আরব বসন্ত কি সফল হবে?

ছবি: রয়টার্স
ছবি: রয়টার্স

এটা এমন একজন নেতার পরাজয়ের গল্প, যিনি দীর্ঘদিন ধরে দেশের ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে ছিলেন। তিনি হলেন আলজেরিয়ার আবদেলাজিজ বুতেফ্লিকা। গত সপ্তাহে তিনি পদত্যাগ করার জন্য তাঁর সমস্ত দুর্বলতা নিয়ে হুইলচেয়ারে করে টেলিভিশনের সামনে হাজির হন। তিনি আলজেরিয়ার জনগণের কাছে দুঃখ প্রকাশ করেন, যারা কিনা তাঁর পদত্যাগ চেয়ে কয়েক সপ্তাহ ধরে সড়কে বিক্ষোভ করেছে। মূলত সেনাবাহিনীর চাপের কারণে ৮২ বছর বয়সী এই প্রেসিডেন্ট ২০ বছর ধরে আঁকড়ে রাখা পদ থেকে সরে যেতে বাধ্য হয়েছেন। অথচ ২০ বছর আগে তিনি এই সেনাবাহিনীরই পছন্দের মানুষ ছিলেন। সেনাবাহিনীই তাঁকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করেছিল। তবে বুতেফ্লিকার পদত্যাগ করায় কারও এ বিভ্রান্তির মধ্যে থাকা উচিত নয় যে আলজেরিয়ার সংকট একেবারে কেটে গেছে।

বুতেফ্লিকা ছিলেন সেই রোগের একটি বড় উপসর্গ, যা কয়েক দশক ধরে আলজেরিয়াকে কষ্ট দিয়েছে। তাঁর বিদায় দেশটিতে একটি নতুন যুগের সূচনা করার সুযোগ এনে দিয়েছে, কিন্তু সেটা তখনই ঘটবে, যদি আলজেরিয়া তার নিজের দুঃখজনক ইতিহাস থেকে এবং প্রতিবেশী দেশগুলোর ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নেয়।

আলজেরিয়া দীর্ঘ যুদ্ধের পর ষাটের দশকে ফ্রান্সের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে। এরপর ভঙ্গুর গণতন্ত্রের পথ ধরে ইসলামপন্থীরা ১৯৯১ সালের নির্বাচনে জয়ী হলে সামরিক বাহিনী হস্তক্ষেপ করে। এরপর গৃহযুদ্ধে এক দশকে প্রায় দুই লাখ মানুষ নিহত হয়। সেটি ছিল আলজেরিয়ার সবচেয়ে অন্ধকার সময়। এই প্রেক্ষাপটে আবদেলাজিজ বুতেফ্লিকা ১৯৯৯ সালে ক্ষমতায় আসেন। তাঁকে তখন আলজেরিয়ার উদ্ধারকর্তা হিসেবে তুলে ধরে সেনাবাহিনী।

আলজেরিয়ায় এত দিন মূলত শাসন করে এসেছে সেনাবাহিনীই। সামরিক কর্মকর্তাদের পাশাপাশি গোয়েন্দা কর্মকর্তা, ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ ও সরকারের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারাও ছিলেন ক্ষমতার পেছনে। তাঁরা বুতেফ্লিকাকে ব্যবহার করে নানা ধরনের ফায়দা লুটেছেন। চতুর্থ মেয়াদে বুতেফ্লিকা একই স্বার্থে আবদ্ধ একটি চক্রের জিম্মাদার হয়ে ওঠেন, যে চক্রটি তাঁর নামে ক্ষমতার অপব্যবহার করেছে। বুতেফ্লিকার ভাই সাইদ বুতেফ্লিকা পরিচালিত এই চক্রকে এখন শাস্তি ভোগ করতে হবে। তবে তার মানে এই নয় যে পরিস্থিতির খুব একটা উন্নতি হবে।

বুতেফ্লিকার শেষ দিনগুলোতে পুরোনো সামরিক বাহিনী–সমর্থিত গোষ্ঠীগুলো ক্ষমতার পরিবর্তন নিয়ন্ত্রণ করার জন্য অবস্থান নিচ্ছিল। একসময়ের প্রভাবশালী সামরিক গোয়েন্দাপ্রধান পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তির একজন সাবেক প্রেসিডেন্টকে দেশটির অন্তর্বর্তী সরকারের প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত করার পরিকল্পনা করেন। এতে সাইদ বুতেফ্লিকারও সমর্থন ছিল। কিন্তু সেই সাবেক প্রেসিডেন্ট লিয়ামাইন জেরুয়াল এই পরিকল্পনা নাকচ করে দেন। কিন্তু এই পরিকল্পনাকে সেনাপ্রধান আহমেদ গিয়াদ সালাহ তাঁর কাছ থেকে কর্তৃত্ব কেড়ে নেওয়ার কৌশল হিসেবে দেখেন।

বুতেফ্লিকার পদত্যাগের পর আলজেরীয়দের লক্ষ্য এখন তাঁর পুরো সরকারের পতন। আসলে আলজেরিয়ায় এখন একটি মৌলিক পরিবর্তন দরকার, যার ওপর জনগণ আস্থা রাখতে পারবে।

আশির দশকের শেষ দিকে আলজেরিয়ার গণতান্ত্রিক পরীক্ষা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ ছিল, যা কিনা একটি অসংলগ্ন ইসলামি দলকে ক্ষমতায় এনেছিল এবং দেশটিকে একটি সামরিক অভ্যুত্থানের দিকে পরিচালিত করেছিল, যা একটি রক্তাক্ত গৃহযুদ্ধের সূত্রপাত করে। বুতেফ্লিকার প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচন হয়তো আলজেরীয়দের সহিংসতা থেকে দূরে রাখতে পেরেছিল, কিন্তু রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা থেকে নয়।

এখন নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেই যে সব সমস্যার সমাধান হবে, বিষয়টি এমন নয়। কেননা, বিরোধীরা এখনো দুর্বল এবং বিভক্ত। বিক্ষোভ আন্দোলনের কোনো সুস্পষ্ট ও ঐক্যবদ্ধ নেতৃত্ব নেই। আর এ কারণে আলজেরিয়ার পর্যবেক্ষক ইসাবেল ওয়েরেনফেলস বলেছেন, প্রথম পদক্ষেপ হওয়া উচিত একটি বৈধ প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি করা, যেটা কিনা ক্ষমতার পরিবর্তনে নেতৃত্ব দেবে। একটি হতে পারে, একটি প্রেসিডেন্সিয়াল কাউন্সিল গঠন করা, যেখানে সব পক্ষ, যেমন বিক্ষোভকারী, ছাত্রনেতা ও সামরিক নেতারা থাকবেন।

পঞ্চম মেয়াদে প্রেসিডেন্ট হওয়া থেকে বুতেফ্লিকাকে ঠেকানোর লড়াইয়ে আলজেরীয়রা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিজয় পেয়েছে। আরেকজন আলজেরীয় বিশেষজ্ঞ হান্নাহ আর্মস্ট্রং বলেছেন, আগে অদৃষ্টবাদ ব্যাপারটা ছিল। কিন্তু এখন জনগণ মনে করে যে তারা ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করতে পারে। তবে যেমনটা মনে করা হচ্ছে, সেই কাঙ্ক্ষিত বিজয় এখনো অনেক দূরে। প্রতিবেশী তিউনিসিয়ায় বিপ্লব–পরবর্তী পরিবর্তন শুরু হয়েছিল একটি সাংবিধানিক পরিষদ গঠন এবং ঐকমত্যের অনুসন্ধানের মধ্য দিয়ে, জটিলতা সত্ত্বেও প্রক্রিয়াটি বিশ্বাসযোগ্য ছিল। এ রকম পদক্ষেপ আলজেরিয়াকেও নিতে হবে।

ফিন্যান্সিয়াল টাইমস থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনূদিত


রোলা খালাফ ফিন্যান্সিয়াল টাইমস–এর উপসম্পাদক