধানের দরপতন ঠেকাতে চাল আমদানির ওপর আরও বেশি শুল্ক আরোপ করতে হবে। তা না হলে কৃষকেরা বারবার ধান উৎপাদনে লোকসান গুনলে একসময় তাঁরা ধান উৎপাদন থেকে সরে যেতে পারেন। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ দেশ আবার সংকটে পড়তে পারে।
ক্ষয়িষ্ণু কৃষক সমিতির নেতাদের ধারণা, সরকার দ্রুত ধান-চাল কেনার ব্যবস্থা করলেই ধানের বাজার আবার চাঙা হবে। মূলত, ধান কেনেন ফড়িয়ার মাধ্যমে চালকল মালিকেরা আর বড় বড় চাতাল মালিকেরা। চাল কেনার টাকা আসে গৌরীসেন তথা সরকারি–বেসরকারি ব্যাংক থেকে। যে উদারতায় আমরা ঋণ খেলাপিদের ক্ষমা করে দিচ্ছি, তার এক আনিরও কম উদারতায় বর্তমান সংকট উত্তরণের একটা ন্যায্য পথ বের করা সম্ভব। সরকার এখনই ব্যাংকগুলোকে তাদের খাতক চাতাল আর চালকল মালিকদের এই মাসের মধ্যে ধান কেনার শর্তে ৫ থেকে ৬ শতাংশ হারে সুদে বিশেষ ঋণ দিতে পারে। এই ঋণ শুধু ধান কেনার জন্য। শর্ত থাকবে, আমন ধান লাগানোর আগেই ঋণগ্রহীতাদের এই ঋণ শোধ করতে হবে।
কৃষক পিতাদের পাশে তাঁদের সন্তানদের দাঁড়াতে হবে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা এ বিষয়ে আন্দোলনে নেমেছেন। তাঁরা সংখ্যায় কম, কিন্তু বিষয়টি আশা–জাগানিয়া।
ঢাকায় বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ আওয়াজ তুলেছে। যদিও তাদের ফেসবুকের এখন আর কোনো হদিস নেই, তবু তারা ডাক দিয়েছে। মাওলানা ভাসানী নেই, কিন্তু আমাদের পিতা কৃষকেরা আছেন। এখনো কৃষি আছে। রাস্তায় ভয় থাকলে ১০ দিনের জন্য পিতাদের কাছে ফিরে গিয়ে কাস্তে হাতে ধান কেটে তাদের রক্তের ঋণের জবাব দিয়ে আসি না কেন? পিতা কেন সন্তানের কাছে মাফ চাইবেন স্বাধীনতার এত বছর পরে?
গওহার নঈম ওয়ারা: দুর্যোগ ব্যবস্থাপনাবিষয়ক লেখক ও গবেষক।
[email protected]