১৯৭৩ সাল থেকে শুরু করে এ দেশে দলীয় সরকারের অধীনে যতগুলো নির্বাচন হয়েছে, তার সব কটিতেই জয় পেয়েছে ক্ষমতাসীনেরা। অন্যদিকে, নির্দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনগুলোতে পরপর দুই মেয়াদে কোনো দল ক্ষমতায় যেতে পারেনি। একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের আকাঙ্ক্ষা থেকেই নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি তোলা হয়েছিল একসময়। এই দাবি নিয়ে আন্দোলনের সামনের কাতারে ছিল আওয়ামী লীগ। আবার আওয়ামী লীগের হাত দিয়েই বাতিল হলো তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা।
রাজনীতিতে পাল্টাপাল্টি অবস্থান সমাজে তৈরি করে দিয়েছে বিভেদের এক অলঙ্ঘনীয় দেয়াল। ১৯৮০-এর দশকে সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে এ দেশে গড়ে উঠেছিল দ্বিদলীয় রাজনীতি। ১৯৯১ সালের নির্বাচন থেকেই এর স্বরূপ দিন দিন প্রকট হচ্ছিল। ২০১৮ সালের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে দ্বিদলীয় রাজনীতির মেরুদণ্ডটি আপাতদৃষ্টিতে ভেঙে পড়ল। এ নিয়ে আগামী দিনে অনেক কথাবার্তা এবং গবেষণা হবে। বলার অপেক্ষা রাখে না, ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর গবেষণা করা সহজ। ঘটনা ঘটার আগে পূর্বাভাস দেওয়া কঠিন। ক্রিকেট থেকে শুরু করে রাজনীতি—সব জায়গায় একই রকম।
গত চার দশকে এ দেশে আমরা শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়া—এই দুজন নেতার উত্থান দেখেছি রূপকথার মতো। রাজনীতির স্বাভাবিক ব্যাকরণ অনুযায়ী এমনটি হওয়ার কথা ছিল না। বিশেষ পরিস্থিতিতে নেতৃত্বের সংকট ও শূন্যতা তৈরি হওয়ায় নিয়তি তাঁদের টেনে এনেছিল রাজনীতির পিচ্ছিল পথে। তারপর হাঁটি হাঁটি পা পা করে তাঁরা নিজেদের জায়গা তৈরি করে নিয়েছিলেন, প্রতিষ্ঠা করেছিলেন একচ্ছত্র কর্তৃত্ব। দুজনের উত্থানের পেছনেই আছে বিয়োগান্ত ইতিহাস। তারপরও তাঁদের মধ্যে কোনো সহজ সমীকরণ তৈরি হয়নি। রাজনীতিতে তাঁরা ছিলেন পরস্পরের প্রধান প্রতিপক্ষ—এটি বললে কম বলা হবে। এখন তো কষ্ট করে খুঁজে দেখতে হবে, তাঁরা কবে শেষবারের মতো কথা বলেছিলেন। ইতিহাসে এ ধরনের দ্বৈরথ খুব বেশি দেখা যায় না।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করা নিয়ে দুজনই অনড় অবস্থানে চলে গিয়েছিলেন। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন তখন দরজায় কড়া নাড়ছে। ২৬ অক্টোবর ২০১৩ বিকেলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিরোধী দলের নেতা খালেদা জিয়াকে ফোন করে ২৮ তারিখ গণভবনে আসার জন্য দাওয়াত দেন। উদ্দেশ্য, একসঙ্গে বসে কথাবার্তা বলা ও রাতের খাবার খাওয়া। ওই সময় বিএনপির নেতৃত্বে ১৮-দলীয় জোটের তিন দিনব্যাপী হরতাল শুরু হয়ে গেছে। তাঁদের ৩৭ মিনিটের টেলিফোন সংলাপের শেষ অংশটি ছিল এ রকম:
খালেদা: আপনি বলেন যে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন করতে আপনি রাজি আছেন। তাহলে আমি কালকেই উইথড্র করে দেব।...বসে ঠিক করব, কালকে উইথড্র হবে। আমরা কালকেই আপনার সঙ্গে আলোচনায় বসব। কোনো অসুবিধা নাই।
হাসিনা: আপনি সর্বদলীয়টা মেনে নেন।
খালেদা: সর্বদলীয়টা মানা যায় না।
হাসিনা: কালকে আসেন, সবকিছুর সমাধান হয়ে যাবে।
খালেদা: হরতাল প্রত্যাহার হবে না। ২৯ তারিখ ডেট দেন। আমরা আলোচনায় যাব।
হাসিনা: আমি আপনাকে দাওয়াত দিচ্ছি, আপনি আসুন।
খালেদা: না, আমি যেতে পারব না। হরতালের মধ্যে আমি কোথাও যাই না (সূত্র: মহিউদ্দিন আহমদ, বিএনপি: সময়-অসময়, প্রথমা প্রকাশন)।
উল্লেখ্য, প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাবে সংসদে ফাঁকা দলগুলোর প্রতিনিধিদের নিয়ে নির্বাচনকালীন সরকারের কথা বলা হয়েছিল। বিএনপি ওই প্রস্তাব গ্রহণ করেনি। খালেদা জিয়া নিজের শক্তি সম্বন্ধে অতিমাত্রায় আস্থাশীল ছিলেন এবং শেখ হাসিনার শক্তিকে খাটো করে দেখেছিলেন। প্রকৃতপক্ষে খালেদা ওই দিনই হেরে গিয়েছিলেন। প্রচণ্ড চাপ সত্ত্বেও ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে নির্বাচনটি করিয়ে নিয়ে হাসিনা বাজির দরে জিতে যান। গত পাঁচ বছরে তিনি ক্রমাগত প্রমাণ করে গেছেন, তিনি একজন দক্ষ স্ট্রাইকার বা হার্ডহিটিং ব্যাটার। তিনি একজন ‘মাস্টার পলিটিশিয়ান’। রাজনীতির লড়াইয়ে তিনি আজ জয়ী। অন্যদিকে খালেদার চলছে অগস্ত্যযাত্রা। এটি একটি রূঢ় বাস্তবতা।
বাংলাদেশের গত পাঁচ দশকের ইতিহাসে দুটো বড় ঘটনা ঘটে গেছে, যার তাৎপর্য ছিল সুদূরপ্রসারী। একটি হলো ১৫ আগস্ট ১৯৭৫, অন্যটি হলো ২১ আগস্ট, ২০০৪। দুটোর মধ্যে অদ্ভুত মিল আছে।
একদা এ দেশে পিকিংপন্থীদের কয়েকটি গ্রুপ শুরু করেছিল ‘খতম’-এর রাজনীতি। ওগুলো ঘটেছিল বিপ্লবের নামে বিচ্ছিন্নভাবে। সমাজে তা আতঙ্ক ছড়ালেও প্রবল কোনো ঢেউ তুলতে পারেনি। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে নির্মূল করার বড় উদাহরণটি হলো ১৫ আগস্ট। তখনো বিএনপির জন্ম হয়নি। কিন্তু পরে খুনিদের সুরক্ষা দেওয়ার লক্ষ্যে জারি হওয়া ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ সংসদে পাস করিয়ে নিয়ে বিএনপি পঁচাত্তরের হত্যাকাণ্ডের দায়ভার নিজেদের কাঁধে নিয়ে নিয়েছিল।
জেনারেল জিয়াউর রহমানের লিগেসি থেকে তাঁর উত্তরসূরি খালেদা জিয়া বেরিয়ে আসার সুযোগ পেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি তা কাজে লাগাননি। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ ১১ নভেম্বর (১৯৯৬) সংসদের আলোচ্যসূচিতে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিলের প্রস্তাব রেখেছিল। স্পিকারের ‘পক্ষপাতমূলক’ আচরণের তুচ্ছ অজুহাত তুলে বিএনপির সদস্যরা সেদিন সংসদ থেকে ওয়াক আউট করে বুঝিয়ে দিতে চেয়েছিলেন, তাঁরা এ আইনটির বাতিল চান না। এর অর্থ দাঁড়ায়, ১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ডের বিচার করা যাবে না, এ অবস্থানটি বিএনপি বজায় রেখেছিল।
২১ আগস্ট, ২০০৪ আওয়ামী লীগের সমাবেশে বোমা ও গ্রেনেড হামলা হয়েছিল। এ ঘটনায় ২৪ জন নিহত হলেও শেখ হাসিনা অলৌকিকভাবে বেঁচে যান। বিএনপি সরকার এর সুষ্ঠু তদন্তের ব্যবস্থা না করে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা চালায়। তৈরি হয় ‘জজ মিয়া নাটক’। ২০০৬ সালের ২১ আগস্ট প্রথম আলো জজ মিয়ার মা জোবেদা খাতুনের সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে এই ভুয়া মামলার বিষয়টি ফাঁস করে দেয়। প্রকৃত অপরাধীদের আড়াল করে, ইচ্ছে করে এই নাটক সাজানোর মধ্য দিয়ে বিএনপি সরকার আবারও নিজেদের কাঁধে হাসিনা-নির্মূল ষড়যন্ত্রের দায়ভার নিয়ে নেয়।
এসব কিছু মেনে নিয়ে ‘রিকনসাইল’ করার মতো অবস্থানে থাকার কথা নয় শেখ হাসিনার। প্রতিশোধটি তিনি নিলেন রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে। তিনি এক এক করে হাত বাড়ালেন সম্ভাব্য শত্রুদের দিকে। তাঁদের জোটসঙ্গী করলেন। চরম সমালোচনা সত্ত্বেও হেফাজতে ইসলামের মতো একটি উগ্র ধর্মান্ধ গোষ্ঠীকে কৌশলে নির্বিষ করতে সক্ষম হলেন। জাতীয় পার্টিকে নিয়ে রীতিমতো ডাংগুলি খেললেন। আর মূল প্রতিপক্ষ বিএনপিকে ক্রমাগত বিচ্ছিন্ন ও কোণঠাসা করতে লাগলেন। ২০১৮ সালের নির্বাচনে দেখা গেল, বিএনপির ওপর দিয়ে একটি সুনামি বয়ে গেল। গ্রেনেড ছুড়তে হলো না, কামান দাগানোর দরকার পড়ল না। ভোটের লড়াইয়ে বিএনপি নকআউট হয়ে গেল।
২০১৮ সালের নির্বাচনে সূক্ষ্ম না স্থূল কারচুপি হয়েছে, এ নিয়ে জন–আলোচনা চলছে, চলবে। বাস্তবতা হলো, বিএনপি রাজনৈতিক দল হিসেবে একেবারেই খাদের কিনারায় চলে গেছে। এটি আর আগের মতো উঠে দাঁড়াতে পারবে না। তবে আওয়ামী বৃত্তের বাইরে একটি উদার গণতান্ত্রিক দলের চাহিদা সমাজে থেকেই যাবে। তবে তা গড়ে উঠতে সময় লাগবে। শেখ হাসিনা রাজনৈতিকভাবে শোধ নিয়েছেন! বলা যায়, মধুর প্রতিশোধ।
মহিউদ্দিন আহমদ: লেখক ও গবেষক
mohi 2005 @gmail. com