পুঁজিবাদের বসন্ত বনাম ক্রয়েৎসবার্গের গর্জন
মে দিবসের এখন আর সেই ধার নেই, সেই ভারও নেই। সংগঠিত শ্রমিক আন্দোলনের অগস্ত্যযাত্রার পর থেকে এ দেশে মে দিবস উদ্যাপন যেন নিতান্তই নিয়মরক্ষা। প্রতিবছর মে দিবসে পত্রিকার প্রথম পাতায় সেদিন ঘর্মক্লান্ত শ্রমিকদের ছবি ছাপিয়ে ফিচার থাকে। শোভাযাত্রা, আলোচনা-সেমিনার, নাটক, গান, ব্র্যান্ডসংগীত নিয়ে দিনটি বেশ ধুমধামেই কাটে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মে দিবসের শুভেচ্ছাও জানানো হয়। চারদিকে বেশ একটা মিষ্টি, উৎসব উৎসব ভাব। শ্রমিক-মালিক সবাই এককাতারে এই উৎসবে শামিল! লক্ষণ দেখে মনে হচ্ছে, শিগগিরই আমাদের দেশের মে দিবস উদ্যাপন ইউরোপ-আমেরিকার পয়লা মের ‘বসন্ত উৎসব’ উদ্যাপনের মতো একটা মজার ব্যাপারে পরিণত হতে পারে।
ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার নানা দেশে পয়লা মে বসন্ত উৎসব হিসেবে পালনের একটি রেওয়াজ আছে। রোমান পুষ্পদেবী ফ্লোরার উদ্দেশে নিবেদিত একটি উৎসব থেকেই হয়তো এই উৎসবটি এসেছে। মে দিবসের বসন্ত উৎসবে শোভাযাত্রা, নাচ-গান, বনফুল কুড়িয়ে আনা, তরুণীদের বসন্ত-রানি সাজানো এসব ব্যাপার থাকে।
গত শতাব্দীতে সোভিয়েত ইউনিয়ন, গণচীনসহ বিভিন্ন সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলে এবং তাবৎ দুনিয়াজুড়ে শ্রমিকশ্রেণির আন্দোলন গড়ে উঠলে, বিশ্বব্যাপী মে দিবস আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। সম্ভবত আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবসের গুরুত্ব কিছুটা কাটছাট করার জন্যই বসন্ত উৎসবের মতো একটি প্যাগান বা অখ্রিষ্টীয় উৎসবকে খ্রিষ্টান ইউরোপ-উত্তর আমেরিকায় গুরুত্ব দেওয়া শুরু হয়। আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবসের মিছিল-বিক্ষোভ মোকাবিলার জন্য বসন্ত উৎসবকে সরাসরি ব্যবহার করার নজিরও আছে। যেমন হয়েছে বার্লিনের ক্রয়েৎসবার্গে।
২.
জার্মানির রাজধানী বার্লিনের ক্রয়েৎসবার্গ এলাকায় প্রতিবছর মে দিবসে বিভিন্ন বামপন্থী দল ও গ্রুপ মিছিল, সমাবেশ, প্রতিবাদী গানের অনুষ্ঠান আয়োজন করত। ১৯৮৭ সালে ক্রয়েৎসবার্গের মে দিবসের মিছিলে পুলিশের সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের প্রচণ্ড সংঘর্ষ হয়। পুরো ক্রয়েৎসবার্গ এলাকা পরিণত হয় রণক্ষেত্রে। তারপর থেকে ক্রয়েৎসবার্গ এলাকা মে দিবসের বিক্ষোভের এক কেন্দ্র হিসেবে বিশ্বে পরিচিত হয়ে ওঠে। প্রতিবছর মে দিবসে গর্জে ওঠে ক্রয়েৎসবার্গ। সারা জার্মানি থেকে সাম্রাজ্যবাদ, পুঁজিবাদ, ফ্যাসিবাদবিরোধী বহু মানুষ এসে জড়ো হন ক্রয়েৎসবার্গের ‘পয়লা মে’র বিপ্লবী মিছিল’-এ। শ্রমিকদের অধিকার, বাসস্থান সমস্যা, অভিবাসীদের অধিকারের পক্ষে আওয়াজ তোলেন। আওয়াজ তোলেন বর্ণবাদ, ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে। প্রতিবছর এই ক্রুদ্ধ জনতাকে লাঠি, টিয়ার গ্যাস, জলকামান দিয়ে সামলাতে জার্মান পুলিশকে হিমশিম খেতে হয়।
এ কারণে জার্মানির পুলিশ এক কুটিল পন্থা অবলম্বন করে। তারা ক্রয়েৎসবার্গে ‘পয়লা মে’র বিপ্লবী মিছিল–এর কেন্দ্রস্থলে বসন্ত উৎসব বা ‘মে’ফেস্ট’–এর আয়োজন করে। মিছিল যে পথে যাবে, সে পথজুড়ে অন্য উৎসব! নাচ-গান ফুর্তি-ফার্তা, মদ্যপান, হইহুল্লোড়। এতে একেবারে যে কাজ হয়নি তা নয়। কিন্তু পাতানো জিনিস দিয়ে কি স্বতঃস্ফূর্ততা ঠেকানো যায়! পুলিশের চালে ক্রয়েৎসবার্গ নীরব হয়নি!
৩.
২০০৩ সালের মে দিবসে বার্লিনের ক্রয়েৎসবার্গের অপরাহ্ণ। একটি রাস্তার পাশে, দোকানের সামনে বসে গল্পগুজবে মশগুল নানা বয়সের তরুণ-তরুণী। বেশির ভাগই তুর্কি। আশপাশের ঘরবাড়ি দেখেই বোঝা যায়, এটি কোনো ধনী এলাকা নয়।
কিন্তু মিছিল-টিছিল তো দেখছি না! তবে কি যা শুনেছি ভুল? নাকি ভুল জায়গায় এলাম। কিন্তু তা হবে কেন? সকাল থেকে সারা বার্লিনের আজ অন্য রূপ দেখেছি। ‘POLIZEI’ লেখা সাদা-সবুজ পুলিশের গাড়ির ছোটাছুটি ছিল দিনভর। আর দাউদ হায়দারসহ অনেকেই তো বললেন, যা হওয়ার তা এই ক্রয়েৎসবার্গেই হবে।
তবে কি দেরি করে ফেললাম?
একজনকে জিজ্ঞেস করতে, সে বলল, ‘মিছিল? মিছিল তো দেখলাম একটু আগে চলে গেল।’
শুনে মেজাজটাই খারাপ হয়ে গেল। তবুও নিশ্চিত হওয়ার জন্য একটু এগিয়ে রাস্তার পাশে বসে আড্ডা দেওয়া কয়েকটা ছোকরাকে জিজ্ঞেস করলাম মে দিবসের মিছিল চলে গেছে কি না। আমার কথা শুনেই ছেলেগুলো ডাকতে শুরু করল, ‘আনা, আনা’।
এক দোকানের ভেতর থেকে বেরিয়ে এল এক তুর্কি নারী। বছর ত্রিশেক বয়স। শক্তসামর্থ্য চেহারা। ছেলেগুলো আমাকে দেখিয়ে জার্মান ভাষায় কী যেন বলল। বুঝতে পারলাম, ছেলেগুলো ইংরেজি বোঝে না। আনা ইংরেজি জানা মেয়ে।
আনা বলল, ‘মিছিল চলে গেছে, কিন্তু একটু পরই আবার ফিরে আসবে।’
আমার মুখে একটা আকর্ণ বিস্তৃত হাসি ফুটে উঠল। বুঝতে পারলাম, মিছিল এই এলাকাতেই চক্কর দেয়।
রাস্তায় দাঁড়িয়ে মিনিট দুয়েক কথা বলার পর আনা বলল, ‘এসো আমার সঙ্গে।’
ওর সঙ্গে যেখানে ঢুকলাম সেটা একটা চা–খানা। বার্লিনেও যে এমন সাধারণ চা-খানা আছে, তা এখানে না এলে জানতাম না। এ রকম চা-খানা ইরান-তুরস্কে খুবই জনপ্রিয়। লন্ডনের ব্রিকলেনের রেস্টুরেন্টে বসে চা–শিঙাড়া খেলে যেমন মনে হয় সিলেটের জিন্দাবাজারের কোনো রেস্টুরেন্টে বসে খাচ্ছি, এখানেও তুর্কিদের জন্য ব্যাপারটা একই রকম।
আনা এক গ্লাস রং চা এনে টেবিলে রাখল। টেবিলের অন্য তিনজনের হাতেও লাল চা। আলাপ শুরু হতেই বুঝলাম, কাকতালীয়ভাবে কোথায় চলে এসেছি। তিনজনের দুজন নেপালি। নেপালের মাওবাদী কমিউনিস্ট পার্টির সমর্থক। অন্য এক শহরে থাকে। মে দিবসের জন্য বার্লিনে এসেছে। কথা বলে বোঝা গেল, আমাদের উপমহাদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলন সম্পর্কে তারা ভালোই জানে। অপর জন কুর্দি। সেও এক কমিউনিস্ট কর্মী। কথা বলে মনে হলো কুর্দিস্থান কমিউনিস্ট পার্টি বা পিকেকের ভূমিকায় সে খুব হতাশ।
আনাও জানাল, তাদের হতাশার কথা। তুর্কি ও অন্যান্য অভিবাসীদের বিরুদ্ধে বৈষম্যের কথা। তার জন্ম জার্মানিতে কিন্তু সে জার্মান নাগরিকত্ব পাবে না। নাগরিকত্ব না পাওয়া মানে নানা অধিকার না থাকা। মে দিবসের মিছিলের কথা বলতে গিয়ে বলল, ‘এবার পুলিশ এখানে “মে ফেস্ট” চালু করার চেষ্টা করছে। এর উদ্দেশ্য হলো বামপন্থীদের মিছিল ঠেকানো। কিন্তু ঠেকাতে পারবে না।’
তখনই মিছিল ফিরে আসার শব্দ পাওয়া গেল। উঠে যাওয়ার সময় আনা বলল, ‘এদিকে কখনো এলে আমার খোঁজ কোরো। আনা বললে সবাই চিনবে।’
৪.
কয়েকটা খণ্ড খণ্ড মিছিল এগিয়ে চলেছে এক মিছিলে। মিছিলে নানা বর্ণের, নানা জাতি-গোষ্ঠীর মানুষ। কারও নাক-মুখ কাপড়ে ঢাকা, যাতে শনাক্ত করা না যায়। দুই নেপালি, এক কুর্দিসহ মে দিবসের মিছিলে ঢুকে গেলাম। স্লোগান হচ্ছে মুহুর্মুহু। কিন্তু কিছুই বুঝতে পারি না। একটু পর জার্মান ভাষায় শুরু হলো গান, ‘ইন্টারন্যাশনাল’। দেখলাম আমার পাশের নেপালিরাও গাইছে, কিন্তু নেপালি ভাষায়! কুর্দিও মনে হলো তার ভাষায়ই গাইছে। এই গানের সুর তো সারা বিশ্বের মানুষের জন্য একই। আমিও বাংলায় একই সুরে গলা খুলে গাইতে লাগলাম, ‘জাগো জাগো জাগো সর্বহারা/ অনশন বন্দী ক্রীতদাস।’
একটু পরই ঝামেলা বাধল। এগিয়ে গিয়ে দেখি পুলিশ পথ বন্ধ করেছে আর পুলিশের সঙ্গে মিছিলের প্রচণ্ড ধাক্কাধাক্কি শুরু হয়েছে। হঠাৎ আমার মাথার ওপর দিয়ে একটা কিছু উড়ে গিয়ে পড়ল পুলিশের মধ্যে। চারদিক থেকে আরও নানান উড়ন্ত বস্তু ছুটে গেল একই দিকে। মিনিটখানেক পরই টিয়ার শেল ফাটার প্রচণ্ড শব্দ।
এসব ক্ষেত্রে কী করতে হয়, শৈশব থেকেই তার ট্রেনিং ছিল। নজরুলও লিখেছেন, ‘থাকিতে চরণ মরণে ভয়, নিমিষে যোজন ফরসা, শ্রীচরণ ভরসা।’ উল্টো দিকে এক দৌড়ে আমি মুহূর্তে সেই চা-খানার সামনে। নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে যা দেখতে লাগলাম সংবাদপত্রের ভাষায় এর নাম ‘ধাওয়া ও পাল্টা–ধাওয়া’। তবে দুপক্ষই নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখছিল। হঠাৎ দেখি দাউ দাউ করে জ্বলছে পুলিশের গাড়ি!
পরদিন সংবাদপত্রের প্রথম পাতায় ক্রয়েৎসবার্গ। দাউ দাউ করে জ্বলা গাড়ির ছবি।
৫.
এবারের মে দিবসে বার্লিনে কোনো ব্যতিক্রম ঘটেনি। তবে এবার বিক্ষোভের স্থান ক্রয়েৎসবার্গ থেকে স্থানান্তরিত হয় পূর্ব বার্লিনের ফিড্রিখসহাইনে। কমপক্ষে ২০ হাজার বিক্ষোভকারী সেখানে জমা হয়। বিক্ষোভ ঠেকাতে সাড়ে পাঁচ হাজার পুলিশ নামে। পুলিশের সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের ধস্তাধস্তিও হয়। শুধু বার্লিন নয়, পুঁজিবাদবিরোধী বিক্ষোভ হয়েছে ইউরোপের নানান শহরে। সবচেয়ে বড় বিক্ষোভ হয়েছে প্যারিসে। সেখানে ৪০ থেকে ৫০ হাজার বিক্ষোভকারী রাস্তায় নামে। যাদের অনেকের পরনে ছিল হলুদ জ্যাকেট।
ইউরোপের নানা দেশে এবারও মে দিবসে বসন্ত উৎসব এক–আধটু হয়েছে বৈকি। কিন্তু তাতে না ছিল ধার, না ছিল ভার।
চৌধুরী মুফাদ আহমদ: প্রাবন্ধিক
[email protected]