ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু চীনের প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাইকে গর্বের সঙ্গে সমর্থন দিয়েছিলেন। ফার্স্ট ফ্রন্ট আর্মি কমান্ডার চিয়াং কাই শেককে পরাজিত করে চৌ ক্ষমতায় এসেছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মিত্রবাহিনীর জয়-পরাজয়ের ওপর ভারতের স্বাধীনতালাভ নির্ভর করছে না বলে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল ঘোষণা দেওয়ার পর চীনের এই প্রধানমন্ত্রী ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনকে সমর্থন দেন। তিনি সর্বান্তকরণে চেয়েছিলেন, ভারত স্বাধীন হোক।
সেই চৌ এন লাই ১৯৬২ সালে ভারতকে আক্রমণ করে নেহরুর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেন। সেই আঘাত এতটাই গভীর ছিল যে তা নেহরু আর কাটিয়ে উঠতে পারেননি। পরে অবশ্য এই দুই দেশ কলম্বো প্রস্তাব সংশোধন করায় নেহরুর মান-ইজ্জত অংশত পুনরুদ্ধার হয়েছিল। সংশোধনের আগে মূল কলম্বো প্রস্তাবে চীনের গায়ের জোরে করা সীমানারেখা অনুমোদন করা হয়েছিল। ভারত বেইজিংয়ে নিযুক্ত রাষ্ট্রদূত প্রত্যাহার করে এ বিষয়ে বিরক্তি প্রকাশ করেছিল। পরে সেই প্রস্তাব সংশোধন করা হলেও তখন থেকে দুই দেশের সম্পর্কের মধ্যে তিক্ততা রয়েই গেছে।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সাম্প্রতিক চীন সফরে মনে হচ্ছে, তিনি চীনের একপক্ষীয়ভাবে ঠিক করা সীমানা নির্ধারণের বিষয়টি মেনে নিয়েছেন। বিজেপি মোদিকে সমর্থন করে হয়তো বলতে পারে, দুই দেশের মধ্যে কার্যত যে সীমানা বলবৎ আছে, তিনি সেটিকেই মেনে নিয়েছেন। কিন্তু এটিকে ভারতের ঐতিহাসিক শোচনীয় পরাজয় হিসেবে দেখা হচ্ছে। বাস্তবিক অর্থেই এটি ভারতের পরাজয়। এই কাজ যদি কংগ্রেস পার্টি করত, তাহলে দলটির গায়ে ভারত বিক্রি করা শক্তি হিসেবে তকমা লাগিয়ে দেওয়া হতো।
সীমান্তসংক্রান্ত কূটকৌশল সম্বন্ধে যাঁদের তেমন কোনো জ্ঞান নেই, তাঁরা হয়তো মোদির হিন্দিতে দেওয়া ভাষণের ফুলঝুরি শুনে মোহিত হবেন। কিন্তু অবাক করা বিষয় হলো, আরএসএসের নীতিনির্ধারকেরা তো সাধারণ জ্ঞানহীনদের মতো নন। তারপরও আরএসএসের নাগপুর সদর দপ্তর মোদিকে সমর্থন দিচ্ছে।
সীমান্তরেখা কোনটি ঠিক, তা নিয়ে চীন ও ভারত কদাচিৎই একমত হয়েছে। নেহরু একবার বলেছিলেন, ভারতের ভূখণ্ডে অনুপ্রবেশকারীদের নিকেশ করে দেওয়ার জন্য তিনি সেনাবাহিনীকে নির্দেশ দিয়েছিলেন। তখন থেকেই দুই দেশের মধ্যে কমবেশি বৈরীভাব। এই কিছুদিন আগেও দোকলামে ভারত তার শক্তি প্রদর্শন করেছে। এরপরই বর্তমান সীমানারেখার বাইরে চীন তাদের সেনা সরিয়ে নিয়েছে।
গত সেপ্টেম্বরে মোদির ব্রিকস সম্মেলনে যোগদান দুই দেশের উত্তেজনা কিছুটা কমিয়েছিল। এই সফরের বড় ইতিবাচক দিক ছিল, তখন দুই নেতাই সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালানোর বিষয়ে একমত হয়েছিলেন। তবে এখানেও বেইজিং তার নিজস্ব তত্ত্ব বারবার ব্যাখ্যা করছিল।
মাথায় রাখতে হবে, চীন ও পাকিস্তানের মধ্যে সম্পর্ক যত জোরদার হচ্ছে, ততই সেটি ভারতের মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠছে। খুব বেশি দিন আগের কথা নয়, যখন অরুণাচল প্রদেশ থেকে কেউ চীনে যেতে চাইলে চীনা কর্মকর্তারা তাঁদের পাসপোর্টে ভিসা স্ট্যাপলিং করে দিতেন। চীন কৌশলে বোঝাতে চাইত, এটি ‘স্বতন্ত্র ভূখণ্ড’, এটি ভারতের একক মালিকানাধীন ভূখণ্ড নয়।
এই সব অপমান নয়াদিল্লি নীরবে মুখ বুজে সহ্য করে এসেছে। অরুণাচলকে ভারতের অংশ হিসেবে উল্লেখ করা মানচিত্রকে একসময় চীন কোনোরকমের আপত্তি ছাড়াই গ্রহণ করেছিল। অরুণাচল ও চীন সীমান্তের মাঝের ছোট একটুকরো ভূখণ্ড ছাড়া অরুণাচলের মালিকানা নিয়ে তাদের তেমন কোনো প্রশ্ন ছিল না। কিন্তু এখন চীনের সুর বদলে গেছে।
গত বছর দালাই লামা অরুণাচল প্রদেশ সফর করেন। তার এই সফর তিব্বতে চীনের উপস্থিতির আগের দিনগুলো স্মরণ করিয়ে দিয়েছিল।
অরুণাচলে দালাই লামার সফরকে চীন ‘উসকানি’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছিল। ভারতকে তারা হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছিল, তার এই সফর দুই দেশের সম্পর্কে চিড় ধরাতে পারে। তারপরও ভারত কৌশলে পরিস্থিতি সামাল দিয়েছে।
আসলে চীনের সঙ্গে ভারতের এই সমস্যার মূলে রয়েছে ভারত-চীন নিয়ে ব্রিটিশদের করা আদি মানচিত্র। ম্যাকমোহন লাইন অনুযায়ী, অরুণাচলের পুরোটাই ভারতের মধ্যে পড়েছে। কিন্তু চীন এখন সেটি স্বীকার করতে চায় না। চীনের আপত্তি সত্ত্বেও ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী নির্মলা সীতারাম সম্প্রতি সেখানকার ‘অমীমাংসিত’ ভূমি পরিদর্শন করেছেন। এর মাধ্যমে ভারত বুঝিয়ে দিয়েছে, আক্রান্ত হলে তারাও পাল্টা আঘাত হানার জন্য প্রস্তুত আছে।
এখন অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, বেইজিং চীন-ভারতের ‘ভাই ভাই পরিস্থিতি’ ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছে। দোকলাম সংকটের পর নরেন্দ্র মোদির প্রথমবারের মতো চীন সফরের পর চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একটি বিবৃতিতে বলেছে, পারস্পরিক স্বার্থের প্রতি সম্মান বজায় রেখে দ্বিপক্ষীয় সমস্যার সমাধানের পথ খুঁজে বের করার মতো প্রজ্ঞা উভয় দেশের নেতাদের রয়েছে। তবে অরুণাচল প্রশ্নে মোদি যদি শক্ত অবস্থান না নেন, তাহলে সেটি ভবিষ্যতে ভারতের জন্য বড় ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।
ইংরেজি থেকে অনূদিত
কুলদীপ নায়ার: ভারতের সাংবাদিক ও কলামিস্ট