২০৩২ সালের মধ্যে বাংলাদেশ ২৫টি বড় অর্থনীতির দেশের একটি হবে—এই তথ্য যে চমকপ্রদ, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ২০৩৩ সালের মধ্যে আমাদের পেছনে থাকবে সুইডেন, সুইজারল্যান্ড, ভিয়েতনাম ও দক্ষিণ আফ্রিকার মতো দেশগুলো—এটা ভাবলে যুগপৎ বিস্মিত ও রোমাঞ্চিত হতে হয়। তবে সেন্টার ফর ইকোনমিকস অ্যান্ড বিজনেস রিসার্চের (সিইবিআর) মতো যুক্তরাজ্যভিত্তিক গবেষণাপ্রতিষ্ঠান যখন এসব আশাবাদের কথা শোনায়, তখন ব্যাপারটাকে আর অবিশ্বাস্য মনে হয় না। তা ছাড়া, আগামী ১৫ বছরে বাংলাদেশ ১৭টি দেশকে পেছনে ফেলে যেতে পারে বলে যে ভবিষ্যদ্বাণী করা হচ্ছে, তাকে উড়িয়ে দেওয়ার তো উপায় নেই। কারণ, এই দেশটিই গত ১৫ বছরে টপকে এসেছে তার চেয়ে এগিয়ে থাকা ১২টি দেশকে। তবে সিইবিআরের নির্বাহী পরিচালক এ কথাও বলেছেন, এগুলো শুধু সংখ্যাগত তথ্য-উপাত্ত। কীভাবে সেই সম্ভাবনাকে বাস্তবে পরিণত করা যায়, সেটা বিবেচনায় নিতে হবে।
বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির যে কারণগুলো দেখানো হয়েছে, তার মধ্যে প্রধান একটি হচ্ছে, প্রবাসী আয়। কাঁচামাল আমদানির খরচ বাদ দিলে তৈরি পোশাক খাতের চেয়ে তিন গুণ বেশি নিট বৈদেশিক মুদ্রা আয় হচ্ছে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স থেকে।
সেই সত্তরের দশক থেকে এ পর্যন্ত বিশ্বের ১৬২টি দেশে বাংলাদেশ থেকে প্রায় ১ কোটি শ্রমিক গেছেন। তাঁদের অধিকাংশই গেছেন মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে। অভিবাসন প্রক্রিয়া মেনে যাঁরা বিদেশে গেছেন, তাঁরা নিঃসন্দেহে ভাগ্যবান। কিন্তু সরকারের গৃহীত বিভিন্ন ব্যবস্থা সম্পর্কে না জেনেও বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছেন অনেকে এবং তাঁদের সংখ্যাই বেশি। শ্রমিকদের পাঠানো অর্থে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি যেমন ঘটেছে, তেমনি বেঁচে আছে তাঁদের ওপর নির্ভরশীল লাখ লাখ পরিবার। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, এই শ্রমিকদের অভিবাসন প্রক্রিয়াকে এখনো নিরাপদ করা যায়নি। এখনো অবসান হয়নি তাঁদের দুর্ভোগ ও বঞ্চনার।
কয়েক দিন আগে ব্রুনেই থেকে ফিরে আসা দুই শ্রমিকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল তাঁদের অবর্ণনীয় দুর্ভোগের কথা। চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া উপজেলার মো. ফয়জুল্লাহ (২৭) ও মো. রহমতউল্লাহ (২৯) দালালের হাতে সাড়ে ৩ লাখ টাকা করে দিয়ে ব্রুনেই গিয়েছিলেন নিজের ও পরিবারের ভাগ্য ফেরানোর আশায়। ঢাকার নয়াপল্টনের জিলানী ট্যুর অ্যান্ড ট্রাভেলসের মনির হোসেন নামের এক ব্যক্তি আরও ছয়-সাতজনের সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন এই দুই তরুণকে। সেখানে নিয়ে একটি কামরায় মোট ৯ জনকে গাদাগাদি করে ফেলে রেখে হাওয়া হয়ে গিয়েছিলেন মনির হোসেন। অজানা-অচেনা একটি দেশে দিনের পর দিন একবেলা-আধবেলা খেয়ে কেটেছে তাঁদের। চার মাস পর তাঁরা যোগাযোগ করতে পারেন সেখানকার বাংলাদেশ দূতাবাসের সঙ্গে। দূতাবাসের কর্মকর্তা তাঁদের ভিসা দেখেই জানান, এগুলো জাল। এরপর দূতাবাসের মাধ্যমে পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করে কোনোমতে দেশে ফিরতে পেরেছেন এই দুজন। ফয়জুল্লাহ ও রহমতউল্লাহর এই পরিণতি বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়। আমাদের ত্রুটিপূর্ণ শ্রম-অভিবাসন ব্যবস্থাই এই পরিণতির জন্য দায়ী।
সন্দেহ নেই, মূল সমস্যা হচ্ছে অশিক্ষা ও অদক্ষতা। একজন অভিবাসী এখনো তাঁর ন্যায্য প্রাপ্য ও অধিকার সম্পর্কে জানেন না। চাকরিস্থল বা কাজের ধরন সম্পর্কে প্রকৃত তথ্যও জানতে পারেন না অনেকে। অনেক ক্ষেত্রে চুক্তির কাগজটিও হাতে পান না। এ রকম অনিশ্চয়তার মধ্যে বিদেশবিভুঁইয়ে গিয়ে পড়লে বিপদের ঝুঁকি থাকবেই। কিন্তু প্রয়োজন যেন কোনো আইন মানে না। তাই ছুটছে মানুষ। জায়গা-জমি বিক্রি করে সর্বস্বান্ত হয়ে, এমনকি ধারকর্জ করেও বিদেশে যাওয়ার জন্য দালাল চক্রের খপ্পরে পড়ে প্রতারিত হচ্ছে অসংখ্য মানুষ।
জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) হিসাবে, প্রতারণার শিকার ৫১ শতাংশের মধ্যে ১৯ শতাংশ মানুষ টাকা দেওয়ার পরও বিদেশে যেতে ব্যর্থ হয়েছে। বাকি ৩২ শতাংশ প্রতারণার শিকার হয়েছে বিদেশে যাওয়ার পর। বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক ভিসায় বিদেশে যেতে মোটা দাগে মাথাপিছু খরচ হয় ৩ থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত। বড় অঙ্কের এই ব্যয়ের প্রায় তিন-চতুর্থাংশ যায় মধ্যস্বত্বভোগী বা দালালের পকেটে। এই দালালদের কারণে প্রতিনিয়ত ঘটছে অবৈধ অভিবাসন। এই দালাল বা মধ্যস্বত্বভোগীদের নির্দিষ্ট কাঠামো ও জবাবদিহির মধ্যে আনতে নানা সময় নানা পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়। কিছু বেসরকারি উন্নয়নমূলক সংস্থাও কাজ করছে। কিন্তু অবস্থার খুব বেশি পরিবর্তন হয়েছে, এমনটা বলা যাবে না। এখনো প্রতারিত হচ্ছে শ্রমিক। অবৈধ অভিবাসন প্রক্রিয়া বন্ধ হয়নি এখনো।
সম্প্রতি ইউকেএইড ও ব্রিটিশ কাউন্সিলের সহযোগিতায় বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ইয়াং পাওয়ার ইন সোশ্যাল অ্যাকশন (ইপসা) নিরাপদ শ্রম অভিবাসন বিষয়ে মাঠপর্যায়ে একটি জরিপ চালায়। এই জরিপে দেখা যাচ্ছে, ৭০ শতাংশ মানুষ দালালের মাধ্যমেই অভিবাসন প্রক্রিয়ার কাজ করে। মাত্র ১১ শতাংশ কাজটা নিজে করতে পারে। জরিপে অংশ নেওয়া অধিকাংশ উত্তরদাতা বলেছেন, পাসপোর্ট করার সময় মূল খরচের চেয়ে ৫০ শতাংশের বেশি ব্যয় করতে হয়। দালালনির্ভরতাই এর কারণ। জরিপে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ৭০ শতাংশ রিক্রুটিং এজেন্সির সেবা সম্পর্কে ধারণা রাখেন না। অথচ শ্রম অভিবাসনের ক্ষেত্রে রিক্রুটিং এজেন্সির সেবা সম্পর্কে তথ্য জানা অপরিহার্য। জরিপে দেখা যাচ্ছে,
৭০ শতাংশ শ্রমিকেরই কাজ সম্পর্কে ধারণা ও দক্ষতার অভাব রয়েছে।
আমাদের রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো বেশি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার জন্য অদক্ষ শ্রমিকদের বিদেশে পাঠানোর ব্যাপারেই বেশি আগ্রহী। সুতরাং সরকারিভাবে পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার বিকল্প নেই। সেটা লাভজনক হলে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানও আগ্রহী হয়ে উঠবে বলে মনে করেন অভিজ্ঞজনেরা।
মাঠপর্যায়ের গবেষণার পর ইপসা যে সুপারিশগুলো তুলে ধরেছে, তার মধ্যে রয়েছে বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও অভিবাসী আইন, ২০১৩ যথাযথ বাস্তবায়ন করা, গন্তব্য দেশে দূতাবাসের সেবা ও সহযোগিতা বৃদ্ধি করা, সরকার–নির্ধারিত প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বিদেশ গমনের ক্ষেত্র তৈরি করা, শ্রমিকদের প্রশিক্ষণের পাশাপাশি গন্তব্য-দেশের ভাষা ও সংস্কৃতি সম্পর্কে প্রাথমিক জ্ঞান দেওয়া এবং সর্বোপরি রিক্রুটিং এজেন্সি বা দালালদের ব্যাপারে কঠোর তদারকি করা।
শুরুতেই বলেছি, দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির অন্যতম প্রধান খাত প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স। প্রবাসীদের টাকায় লেগে আছে তাঁদের শ্রম-ঘাম, অশ্রু ও দীর্ঘশ্বাস। এই শ্রমিকদের জীবনকে নিরাপদ ও স্বস্তিকর করে তোলার দায়িত্ব রাষ্ট্র ও সরকার এড়াতে পারে না।
বিশ্বজিৎ চৌধুরী, প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক, কবি ও সাহিত্যিক
[email protected]