পার্বত্য চট্টগ্রামে কোনো যুদ্ধ পরিস্থিতি নেই, কিন্তু কেন সেখানে অবিরাম রক্ত ঝরছে—এই প্রশ্ন আমরা গুরুত্বের সঙ্গে তুলতে চাই। কেননা, কিছুদিন পরপরই সেখানকার পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর সংগঠনগুলোর সদস্যরা দিনদুপুরে আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে পরস্পরকে আক্রমণ করে হত্যাকাণ্ড ঘটাচ্ছেন, কিন্তু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলো তাঁদের দমন করতে পারছে না। এমনকি কখনো কখনো তাঁরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সামনেই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে নির্বিঘ্নে চলে যাচ্ছেন। এর সর্বশেষ দৃষ্টান্ত গত শনিবারের হত্যাকাণ্ড। ওই দিন সকাল সাড়ে সাতটার দিকে একদল সশস্ত্র লোক এলোপাতাড়ি গুলি চালিয়ে ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের (ইউপিডিএফ) তিন নেতাসহ ছয়জনকে হত্যা করেন খাগড়াছড়ি সদরের স্বনির্ভর বাজারের পুলিশ ফাঁড়ির কাছেই। প্রশ্ন হলো, পুলিশ বাহিনী সেখানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার কী দায়িত্ব পালন করছে?
ইউপিডিএফের মুখপাত্র খাগড়াছড়ির সংগঠক মাইকেল চাকমা প্রথম আলোর কাছে অভিযোগ করেছেন, শনিবারের ওই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে জনসংহতি সমিতি এম এন লারমা এবং ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক নামের দুটি প্রতিপক্ষ সংগঠন। এই দুটি সংগঠন বরাবরের মতোই অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছে। খুনোখুনির দায়ে পরস্পরকে অভিযুক্ত করা এবং সেই অভিযোগ ভিত্তিহীন বলে প্রত্যাখ্যান করার মধ্য দিয়ে রক্তপাত চলেছে অব্যাহতভাবে। দেখা যাচ্ছে, গত বছরের ডিসেম্বর থেকে চলতি বছরের গত শনিবার পর্যন্ত প্রতি মাসেই উভয় পক্ষের কেউ না কেউ হত্যার শিকার হয়েছেন। এভাবে গত ৯ মাসে মারা গেছেন মোট ৩৪ জন। শুধু চলতি আগস্ট মাসেই মারা গেছেন ৮ জন।
পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে শুধু যে পর্যাপ্তসংখ্যক পুলিশই আইনশৃঙ্খলার দায়িত্বে নিয়োজিত আছে তা নয়, র্যাব, বিজিবিসহ অন্যান্য নিরাপত্তা বাহিনীও আছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও পাহাড়ি সংগঠনগুলোর সদস্যদের মধ্যে যে সশস্ত্র সংঘাত চলে আসছে, তা দেশের অন্যান্য অঞ্চলের মতো নয়। পরস্পরকে হত্যা করার কাজে তারা যেভাবে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করে, তাতে মনে হয় যেন পার্বত্য অঞ্চলে অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র সহজলভ্য এবং সেগুলোর ব্যবহার যথেচ্ছভাবে করা যায়। একের পর এক হত্যাকাণ্ড ঘটে, কিন্তু হত্যার মতো গুরুতর ফৌজদারি অপরাধের বিচার হয় না। মামলা হয়, কিন্তু সেসব মামলার কোনো অগ্রগতি হয় না। দৃশ্যত, পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে সরকারি প্রশাসন ও রাষ্ট্রের আইনকানুন কার্যকর নয়।
কিন্তু কেন এই পরিস্থিতি? আমরা প্রত্যাশা করেছিলাম, ১৯৯৭ সালের ডিসেম্বরে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর ওই অঞ্চলে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা পাবে। কিন্তু ওই চুক্তির বিষয়ে পার্বত্য জনগোষ্ঠীর বিভিন্ন সংগঠনের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দেয়, ইউপিডিএফ চুক্তিটির বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। ফলে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর বিভিন্ন অংশের মধ্যে সংঘাত-সহিংসতায় ২০১৫ সাল পর্যন্ত কয়েক শ মানুষের মৃত্যু ঘটে। ওই বছর পার্বত্য অঞ্চলের তিনটি প্রধান সংগঠনের মধ্যে সমঝোতা হলে সহিংসতা বন্ধ হয়। কিন্তু গত বছরের নভেম্বরে ইউপিডিএফ ভেঙে ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক নামে আরেকটি সংগঠনের জন্ম হওয়ার পর ডিসেম্বর থেকে আবার সহিংসতা শুরু হয়। ওই মাসে ইউপিডিএফের দুই নেতার হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে শুরু হয় রক্তপাতের নতুন অধ্যায়, যা ক্রমে অধিকতর উদ্বেগের বিষয় হয়ে উঠছে।
এভাবে আর চলতে দেওয়া যাবে না। পাহাড়ে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে হবে। চলমান বিরোধ-সংঘাতের প্রধান কারণ পাহাড়ি সংগঠনগুলোর মতাদর্শগত ভিন্নতা নয়, বরং চাঁদাবাজির উদ্দেশ্যে এলাকায় আধিপত্য বিস্তারের প্রতিযোগিতা। পাহাড়ে চাঁদাবাজি অবশ্যই বন্ধ করতে হবে। সে জন্য আইন প্রয়োগের ব্যবস্থাকে আরও দক্ষ, সৎ, সক্রিয় ও ফলপ্রসূ করতে হবে। বিবদমান গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে সমঝোতা সৃষ্টি ও সামগ্রিক সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা একান্ত প্রয়োজন। পাহাড়ে রক্তপাত অব্যাহতভাবে চলতে দেওয়া যায় না।