সংগঠকেরা কেন ভয়ে থাকবেন?

ন্যূনতম মজুরির দাবিতে পোশাকশ্রমিকদের বিক্ষোভ
ন্যূনতম মজুরির দাবিতে পোশাকশ্রমিকদের বিক্ষোভ

সিলেট এমসি কলেজের মেধাবী ছাত্র ছিলেন হবিগঞ্জের সৌমিত্র কুমার দাশ। সেখান থেকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। পদার্থবিজ্ঞানে উচ্চতর লেখাপড়ার সময়ই স্থির করেছিলেন ক্যাম্পাসের আশপাশের শ্রমিক এলাকায় তাঁদের অধিকারের জন্য কাজ করবেন। তা-ই করছেন এখন সাভার-আশুলিয়া-ধামরাইয়ে। সমাজতান্ত্রিক শ্রমিক ফ্রন্টের একজন আঞ্চলিক সংগঠক তিনি।

সৌমিত্রর সঙ্গে গল্প করতে বসলেই বোঝা যায়, চেনা সমাজের এক অচেনা তরুণ তিনি। ধীর, একাগ্র এবং বিশ্বাসে অটল।

কিন্তু সৌমিত্রর দিন কাটে ভীতি আর আতঙ্কে। পোশাকশ্রমিকদের ২০১৬ সালের ডিসেম্বরের আন্দোলনকালে তাঁর বিরুদ্ধে ৯টি মামলা হয়। অধিকাংশই বিশেষ ক্ষমতা আইনে। বৈঠকের কথা বলে সৌমিত্রসহ আরও আটজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। কয়েক মাস পর ছাড়া পান। আটক ও মুক্তির মধ্যপথে রয়েছে ভীতিকর অনেক অভিজ্ঞতা। জামিনে মুক্তি পেলেও গত দুই বছর মাসে-মাসে ঢাকায় এসে প্রতি মামলায় হাজিরা দিতে হয়েছে। আটটি মামলায় ‘ফাইনাল রিপোর্ট’ থেকে এ পর্যন্ত নিষ্কৃতি পেয়েছেন। এখনো ঝুলছে একটি মামলা। এই সংগঠকেরা কেউই জানেন না, তাঁদের কী অপরাধ, অনিয়মতান্ত্রিক কী করছেন তাঁরা।

সৌমিত্র বলেন, সংবিধান ও বিদ্যমান আইনকানুন মেনে কাজ করতে চাইলেও সাভার-আশুলিয়া-ধামরাইয়ে শ্রমিক অধিকারবিষয়ক সভা-সমাবেশ-সেমিনার করা যায় না। কারখানা পর্যায়ে শ্রমিক ইউনিয়ন গঠনও দুঃসাধ্য। তারপরও মাঝেমধ্যে শ্রমিকেরা স্বতঃস্ফূর্তভাবেই আন্দোলন-সংগ্রামে নেমে পড়েন। গত সপ্তাহে তেমনই ঘটল।

তবে মালিকপক্ষ ও প্রশাসন মনে করে, এসব আন্দোলনের দায় শ্রমিক সংগঠকদের। ফলে হুমকি আসে। ভীতি বাড়ে। প্রশাসনের নানা কর্তৃপক্ষ সৌমিত্রদের মানসিক চাপে ফেলে। এলাকায় গিয়ে শ্রমিকদের ‘শান্ত’ করতে বলা হয়। অথচ প্রকৃত শান্ত অবস্থায় এই শ্রমিকদের ন্যূনতম সংগঠিত করতেও কখনো অনুমতি মেলে না।

 ২.

২০১৬ সাল থেকেই সাভার-আশুলিয়া-ধামরাই শিল্পাঞ্চলে ট্রেড ইউনিয়নধর্মী নিয়মতান্ত্রিক কাজের সুযোগ কম। অভিযোগ আছে, কারখানা পর্যায়ে কোনো কর্মী ‘ইউনিয়ন’ গঠন করতে আগ্রহী হয়ে প্রকাশ্যে যোগাযোগ করলেই চাকরিচ্যুত হন। অন্যত্র চাকরি পাওয়াও তাঁর জন্য অসম্ভব হয়ে ওঠে। এ রকম ভীতিকর অভিজ্ঞতার কারণে শ্রমিকেরা এখন আর ইউনিয়ন করার কথা ভাবেন না। এর ব্যতিক্রম আছে সামান্যই। এই এলাকার সহস্রাধিক কারখানায় শ্রমিক ইউনিয়ন আছে বড়জোর ৫০টিতে। সক্রিয় ইউনিয়ন আছে মাত্র চার-পাঁচটি কারখানায়। শ্রমিক ইউনিয়নের বিকল্প হিসেবে ‘পার্টিসিপেটরি কমিটি’র নামে যে নিরীক্ষা চালানো হয়েছে, তা শ্রমিক-মালিক কারও কাজে আসছে না।

ফল হয়েছে এই, সংগঠন ও নেতৃত্বহীন শ্রমিকেরা অনেক সময়ই হঠাৎ হঠাৎ বিদ্রোহ করে বসছেন। ২০১৬ সালে এ রকম হয়েছে, ২০১৯ সালের শুরুতেই আবার হলো। এ রকম স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন সামাল দিতে মালিকপক্ষ নির্ভর করতে চায় মূলত সরকারি প্রশাসন ও নিজস্ব নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর। অথচ বিশ্বজুড়ে শ্রম-সমস্যা নিরসনের স্বীকৃত ব্যবস্থা ত্রিপক্ষীয়। সরকার-মালিক-শ্রমিক—এই ত্রিপক্ষীয় কাঠামো বাংলাদেশে গড়ে উঠতে না দেওয়া একধরনের অস্বাভাবিকতা। এটা মূলত অস্বাভাবিক মুনাফার লোভ থেকেই সৃষ্ট। এটা সুস্থ শিল্পবান্ধব পরিবেশ গড়ে তুলছে না। বরং সরকারকে বিব্রত করছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে দাঁড় করাতে হচ্ছে দরিদ্র শ্রমিকদের বিরুদ্ধে। বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের শিল্প খাতের ভাবমূর্তিও ক্ষুণ্ন হচ্ছে।

তুলনা করলে দেখা যায়, ঢাকার পাশে নারায়ণগঞ্জ শিল্পাঞ্চলে সাভারের চেয়ে কঠোরতা কম। নারায়ণগঞ্জ শিল্পাঞ্চলে শ্রমিক ইউনিয়ন সংগঠকেরা কিছু কাজ করতে পারছেন। ফলে সেখানে হঠাৎ হঠাৎ আন্দোলনের ঘটনাও কম। সাভারের ট্যানারি শিল্পাঙ্গনেও শ্রমিকেরা শান্ত। সেখানেও শ্রমিক সংগঠকদের কাজের নিয়মতান্ত্রিক সুযোগ আছে। এসব বিকল্প দৃশ্য জানাচ্ছে, স্বাভাবিক ট্রেড ইউনিয়ন ও শ্রমিকদের নিয়মতান্ত্রিক নেতৃত্ব শিল্প বিকাশের সহায়ক শর্ত হয়ে ওঠে।

 ৩.

প্রাতিষ্ঠানিক পথে শিল্প-সম্পর্ক কীভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, তার একটি দৃষ্টান্ত তুলে ধরলেন গার্মেন্টস শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সংগঠক জলি তালুকদার। তিনিও শ্রমিক অঙ্গনে এসেছেন সমাজ রূপান্তরের স্বপ্ন থেকে। ১৯৯৫ সালে উচ্চমাধ্যমিক শেষে গণিতশাস্ত্রে গ্র্যাজুয়েশন করেন। ২০০৫ সাল থেকে শ্রমিকদের অধিকারভিত্তিক কাজে যুক্ত। শ্রমিক অঙ্গনে নিয়মতান্ত্রিক পন্থায় সংগঠন করা, কথা বলা, দাবিদাওয়া নিয়ে দর-কষাকষি যে কত দুরূহ, তার একটি নজির হিসেবে রামপুরার আশিয়ান ফ্যাক্টরির বিবরণ দিলেন। এই তৈরি পোশাক কারখানায় অধিকাংশ শ্রমিক যখন ইউনিয়ন করতে চাইলেন, তখন ২০১৭ সালে সংশ্লিষ্ট সরকারি দপ্তরে সব নিয়ম মেনেই আবেদন করা হয়। তারপর মাসের পর মাস ধরে চলে সেই আবেদনে নানা ত্রুটিবিচ্যুতি খোঁজার পালা। ত্রুটিবিচ্যুতি দূর করে পরপর তিনবার আবেদন করেও কারখানায় শ্রমিক ইউনিয়ন গঠনের অনুমতি মেলেনি। উল্টো যেসব শ্রমিক ইউনিয়ন করতে চেয়েছিলেন, তাঁরা ধাপে ধাপে চাকরিচ্যুত হয়েছেন। একপর্যায়ে কারখানাটিই বন্ধ করে দেওয়া হয়। এ নিয়ে প্রতিবাদ হয়; সংঘাত বিজিএমইএ ভবন পর্যন্ত গড়ায়। শেষ পর্যন্ত গত বছরের এপ্রিলে ৯ সংগঠকের বিরুদ্ধে মামলা হয়। মামলায় জামিন চাইতে গেলে সংগঠকদের কারাগারে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। উচ্চ আদালতের হস্তক্ষেপে তাঁরা জামিন পেলেও মামলাটিতে প্রতি মাসে হাজিরা দিয়ে চলেছেন জলি তালুকদারসহ সবাই।

শ্রম আইনে প্রদত্ত স্বাভাবিক অধিকারগুলো চর্চা না করতে দিলে পরিস্থিতি কীভাবে বিকৃত, জটিল ও দুর্বিষহ হয়, তার নজির আশিয়ান গার্মেন্টস। কিন্তু ইতিহাসের শিক্ষাই এই—ইতিহাস থেকে কেউ শেখে না। গার্মেন্টস শ্রমিক সংহতির তাসলিমা আখতারও তা–ই মনে করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লোকপ্রশাসনে পড়তেন এই খ্যাতনামা আলোকচিত্রী। তখনই যুক্ত ছিলেন বস্তি উচ্ছেদবিরোধী সংগ্রামে ও ভাসমান শ্রমিকদের আন্দোলনে। ছাত্ররাজনীতি শেষে যুক্ত হন পোশাকশ্রমিকদের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে। তাঁর বিশ্বাস ছিল, গণতন্ত্রের বিকাশে শিল্প খাতের গণতন্ত্রায়ণ বিশেষ অবদান রাখবে। এখনো সেই বিশ্বাস নিয়ে পথ চলেন তিনি। কিন্তু তিনি বললেন, মাঠের পরিস্থিতি স্বাভাবিক কর্মকাণ্ডকে প্রতিনিয়ত বাধাগ্রস্ত করে চলেছে। তাসলিমা মনে করেন, প্রশাসন বা বাহিনী-নির্ভরতার বদলে সৎ ও সুস্থ ধারার শ্রমিক সংগঠকদের ব্যবহার করে অনেক সুন্দরভাবে পোশাক খাতের শিল্প-সম্পর্ক পুনর্গঠন সম্ভব।

কিন্তু হচ্ছে তার বিপরীত। শ্রমিকেরা যখনই দাবিদাওয়া নিয়ে কথা বলতে চান, তখনই তাঁদের মোকাবিলা করার জন্য ডাকা হয় সম্পূর্ণ ভিন্ন শক্তিকে। আশুলিয়ার আন্দোলন সম্পর্কে ঢাকায়ও অনেক সময় সংবাদ সম্মেলন করতে দেওয়া হয় না বলে অভিযোগ করলেন তাসলিমা। তাঁর অভিজ্ঞতায়, গত দু-তিন বছরে আশুলিয়া-সাভার-ধামরাইয়ে শ্রমিক সংগঠনগুলো মে দিবস পালন ছাড়া আর কোনো কাজের সুযোগ পায়নি। সংগঠনগুলোকে অফিসের জন্য বাড়ি ভাড়া দিতে বাড়িওয়ালাদের নিষেধ করা হয়। সংগঠকদের নিকটাত্মীয়রাও হুমকি থেকে রেহাই পান না।

বলা বাহুল্য, বাংলাদেশের শ্রমিক অঙ্গনের আজকের ভঙ্গুর ভাবমূর্তির বড় বিকল্প হওয়া সম্ভব জলি তালুকদার, তাসলিমা আখতার ও সৌমিত্র কুমারদের। উচ্চতর শিক্ষার পরিণত বোধ, দেশপ্রেম ও শ্রমিকদের মঙ্গলচিন্তার সমন্বয়ে তাঁরাই হতে পারতেন শিল্পাঙ্গনে মালিকপক্ষের সঙ্গে সংলাপের শোভন প্রতিপক্ষ।

পুঁজিতান্ত্রিক উৎপাদন সম্পর্কে শ্রমিক-মালিক স্বার্থ বিপরীতধর্মীই। তবে শ্রম আইনের পরিসরে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে ত্রিপক্ষীয় সংলাপে দাবিদাওয়ার অর্থনৈতিক অংশ অনেকখানি মীমাংসাযোগ্য। দেশে-দেশে তা হচ্ছে। বাংলাদেশেও সে ঐতিহ্য ছিল, অনেক খাতে এখনো আছে। কিন্তু পোশাকশিল্পে জলি, তাসলিমা, সৌমিত্রদের বিকল্প হয়ে আছে সহিংসতা, পোষা শ্রমিক সংগঠন ও মিথ্যা প্রচারণা। ফলে সাভার-আশুলিয়া-ধামরাইয়ে শ্রমিকেরা কারখানা ছেড়ে দিনের পর দিন যখন বাইরে থাকেন, তখন তাঁদের সঙ্গে কথা বলার মতো প্রতিনিধি পাওয়া যায় না। প্রতিনিধি তৈরির চেষ্টাও নেই।

কিন্তু সহিংসতার পথে শান্তিপূর্ণ শিল্পাঙ্গন গড়া কতটা সম্ভব? বিশ্বের কোথাও সে রকম টেকসই কিছু আছে কি?

 আলতাফ পারভেজ গবেষক