কুলদীপ নায়ার উপমহাদেশের সাধারণ মানুষের কাছে যতটা ভালোবাসা ও সমীহ আদায় করে নিয়েছিলেন, আর কোনো সাংবাদিক সেটি পারেননি। সাতচল্লিশের দেশ বিভাগ থেকে হালের ভারত, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের রাজনৈতিক গতিপ্রকৃতি বিশ্লেষণে তাঁর নিরপেক্ষ ও নির্মোহ দৃষ্টিভঙ্গি সবার প্রশংসা কেড়েছে।
কুলদীপ নায়ার একসময় ছিলেন যুক্তরাজ্যে ভারতের হাইকমিশনার, রাজ্যসভার সদস্য। মানবাধিকারকর্মী হিসেবেও তিনি বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছেন। কিন্তু এসব পরিচয় ছাপিয়ে সাংবাদিকতাই হয়ে উঠেছিল তাঁর ধ্যানজ্ঞান ও সাধনার অনন্য হাতিয়ার। কুলদীপ ইংরেজি দৈনিক ‘ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস’-এর সম্পাদক ছিলেন। শেষ দিকে কলাম লেখাই ছিল তাঁর পেশা। তিনি প্রথম আলোয় নিয়মিত লিখতেন।
ঢাকা ও দিল্লিতে বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনের সেমিনারে কুলদীপ নায়ারের উপস্থিতি বাড়তি আকর্ষণ তৈরি করত। যেকোনো আঞ্চলিক সেমিনারে প্রতিনিধিরা নিজ নিজ দেশের পক্ষে দৃঢ় অবস্থান নিয়ে থাকেন। কিন্তু কুলদীপ সব সংকীর্ণ ও উগ্র স্বাদেশিকতা অতিক্রম করে সমঝোতা ও সমধর্মিতার পথ বাতলে দিতেন। তিনি মনে-প্রাণে চেয়েছেন, উপমহাদেশের তিনটি দেশই শান্তি ও সম্প্রীতিতে বসবাস করুক।
দেশ বিভাগের সময় কুলদীপ জন্মভূমি পাকিস্তান থেকে বিতাড়িত হয়েছেন। তাঁর পারিবারিক ভিটে অন্যরা দখল করে নেন। দিল্লিতে ট্রেনে যেতে যেতে দেখেছেন—কীভাবে এক সম্প্রদায় অপর সম্প্রদায়ের ওপর সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। শিয়ালকোট থেকে যেভাবে হিন্দু ও শিখরা বিতাড়িত হয়েছেন, দিল্লি-অমৃতসর থেকেও মুসলমানদের অনুরূপভাবে উচ্ছেদ করা হয়েছে। কুলদীপ নিজে উদ্বাস্তু হয়েও অন্য সম্প্রদায়ের উন্মুল মানুষের বেদনা উপলব্ধি করেছেন।
কুলদীপ নায়ার একাত্তরে বাংলাদেশের বিপর্যয়ে পাশে দাঁড়িয়েছেন, লেখনী দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহস জুগিয়েছেন। তিনি ইন্দিরা গান্ধীর জরুরি অবস্থার সমালোচনা করতে গিয়ে জেল খেটেছেন, আবার মোরারজি দেশাই সরকার যখন বিচারের নামে ইন্দিরাকে নাজেহাল করল, তিনি তারও প্রতিবাদ করেছেন।
কুলদীপ নায়ার সবচেয়ে বেশি ঘৃণা করতেন সাম্প্রদায়িকতাকে। তিনি কংগ্রেসের কঠোর সমালোচনা করতেন। কিন্তু নরেন্দ্র মোদির বিজেপি সরকার যখন সমাজ ও রাজনীতির প্রতিটি ক্ষেত্রে সাম্প্রদায়িক নীতি নিল, তখন বললেন, এটি ভারতের পথ নয়।
কয়েক বছর আগে পড়েছিলাম কুলদীপ নায়ারের আত্মজীবনীমূলক বই ‘বিয়ন্ড দ্য লাইনস’। যে আত্মজীবনী কালের কিংবা দেশের সীমা ছাড়িয়ে নব নব দিকের পানে পাঠককে নিয়ে যায়, সেটাই কালোত্তীর্ণ আত্মজীবনী। যে আত্মজীবনী ব্যক্তির চেয়ে তার চারপাশের চরিত্রগুলোর প্রতি অধিক মনোনিবেশ ঘটায়, পাঠককে নিয়ত আত্মজিজ্ঞাসা ও আত্মবিশ্লেষণে ব্যস্ত রাখে, সেই আত্মজীবনীই হয়ে ওঠে সময়ের দর্পণ। তাঁর আত্মজীবনীতে অগ্রাধিকার পেয়েছে দেশ, মানুষ, গণতন্ত্র ও মানবাধিকার।
কুলদীপের জন্ম ১৯২৩ সালে, অবিভক্ত পাঞ্জাবের শিয়ালকোটে। তাঁর বাবা ছিলেন নামকরা চিকিৎসক। সেই সুবাদে স্থানীয় হিন্দু-মুসলিম ও শিখদের অত্যন্ত প্রিয় ছিলেন। তাঁর কলাম ‘বিটুইন দ্য লাইন’ দেশ-বিদেশের ১৭টি ভাষার ৮০টি পত্রিকায় ছাপা হয় । কুলদীপ নিজেকে অবশ্যই ভারতীয় মনে করেন, কিন্তু তার চেয়েও বেশি মনে করেন উপমহাদেশীয়। তিনি বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে মৈত্রী চান, আবার পাকিস্তানের সঙ্গেও সুসম্পর্ক গড়ে তুলতে আগ্রহী।
‘বিয়ন্ড দ্য লাইনস’-এর শুরু শিয়ালকোটে, তাঁর কৈশোরে যখন দেশ ভাগ হয়ে ভারত ও পাকিস্তান নামের দুটি রাষ্ট্র হয়, সমাপ্তি টেনেছেন মনমোহন সিংয়ের শাসনামলে এসে। এই সময়ে উপমহাদেশে রাজনৈতিক উত্থান-পতন, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, মানবিক বিপর্যয়, যুদ্ধ-বৈরিতা, দ্বিপক্ষীয় ও ত্রিপক্ষীয় সম্পর্কের টানাপোড়েন—সবই বিবৃত হয়েছে তাঁর আত্মজীবনীতে। ১৯টি অধ্যায়ে বিভক্ত এই আত্মজীবনীকে আমরা মোটাদাগে তিন ভাগে ভাগ করতে পারি। ১. শৈশব থেকে দেশ বিভাগ পর্যন্ত; ২. দেশ বিভাগ থেকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং ৩. বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ থেকে হালনাগাদ।
কুলদীপ নায়ার শিখ ও হিন্দু উভয় পারিবারিক ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারী। তাঁর মা নিয়মিত গুরুদুয়ারায় যেতেন। তাঁরা শিখ হলেও লম্বা চুল রাখেননি। কুলদীপ নিজের নামের সিং বাদ দিয়ে নামের শেষে নায়ার যোগ করেছেন। তাঁদের পরিবারে হিন্দু ও শিখ উভয় ধর্মের অনুষ্ঠানাদি পালন করা হতো। তাঁরা ছিলেন সংস্কারমুক্ত। এমনকি একবার লক্ষ্মীপূজার আচারাদি পালনের সময় এক মুসলিম দম্পতি এসে পড়লে তাঁর মা তাঁদেরও তাতে যোগ দিতে বলেন। কুলদীপ নায়ার জাত-অজাত বিশ্বাস করতেন না। তাঁর ভাষায়, অদ্ভুত কালচার হিন্দুধর্মের জাতপাতের বিভেদ সম্পর্কে সজাগ করে। স্কুলে সহপাঠীদের মধ্যে কেউ জুতো পরত, কেউ খালি পায়ে ছিল। কুলদীপ শিক্ষকদের প্রশ্ন করেন, কেন সবাই জুতা পরে আসবে না? যারা খালি পায়ে আসত, তারা ছিল নিম্নবর্ণের। কুলদীপ ধর্মের নামে এই অনাচার মানতে পারেননি শৈশব থেকে।
কুলদীপের সাংবাদিকতা শুরু উর্দু পত্রিকা আনজামের মাধ্যমে। এই পত্রিকার মুসলিম মালিক তাঁকে চাকরি দিয়েছিলেন, সরকারের উচ্চ মহলে যোগাযোগ রেখে যাতে তাঁর পত্রিকা ও সম্পদ রক্ষা করা যায়। যখন সম্পাদকের সম্পদ রক্ষিত হলো না, তখন তাঁকে ছাঁটাই করা হয়। স্বাধীনতাসংগ্রামী মাওলানা হাসরাত মাহানীর, যিনি প্রথম ভারতের স্বাধীনতার কথা বলেন, তাঁর পরামর্শে ইংরেজি পত্রিকায় সাংবাদিকতা করার চেষ্টা করেন। বৃত্তি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে যান সাংবাদিকতা পড়তে, পরে একাধিক ইংরেজি দৈনিকে যোগ দেওয়ার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়ে লেখক-রাজনীতিক হুমায়ুন কবিরের সহায়তায় তাঁর ফিচার এজেন্সির মাধ্যমে ইংরেজি সাংবাদিকতা শুরু করেন।
কুলদীপ নায়ার তাঁর আত্মজীবনীতে ‘বাংলাদেশ যুদ্ধ’ নামে যে অধ্যায়টি লিখেছেন, সেটি মূলত বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমান, পাকিস্তানি নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টোসহ বিভিন্নজনের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎকার এবং নিজের অভিজ্ঞতার আলোকে। পটভূমি হিসেবে এসেছে ১৯৭০ সালের নির্বাচন, বাঙালিদের বিরুদ্ধে ইয়াহিয়া-ভুট্টোর চক্রান্ত, ২৫ মার্চের সেনা অভিযান, ভারতে লাখ লাখ শরণার্থীর আশ্রয় গ্রহণ, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বাঙালির প্রতিরোধ যুদ্ধে ভারতের সহায়তা, ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ ইত্যাদি।
কুলদীপ জানাচ্ছেন, পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে খুব কম বিষয়েই অংশীদারি ছিল। পূর্ব পাকিস্তানিদের ভাষা, আচার, জীবনধারা পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। এই দুইয়ের মধ্যে একমাত্র সেতুবন্ধ ছিল ইসলাম। কিন্তু পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর মুহম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকায় এসে যখন উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করতে চাইলেন, তখন সেই বন্ধনও শিথিল হয়ে গেল। পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানের ক্ষোভের প্রধান বিষয় হয়ে দাঁড়ায় এই ভাষা। তাঁর বিশ্লেষণ হলো, বাঙালি মুসলমান বাঙালি হিন্দুদের চেয়েও বেশি অপছন্দ করে পশ্চিম পাকিস্তানিদের। যেমনটি পশ্চিম পাঞ্জাবের মুসলমানরা পাঞ্জাবি হিন্দুদেরই কাছের মনে করে বাঙালি মুসলমানদের থেকে।
এ কারণে পশ্চিম পাকিস্তানিরা কাশ্মীর নিয়ে যখন আন্দোলন-সংগ্রাম করছে, পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিরা মনে-প্রাণে তার সঙ্গে একাত্ম হতে পারেনি। কেননা, তাদের কাছে কাশ্মীর অনেক দূরের। বাঙালি কূটনীতিক আজিজুল জলিল জানিয়েছেন, পঞ্চাশের দশকে তিনি যখন লন্ডনে পাকিস্তান হাইকমিশনে, শেখ মুজিবুর রহমান ওয়াশিংটন থেকে লন্ডন হয়ে দেশে ফিরছিলেন। লন্ডনে যাত্রাবিরতিকালে তাঁদের মধ্যে আলোচনা হয়। একপর্যায়ে কাশ্মীরের কথা উঠতেই মুজিব তাঁকে বললেন, ‘ওটি আমাদের সমস্যা না। পশ্চিম পাকিস্তানের সমস্যা।’
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারত সহায়তা করলেও এর পরিণতি সম্পর্কে নিশ্চিত ছিল না, বিশেষ করে ভারতের ভয় ছিল, আমেরিকা ও চীন এই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লে তাদের ওপরই বেশি আঘাত আসবে। সে কারণেই তারা অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে চুক্তি সইয়ের আগে সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে আরেকটি চুক্তি সই করে। মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের রেকর্ড থেকে জানা যায়, মুজিবনগর সরকারের প্রতিনিধিরা কলকাতায় মার্কিন কনসাল জেনারেলের সঙ্গে যে আলোচনা করেন, তাতেও ভারতের কোনো কোনো মহলের সম্মতি ছিল।
কুলদীপ নায়ার জানান, অক্টোবরেই এটি স্পষ্ট হয় যে তাঁরা এই বাংলাদেশের সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে জড়িয়ে পড়েছেন। প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্র ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিবেরা কয়েকজন সম্পাদককে একটি পরামর্শ সভায় আমন্ত্রণ জানান এবং মুজিবনগর নির্বাচনের অবস্থান প্রকাশ না করার জন্য তাঁদের ধন্যবাদ জানান। মুজিবনগর সরকার কলকাতায় অবস্থান করলেও পূর্ব পাকিস্তান বাংলাদেশের ভেতরে আছে বলে গণমাধ্যমে প্রচার করা হয়।
কুলদীপ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে আরেকটি নতুন তথ্য দিয়েছেন, যা আগে চোখে পড়েনি। যুদ্ধের শুরুতে পাকিস্তান মনে করেছিল, ভারত শরণার্থীদের পুনর্বাসনের জন্য সীমান্ত এলাকাগুলো দখল করতে চেয়েছিল। পররাষ্ট্রমন্ত্রী শরণ সিং বিদেশ সফরে গিয়ে ৫০ মাইল এলাকামুক্ত করার ইঙ্গিতও দিয়েছিলেন, স্থায়ী সমাধান না হওয়া পর্যন্ত জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে শরণার্থীদের পুনর্বাসন করা হবে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের কারণে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। পাকিস্তানের ধারণা ছিল, ভারতের অভিযান হবে সীমিত পরিসরে। তারা ভারতের পশ্চিম সীমান্তে আক্রমণ চালায়, যাতে পূর্বাঞ্চল নিয়ে ওরা বেশি ব্যস্ত থাকতে না পারে।
কুলদীপের জবানিতে আমরা আরও জানতে পারি, যুদ্ধের সময় লে. জেনারেল হরবক্স সিং সেনা অভিযান ও তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনাবলি সম্পর্কে প্রতিদিন ব্রিফ করতেন। তিনি স্টেটসম্যানে প্রতিদিনই এ মিলিটারি এক্সপার্ট ছদ্মনামে একটি কলাম লিখতেন। যুদ্ধের শেষ দিকে ভারতীয় বাহিনীর মন্থর অগ্রাভিযানে মস্কো উদ্বেগ প্রকাশ করেছিল। কেননা, তারা চায়নি বাংলাদেশ ভিয়েতনাম হোক। সোভিয়েত প্রথম উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী ভ্যাসিলি কুজনেটভ যুদ্ধের সর্বশেষ অবস্থা জানতে জরুরি ভিত্তিতে দিল্লি আসেন এবং তিনি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বাংলাদেশের জনগণ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে, তাদের কাঠামো ভেঙে পড়েছে এবং আত্মসমর্পণের ঘটনা তিন বা চার দিনের ব্যাপারমাত্র।
শরণ সিং জাতিসংঘ থেকে টেলিফোনে নয়াদিল্লিকে জানান দ্রুত অপারেশন শেষ করার জন্য। সোভিয়েত ইউনিয়ন তাঁকে জানিয়েছে, বেশি দিন অস্ত্রবিরতি প্রস্তাব ঠেকিয়ে রাখা যাবে না। অর্থাৎ বাংলাদেশের যুদ্ধে বৃহৎ শক্তিগুলো প্রত্যক্ষ না হলেও পরোক্ষভাবে জড়িয়ে পড়ে। ১৫ ডিসেম্বর মার্কিন কূটনীতিকদের কাছ থেকে জেনারেল জ্যাকব টেলিফোন পান যে জেনারেল নিয়াজি ও রাও ফরমান আলী যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবে রাজি হয়েছেন।
মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে কুলদীপ নায়ারের মূল্যায়ন, ‘ভারতের অবদানের সঙ্গে তুলনা করলে বাংলাদেশের জনগণ ও মুক্তিবাহিনীর ভূমিকা বিরাট। তারা নিজেরাই যে নিজেদের স্বাধীনতা অর্জন করতে পারত, সে ব্যাপারে আমার সন্দেহ নেই। ভারতের সমর্থন ছাড়া বাংলাদেশিরা আরও বেশি সমস্যায় পড়ত এবং যুদ্ধ আরও দীর্ঘ হতো কিন্তু তাদের অবিচলতা এবং দুঃখ-দুর্দশা মেনে নেওয়ার সক্ষমতা খাটো করে দেখা উচিত নয়।’
পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর গণহত্যা, ধর্ষণ ও লুটপাটের কথা উল্লেখ করে তিনি লিখেছেন, ‘আমি বুঝতে পারি না পাকিস্তান কেন এসব নৃশংসতার জন্য ক্ষমা চাইছে না। হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে আণবিক বোমা ফেলার জন্য যদি যুক্তরাষ্ট্র জাপানের কাছে ক্ষমা চাইতে পারে, তাহলে পাকিস্তান নয় কেন?’
বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক বিষয়ে কুলদীপ মনে করেন, ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক টেকসই করার বিষয়টি বাংলাদেশের চেয়ে ভারতের ওপরই বেশি নির্ভর করে।
কুলদীপ নায়ার যেসব নেতা ও রাষ্ট্রনায়কের সান্নিধ্যে এসেছেন, তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন মহাত্মা গান্ধী, জওহরলাল নেহরু, রাজেন্দ্র প্রসাদ, জয় প্রকাশ নারায়ণ, লাল বাহাদুর শাস্ত্রী, গুজরাল লাল নন্দ, মাওলানা আবুল কালাম আজাদ, কৃষ্ণ মেনন, আবদুল গাফ্ফার খান, সরদার বল্লভ ভাই প্যাটেল, ইন্দিরা গান্ধী, মোরারজি দেশাই, বিশ্বনাথ প্রতাপ সিং, চন্দ্র শেখর, আই কে গুজরাল, সোমনাথ চ্যাটার্জি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তাজউদ্দীন আহমদ, পাকিস্তানে মুহম্মদ আলী জিন্নাহ, আইয়ুব খান, জুলফিকার আলী ভুট্টো, নওয়াজ শরিফ, বেনজির ভুট্টো, শেখ হাসিনা, খালেদা জিয়া প্রমুখ। বিভিন্ন ঘটনা ও কাহিনির মধ্য দিয়ে নেতা-নেত্রীদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য তুলে ধরেছেন। সেখানে তিনি নিজেকে অনেকটা আড়ালে রেখে ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন। সরকারি কর্মকর্তা ও সাংবাদিক হিসেবে কুলদীপ নায়ার উপমহাদেশের অনেক ঘটনার সাক্ষী। কুলদীপের ভাষায়, ‘অধিকাংশের কাজকর্ম আমাকে হতাশ করেছে এবং আমার অভিজ্ঞতা হলো যারা উচ্চপদে আসীন, তাদের বেশির ভাগই তাদের মর্যাদা বাড়ায়নি, তারা কর্তৃত্বপরায়ণ কিন্তু অন্তঃসারহীন। তাঁর সাক্ষ্যদান সব ক্ষেত্রে শতভাগ নিরপেক্ষ হয়েছে বলা যাবে না। তবে দুটি বিষয়ে তিনি সব সময়ই আপসহীন—গণতন্ত্র ও মানবাধিকার ।
কুলদীপ নায়ার এপিলগ নামে যে অধ্যায়টি লিখেছেন, তা মানবিক চেতনা ও হার্দিক অনুভূতিতে উজ্জ্বল। দেশে-বিদেশে যেকোনো অন্যায়, অবিচার ও বৈষম্য তাঁকে আহত করে। মানবাধিকারকর্মী হিসেবে তিনি কাশ্মীরে কাজ করছেন, যাঁরা তাঁদের নিজেদের সত্তা খুঁজে ফিরছেন। বিহারে কাজ করেছেন ভূমিদস্যু ও প্রতারণাকারীদের বিরুদ্ধে, বৃহৎ বাঁধের মাধ্যমে যেসব কৃষক ও আদিবাসীকে উচ্ছেদ করা হয়েছে, তাঁদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। তিনি স্মরণ করছেন, ১৯৪৬-এ রেলস্টেশনে এক মুসলিম যুবক তাঁর মাকে দাঙ্গাকারীদের হাত থেকে রক্ষা করছেন। কুলদীপ নায়ার কেবল তাঁর লেখার মাধ্যমে উপমহাদেশে শান্তি ও সম্প্রীতির পক্ষে প্রচারণা চালাননি, মানবাধিকারকর্মী হিসেবে তিনি এসব আন্দোলনেও সক্রিয় ছিলেন।
কুলদীপ নায়ার কৈশোরে বামপন্থী ছাত্রসংগঠনের সঙ্গে জড়িত থাকলেও পরবর্তীকালে যথাসম্ভব বামপন্থাকে এড়িয়ে চলেছেন। ব্যক্তিস্বাধীনতা ও মুক্ত অর্থনীতির প্রতিই তাঁর ঝোঁক। তারপরও ভারতের মাওবাদী আন্দোলনের প্রতি তাঁর সহানুভূতি লক্ষ করা যায়। তিনি লিখেছেন, ‘মাওবাদী সহিংসতার বিষয়টি আইনশৃঙ্খলাজাত সমস্যার চেয়ে বেশি কিছু ভাবতে হবে এবং এর সমাধানে আর্থসামাজিক বৈষম্য দূর করতে হবে। যদিও রাষ্ট্র কর্তৃত্ববাদী কায়দায় এই সমস্যার সমাধান করতে চাইছে।’
কুলদীপ নায়ার পর্যায়ক্রমে জনতা পার্টি, রাজীব গান্ধী, বিশ্বনাথ প্রতাপ সিং, নরসিমা রাও, অটল বিহারি বাজপেয়ি, আই কে গুজরাল ও মনমোহন সিং সরকারের সাফল্য ও ব্যর্থতাগুলো খুব কাছ থেকে দেখেছেন। বিশ্বনাথ প্রতাপ সিং ছাড়া অন্যদের সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত সম্পর্কও ছিল চমৎকার। কিন্তু তিনি যখন কোনো নেতার প্রশংসা বা সমালোচনা করেছেন, সেটি ব্যক্তিগত সম্পর্কের ঊর্ধ্বে থেকেই।
নরসিমা রাওয়ের আমলে ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর কর সেবার নামে উগ্রপন্থী হিন্দুরা বাবরি মসজিদ গুঁড়িয়ে দেয়। তখন উত্তর প্রদেশে ক্ষমতায় ছিল বিজেপি। তাদের সহযোগী আরএসএস, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ। কুলদীপ লিখেছেন, এসব কট্টরপন্থী সংগঠন যখন বাবরি মসজিদ গুঁড়িয়ে দেওয়ার ঘোষণা দিল, কেন্দ্রীয় সরকার তাদের মোকাবিলায় কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।
এ ব্যাপারে কুলদীপের কঠোর মন্তব্য, ‘দিনদুপুরে ধর্মনিরপেক্ষতাকে হত্যা করা হলো। বিজেপি নেতারা একে নিছক একটি স্থাপনা হিসেবে দেখলেও এটি ভারতের অন্যতম ধর্মনিরপেক্ষ কাঠামো ছিল।’ সে সময়ে একটি পত্রিকা লিখেছিল, ‘মহাত্মা গান্ধী গুলিবিদ্ধ হন ১৯৪৮ সালের ৩০ জানুয়ারি, কিন্তু তিনি নিহত হন ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর।’
মতপ্রকাশের স্বাধীনতার জন্য আমৃত্যু লড়াকু মানুষ কুলদীপ নায়ারের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই।