মনোনয়ন-নাটক ও ভেতরে গণতন্ত্রহীনতা
পাঞ্জাব আলী বিশ্বাস পাবনা আওয়ামী লীগের নেতা। সাবেক এমপিও তিনি। ১৯৮৬ সালের আলোচিত নির্বাচনে তিনি জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল থেকে নির্বাচিত হয়েছিলেন। পরে আওয়ামী লীগে যোগ দেন। এবার মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন। কিন্তু শিকে ছেঁড়েনি তাঁর ভাগ্যে। মর্মাহত, ক্ষুব্ধ পাঞ্জাব আলী তাঁর ফেসবুকে প্রধানমন্ত্রী ও দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনার কাছে খোলা চিঠি লিখেছেন। পাঞ্জাব আলীর দাবি মতে, এলাকার লোকজন চাঁদা তুলে তাঁর ব্যাংকঋণ শোধ করেছেন। এরপরও কোনো লাভ হয়নি। শুধু পাঞ্জাব আলীই নন, এই রকম আরও অনেক ক্ষুব্ধ, হতাশ, ব্যথিত নেতা আছেন। জাহাঙ্গীর কবির নানকের চোখের জল আমরা দিনে-দুপুরেই দেখেছি। তাঁর চোখের জল চাট্টিখানি কথা না। আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে তিনি হেভিওয়েট নেতা হিসেবেই পরিচিত। সেই নানক প্রকাশ্য জনসভায় চোখের জল ফেলছেন। গাইবান্ধার এমপি অধ্যক্ষ আবুল কালাম আজাদ এলাকায় ফিরে গিয়ে কর্মী-সমর্থকদের ধরে অঝোরে কেঁদেছেন। আরেক হেভিওয়েট নেতা বিএনপির মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল তো একেক নির্বাচনে একেক আসনে মনোনয়নের দুঃখে মনোনয়নপত্র জমাই দেননি। এই যাযাবরের ‘আসন’ তাঁর ভালো লাগেনি। উল্লেখ্য, জাহাঙ্গীর কবির নানক ও মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল ২০০৮ সালে একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন। এবার দুজনই নির্বাচনে নেই। বিএনপির বরিশালেরই আরেক নেতা এস শরফুদ্দিন সান্টু বলেই দিয়েছেন, দলীয় মনোনয়ন না পেলে তিনি স্বতন্ত্র নির্বাচন করবেন।
ওদিকে জাতীয় পার্টির মনোনয়নবঞ্চিত ব্যক্তিরা হন্যে হয়ে খুঁজছেন একসময়ের ছাত্রলীগ নেতা ও জাতীয় পার্টির মহাসচিব রুহুল আমিন হাওলাদারকে। তাঁকে নাকি পাওয়া যাচ্ছে না। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মনোনয়নবঞ্চিতরা সরাসরি কাউকে দোষারোপ না করলেও জাতীয় পার্টির নেতারা কোনো লুকোছাপা করেননি। খোলাখুলিই বলে দিয়েছেন, রুহুল আমিন হাওলাদার মনোনয়নের নামে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। এখন সেই টাকা ফেরত পাওয়ার জন্য হাওলাদারের খোঁজে বনানীর পার্টি অফিস, বারিধারার পার্টি চেয়ারম্যানের বাসভবন ও রুহুল আমিন হাওলাদারের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান চষে বেড়াচ্ছেন। নীলফামারীর এক নেতা হুমকিও দিয়েছেন, সৈয়দপুর গেলে দেখে নেবেন বলে। পুলিশও নাকি পার্টির চেয়ারম্যান ও মহাসচিবকে রক্ষা করতে পারবে না। মনোনয়নবঞ্চিতদের ক্রমাগত ক্ষোভ-বিক্ষোভের মুখে পার্টির বনানীর অফিসে তালা লাগিয়ে পুলিশি নিরাপত্তার ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। মহাসচিব হাওলাদার কড়া পুলিশি প্রহরায় পটুয়াখালীতে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন।
জাতীয় পার্টির মনোনয়নবঞ্চিতরা যে প্রকাশ্যেই আর্থিক লেনদেনের অভিযোগ আনলেন, তাতে নির্বাচন কমিশন বা দুর্নীতি দমন কমিশনের কোনো ভাবান্তর হয়েছে বলে শুনিনি। মনে হয়, মুখে কুলুপ এঁটে পর্যবেক্ষণ করছেন। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মনোনয়নবঞ্চিতরা সরাসরি কারও নাম ধরে আর্থিক কেলেঙ্কারির অভিযোগ করেনি। তবে আওয়ামী লীগ ও বিএনপিতেও মনোনয়ন–বাণিজ্য বেশ ভালোই হয়েছে। মনোনয়নবঞ্চিত অনেকে বলছেন, দলের দুর্দিনে জীবন বাজি রেখে দলকে আগলে রেখেছেন; এখন এই তার প্রতিদান! মনোনয়নবঞ্চিত প্রধান দুই দলের অধিকাংশেরই ধারণা, দলীয় প্রধানকে ভুল বুঝিয়েছে দলের ভেতরই থাকা একটি অংশ। এ কারণেই তাঁরা মনোনয়ন পাননি। ওই অংশটিই আবার মনোনয়ন নিশ্চিত করার কথা বলে টাকাপয়সা হাতিয়ে নিয়েছেন বলেও কেউ কেউ অভিযোগ করছেন। এবং মনোনয়নবঞ্চিতরা এও মনে করেন, দলীয় প্রধানের সঙ্গে একবার কথা বলতে পারলে তাঁরাই আবার মনোনয়ন পাবেন। তাই স্বতন্ত্রভাবে মনোনয়ন জমা দিয়ে রেখেছেন অনেকেই। এবং দলীয় প্রধানদের সঙ্গে কথা বলার, দেখা করার চেষ্টা করছেন।
এই হচ্ছে দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মনোনয়ন–কেলেঙ্কারির পরিস্থিতি। নির্বাচনের আর মাস খানেক বাকি। যখন ভোটের জন্য প্রার্থীদের মাঠঘাট চষে বেড়ানো কথা, তখন তাঁরা ঢাকায় অবস্থান নিয়ে টাকা ফিরে পাওয়ার আসায় একদল হাওলাদারকে খোঁজে, তো আরেক দল ধানমন্ডিতে যায়। অপর দল গুলশানে ভিড় করে।
মনোনয়ন দিয়ে দলগুলোর মধ্যে এই আর্থিক কেলেঙ্কারি, হযবরল অবস্থা কেন? দলগুলোয় গণতন্ত্রের চর্চার বালাই নেই বললেই চলে। তাই দলীয় মনোনয়নব্যবস্থাও ত্রুটিপূর্ণ। দলগুলো এক ব্যক্তিকেন্দ্রিক সংগঠনে পরিণত হয়েছে। এ অবস্থায় দলীয় প্রধানের আশপাশে থাকে আবার কয়েকটি বলয়। দলীয় প্রধানেরা নিজেদের কর্তৃত্ব বজায় রাখার জন্য একেক বলয়কে আরেক বলয়ের বিরুদ্ধে সক্রিয় রাখেন। যখন যে বলয় ক্ষমতা বা দলীয় প্রধানের কাছাকাছি থাকে, তখন নির্বাচন বা দলীয় পদে সেই বলয়েরই প্রাধান্য থাকে। এসব ক্ষেত্রে নেতাদের মূল্যায়ন করা হয় কর্মের ভিত্তিতে নয়, রাজনৈতিক ‘ভাই’দের প্রতি আনুগত্য এবং আর্থিক লেনদেনের ভিত্তিতে। সাধারণ কর্মীদের দলের নেতৃত্ব নির্বাচনে কোনো ভূমিকাই থাকে না। কর্মীদের দায়িত্ব কেবল মিছিল ও জনসভায় অংশ নেওয়া। মনোনয়ন ও পদ নিয়ে বিভিন্ন বলয়ের দলাদলির মধ্যেই মূলত দলগুলোয় আর্থিক দুর্নীতি ও অনিয়মের হাতেখড়ি। দলের লোকজনকে ঘুষ দিয়ে যখন কেউ মনোনয়ন লাভ করে নির্বাচিত হন, দলীয় পদ দখল করেন তখন তিনি সেই অর্থ তুলে আনার চেষ্টায়ও লিপ্ত হন এবং বিভিন্ন ধরনের দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন। আমরা দেশ থেকে দুর্নীতি দূর করতে বলি। কিন্তু যাঁদের দুর্নীতি দূর করার দায়িত্ব দেয় জনগণ, ভোটের মাধ্যমে তাঁরাই আকণ্ঠ দুর্নীতি নিমজ্জিত হন। তাহলে দেশ থেকে দুর্নীতি দূর হবে কীভাবে?
মোদ্দাকথা, রাজনৈতিক দলগুলো এখনো রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে দাঁড়াতে পারেনি। কিন্তু যেসব দলের মধ্যেই ন্যূনতম গণতন্ত্র নেই, তাদের দ্বারা দেশের গণতন্ত্র আসবে কী করে? তৃণমূল থেকে শীর্ষ পর্যন্ত নেতা নির্বাচিত হওয়া উচিত দলীয় কর্মীদের ভোটে। এমনকি দলীয় মনোনয়নও হওয়া উচিত কর্মীদের ভোটে। এ নীতি অনুসরণ করা হলে পাঞ্জাব বিশ্বাসের মতো কাউকে আর খোলা চিঠি লিখতে হবে না। তৃণমূলে জনপ্রিয় হওয়া মানেই দলীয় মনোনয়ন পাওয়ার নিশ্চয়তা। দলগুলোর মধ্যে গণতন্ত্রের চর্চা থাকলে রাজনৈতিক ভাই বা দলীয় প্রধানের ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর মনোনয়নপ্রত্যাশীদের আর নির্ভর করতে হতো না। বাংলাদেশে রাজনৈতিক দলগুলোয় মূলত ব্যক্তিকেন্দ্রিক স্বৈরতন্ত্র সক্রিয় আছে। দলীয় প্রধানের কথাই এখানে শেষ কথা। সাংগঠনিক কাঠামো ও গঠনতন্ত্র এখানে মূল্যহীন।
মূলত, রাজনৈতিক দলগুলো রাষ্ট্রীয় কাঠামোর ভেতরে প্রতিষ্ঠান হিসেবে দাঁড়াতে পারেনি। এটাই সবচেয়ে বড় দুর্বলতা। বাংলাদেশকে অধিকতর গণতান্ত্রিক ও কল্যাণমুখী রাষ্ট্র করার মূল বাধা এখানেই লুকিয়ে আছে। রাজনৈতিক দলগেুলোকে গণতান্ত্রিক ও স্বচ্ছ করা না গেলে কাঙ্ক্ষিত গণতন্ত্র বাংলাদেশে আদৌ আসবে না। নির্বাচনকে সামনে রেখে দলগুলো অচিরেই নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করবে। সেখানে নানা কথার ফুলঝুরি থাকবে। নানাবিধ উন্নয়নের স্বপ্ন থাকবে। কেউ কেউ বাংলাদেশকে সিঙ্গাপুর–মালয়েশিয়ার প্রতিশ্রুতি দেবেন। এসবের সঙ্গে নজর রাখতে হবে দলের ভেতরে সর্বাগ্রে গণতন্ত্র আনয়নে দলগুলোর কী ধরনের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে তার ওপর।
ড. মারুফ মল্লিক, ভিজিটিং রিসার্চ ফেলো, ইনস্টিটিউট অব অরিয়েন্ট অ্যান্ড এশিয়ান স্টাডিজ, ইউনিভার্সিটি অব বন।