শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ সামাল দিতে না পেরে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ অনির্দিষ্টকালের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করে কার্যত স্বেচ্ছাচারী সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিয়েছে। এ ধরনের সিদ্ধান্ত শিক্ষা, শিক্ষার্থী কিংবা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান—কারও জন্য মঙ্গলজনক হতে পারে না।
বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বৃহস্পতিবার বিকেল পাঁচটার মধ্যে সব শিক্ষার্থীকে হলত্যাগের নির্দেশ দিয়েছে। আর সেই সিদ্ধান্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার হাসিনুর রহমান স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে সকাল আটটায়। মাত্র কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে শিক্ষার্থীদের হল ত্যাগ করতে বলা যেমন অগণতান্ত্রিক, তেমনি অমানবিক। দেশের দূরবর্তী অঞ্চল থেকে আসা অনেক শিক্ষার্থী এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। কিন্তু কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত সত্ত্বেও শিক্ষার্থীরা হল ত্যাগ করেননি। হলের প্রাধ্যক্ষরা শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনা করলেও লাভ হয়নি। শিক্ষার্থীরা তাঁদের দাবিতে অনড় রয়েছেন। তাঁরা বলেছেন, উপাচার্যকে তাঁর বক্তব্যের জন্য ক্ষমা চাইতে হবে।
আমরা উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ করছি যে একটি সামান্য ঘটনাকে কেন্দ্র করে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ পরিস্থিতি অত্যন্ত জটিল করে তুলেছে। পত্রিকার খবর থেকে জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ না জানানোয় শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে নেমেছেন। পরবর্তী সময়ে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের উপাচার্য ‘রাজাকারের বাচ্চা’ বলে গালমন্দ করলে তাঁরা আরও কঠোর কর্মসূচি নেন এবং উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিকে সামনে নিয়ে আসেন।
এ ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যে ব্যাখ্যা দিয়েছে, তা-ও অগ্রহণযোগ্য। স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে শিক্ষক, কর্মকর্তা, বিশিষ্টজন ও সাংবাদিকদের সম্মানে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আয়োজিত চা-চক্রে শিক্ষার্থীদের আমন্ত্রণ না জানানোর যৌক্তিকতা থাকতে পারে, কিন্তু তাঁদের বাদ দিয়ে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজনের বিষয়টিকে কোনোভাবেই জায়েজ করা যাবে না। শিক্ষার্থীরাই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণশক্তি, তাঁদের বাদ দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করার কথা ভাবল কীভাবে? শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের ধরন নিয়ে প্রশ্ন থাকতে পারে, কিন্তু এ জন্য উপাচার্য শিক্ষার্থীদের ‘রাজাকারের বাচ্চা’ বলে গাল দিতে পারেন না। উপাচার্য আত্মপক্ষ সমর্থন করতে গিয়ে বলেছেন, তিনি রাজাকারের বাচ্চা বলেননি। যাঁরা স্বাধীনতা দিবসে আন্দোলন করছেন, তাঁরা রাজাকারসদৃশ কাজ করেছেন। দুটির মর্মার্থে খুব পার্থক্য নেই। একজন উপাচার্য কীভাবে তাঁর শিক্ষার্থীদের প্রতি এমন ভাষা ব্যবহার করতে পারেন!
শিক্ষার্থীরা তাঁদের সম্মানিত শিক্ষকদের ভবনে আটকে রেখেছিলেন, এটি গর্হিত কাজ। তবে আগে ঘটে যাওয়া ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় শিক্ষার্থীরা কাজটি করেছেন। ক্রিয়া বাদ দিয়ে শুধু প্রতিক্রিয়াকে বিচার করার সুযোগ নেই। কোনো সমস্যা তৈরি হলে তা সমাধানের পথ হচ্ছে আলোচনা। ফলে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনা করে একটি সমঝোতায় আসার পথই কর্তৃপক্ষকে ধরতে হবে। শিক্ষার্থীরা আছেন বলেই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও উপাচার্য। ফলে তাঁদের বাদ দিয়ে বা নিজেদের মতো সিদ্ধান্ত নিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা কোনো কাজের কথা হতে পারে না। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের এটা বিবেচনায় নেওয়া উচিত যে ক্লাস ও পরীক্ষা বন্ধ কিংবা শিক্ষার্থীদের হল ত্যাগ করার নির্দেশ দেওয়া কোনো সমাধান নয়। ক্লাস বন্ধের ক্ষতিটি কর্তৃপক্ষ আমলে না নিলেও শিক্ষার্থীদের নিতে হয়।
বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষের কাছে ধৈর্য ও বিচক্ষণতার পরিচয় প্রত্যাশিত। আইনে আছে বলেই কথায় কথায় তারা বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করতে পারে না। উপাচার্য বলেছেন, তাঁরা যখন শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনা করতে চেয়েছেন, শিক্ষার্থীরা রাজি হননি। আমরা মনে করি, বর্তমান পরিস্থিতিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের অচলাবস্থা নিরসন করতে চাইলে কর্তৃপক্ষের উচিত শিক্ষার্থীদের প্রতি হলত্যাগের পূর্বতন নির্দেশ প্রত্যাহার করা, অবিলম্বে বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দেওয়া এবং আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের পথ খোঁজা।