কাশ্মীরে পাথর ছোড়াছুড়ি পাকিস্তানের আজ্ঞায় ঘটে নাকি ব্যাপারটা মৌলবাদীদের আহ্বানের সাড়া—এ নিয়ে জল্পনাকল্পনা যা-ই থাকুক না কেন, তাতে এই সত্যের কোনো হেরফের হচ্ছে না যে কাশ্মীর উপত্যকায় শান্তি নেই। প্রচুর স্কুল পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, শিক্ষার্থীরা ভয় পাচ্ছে যে ক্লাসে বা পরীক্ষা দিতে গেলে তাদের বিপদ হতে পারে। বলা হচ্ছে কাশ্মীরের বিচ্ছিন্নতাবাদীরা লেখাপড়া বর্জনের জন্য একটা আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছে।
তার ফল হলো এই যে শিক্ষার্থীরা পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে পারছে না, পরীক্ষা দিতেও যেতে পারছে না। কিন্তু সারা ভারতের শিক্ষার্থীরাই শান্তিপূর্ণভাবে ক্লাস-পরীক্ষা চালিয়ে যাচ্ছে। বিচ্ছিন্নতাবাদীদের উপলব্ধি করা উচিত যে শিক্ষার্থীদের অসহায় পরিস্থিতির মধ্যে ফেলে দিয়ে, তাদের দুর্ভোগ সৃষ্টি করে কোনো রাজনৈতিক আন্দোলন চলতে পারে না, চালানো উচিত নয়।
কাশ্মীরে উত্তেজনার আর একটা ফল হলো সেখানে পর্যটকদের ভিড় কমে যাচ্ছে। খুব ভালো কথা যে সৈয়দ আলী শাহ গিলানি শ্রীনগরের রাস্তায় মিছিলের নেতৃত্ব দিয়েছেন পর্যটকদের এই আশ্বাস দিতে, সব পরিস্থিতিতে তাঁদের নিরাপত্তা রক্ষা করা হবে। কিন্তু যতই আশ্বাস দেওয়া হোক, পর্যটকেরা কাশ্মীরের চেয়ে অন্যান্য পাহাড়ি এলাকায় যেতেই বেশি চাইছেন। পর্যটকদের দৃষ্টিকোণ থেকে এটা বোধগম্য। কিন্তু শ্রীনগরে ডাল লেকের শিকারা বা নাগিন বাগের ডোঙাগুলো খদ্দের পাচ্ছে না। কাশ্মীরের সাধারণ লোকজনের অভাব-অনটন বাড়ছে, রাজ্যটির অর্থনীতির ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে।
কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রী মেহবুবা মুফতি তাঁর রাজ্যের এই পরিস্থিতি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল বলে মনে হচ্ছে না। তিনি অজস্রবার বলেছেন যে একমাত্র ব্যক্তি কাশ্মীর সংকটের সমাধান করতে পারেন, তিনি হলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। এটা বলার মধ্য দিয়ে তিনি সম্ভবত কাশ্মীরের পিপলস ডেমোক্রেটিক পার্টি ও কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন বিজেপির মধ্যকার জোটের গুরুত্বই তুলে ধরতে চাইছেন। তবে নয়াদিল্লির খতিয়ে দেখা উচিত একসময়ের ভারতপন্থী শাব্বির খান কেন ঘুরে গিয়ে আজাদিপন্থী হয়ে গেলেন। কাশ্মীর উপত্যকায় কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য যে অবস্থান তাঁর খুব দরকার, তিনি সম্ভবত তা পাচ্ছেন না। তাঁর মতো ব্যক্তিদের সঙ্গে বিজেপির কোনো যোগাযোগ নেই। ইয়াসিন মালিকের ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার, এই ব্যক্তিও অখণ্ড ইউনিয়নের মধ্যেই কাশ্মীর সমস্যার সমাধান চাইতেন। কিন্তু নয়াদিল্লি ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ এমন বিস্তৃতভাবে ব্যাখ্যা করে যে ক্ষমতা পুঞ্জীভূত হয়েছে কেন্দ্রের হাতে।
কাশ্মীরিরা তাদের উর্দু ভাষার প্রতি নয়াদিল্লির আচরণকে বিমাতাসুলভ আচরণ হিসেবে ভীষণভাবে অনুভব করে এবং এটা সাধারণভাবে মনে করা হয় যে উর্দু ভাষার প্রতি কেন্দ্রের অবহেলার কারণ হলো উর্দুকে মুসলমানদের ভাষা বলে মনে করা হয়। নয়াদিল্লি যদি উর্দুকে আপন মনে করত, ভাষাটাকে উৎসাহিত করত, তাহলে কাশ্মীরিদের ক্ষোভের অন্তত একটা কারণ কমে যেত।
কিছু সময় আগ পর্যন্ত কাশ্মীরের লোকজন নয়াদিল্লির বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে তুলে নেওয়ার পক্ষপাতী ছিল না। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং কাশ্মীরে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনার উপায় বের করার জন্য অবিরাম চেষ্টা করে চলেছেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, কাশ্মীরের জনগণ মনে করছে সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো যা করার চেষ্টা করছে তার মধ্য দিয়ে তাদের আত্মপরিচয় প্রতিষ্ঠা পাবে। সুতরাং সেখানে সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে কোনো প্রতিরোধ নেই—এ কথা বলে যাঁরা সমালোচনা করছেন, তাঁদের বুঝতে হবে যে প্রতিরোধের অনুপস্থিতি কাশ্মীরিদের বিচ্ছিন্নতাবোধেরই একটা অংশ।
এটা দুর্ভাগ্যজনক যে বছর দুয়েক আগে কাশ্মীরে ব্যাপক বন্যায় ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে নয়াদিল্লি যে সহযোগিতার প্যাকেজ ঘোষণা করেছিল, তা দেয়নি। কিন্তু সে জন্য সংবাদমাধ্যমে বা রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে নয়াদিল্লির সমালোচনা লক্ষ করা যায়নি। কোনো নেতা নয়াদিল্লিকে স্মরণ করিয়ে দেননি যে তাঁরা ওয়াদা খেলাপ করেছেন। এসব আচরণকেই কাশ্মীরের মানুষ তাদের প্রতি নয়াদিল্লির গুরুত্বহীনতার ইচ্ছাকৃত স্বাক্ষর হিসেবে বুঝে নেয়। এসব সত্ত্বেও আমি এখনো মনে করি, ১৯৫৩ সালের চুক্তির অনুসরণে কাশ্মীর রাজ্যের অবস্থার উন্নতি ঘটানো সম্ভব। ওই চুক্তিতে ভারত প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্রনীতি ও যোগাযোগব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা পেয়েছে।
কাশ্মীর রাজ্যের মর্যাদা ও সার্বিক পরিস্থিতির জন্য সেখানকার যুবসমাজ ভীষণ ক্ষুব্ধ। তাদের ক্ষোভ প্রশমিত করা যাবে, যদি সমগ্র ভারতীয় বাজারে তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য ও সেবার সুযোগ সৃষ্টি করা হয়। কিন্তু শুধু এটাই যথেষ্ট হবে না, প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্রনীতি ও যোগাযোগব্যবস্থার বাইরে কেন্দ্রীয় যা কিছু কর্মকাণ্ড কাশ্মীরের মাঠপর্যায়ে রয়েছে, নয়াদিল্লিকে তা প্রত্যাহার করে নিতে হবে। প্রায় ২৬ বছর আগে ওই রাজ্যে অত্যন্ত অস্বাভাবিক পরিস্থিতি মোকাবিলা করার উদ্দেশ্যে যে সশস্ত্র বাহিনী (বিশেষ ক্ষমতা) আইন প্রণয়ন করা হয়েছিল, তা আজও বলবৎ আছে। সরকার যদি আইনটি প্রত্যাহার করে নিত, তাহলে একদিকে কাশ্মীরিদের ক্ষোভ প্রশমিত হতো, অন্যদিকে নিরাপত্তা বাহিনীগুলোকে আরও দায়িত্বশীল আচরণ করতে হতো।
কাশ্মীরে ন্যাশনাল কনফারেন্স মহারাজা হরি সিংকে সরানোর উদ্দেশ্যে এবং শেখ আবদুল্লাহর মতো আইকনিক নেতাকে দিয়ে অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা চালু করতে এক দীর্ঘ সংগ্রাম চালায়। কিন্তু নয়াদিল্লির সঙ্গে নৈকট্যের কারণে দলটি বিধানসভার নির্বাচনে পরাজিত হয়। পিপলস ডেমোক্রেটিক পার্টি জয়ী হয়, কারণ দলটির প্রতিষ্ঠাতা মুফতি মোহাম্মদ সাঈদ দলটিকে নয়াদিল্লি থেকে বিচ্ছিন্ন না করেও একটা দূরত্ব বজায় রেখেছিলেন।
কাশ্মীরের জনগণ পিডিপি-বিজেপি জোটকে ভোট দিয়েছে এ কারণে যে এই দুই রাজনৈতিক শক্তির মিলন থেকে তারা একটা আত্মপরিচয়ের অনুভূতি পেয়েছে। ন্যাশনাল কনফারেন্সের দিল্লিপন্থী ভাবমূর্তির কারণে ওমর ফারুক আবদুল্লাহকে মাশুল গুনতে হয়েছে। ভারতের সঙ্গে কাশ্মীরের সম্পর্ক এত নিবিড় যে তাকে চ্যালেঞ্জ করার প্রশ্নই আসে না। কিন্তু তা সত্ত্বেও বিরুদ্ধশক্তি যত ছোটই হোক, তা কাশ্মীরিদের মনে নয়াদিল্লির বশ্যতা অস্বীকার করার একটা পরোক্ষ সন্তোষ সৃষ্টি করে।
লর্ড সিরিল জন র্যাডক্লিফ কাশ্মীরকে কোনো গুরুত্ব দেননি। লন্ডনের এই বিচারক দুই পৃথক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে বিভাজনরেখা টেনেছিলেন। তার অনেক বছর পরে এক সাক্ষাৎকারে আমাকে বলেছিলেন, কাশ্মীর যে পরবর্তীকালে এতটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে, তিনি তা কখনো কল্পনাই করেননি। আজ থেকে বছর দুই আগে শ্রীনগরে এক উর্দু পত্রিকার প্রথম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী অনুষ্ঠানে যোগ দিতে গিয়ে র্যাডক্লিফের ওই কথা আমার মনে পড়ে গিয়েছিল। ঢাকঢোল না পিটিয়েই ভারতের সব রাজ্য থেকে উর্দু ভাষাকে বিতাড়িত করা হয়েছে। এমনকি যে পাঞ্জাব রাজ্যে কয়েক বছর আগেও প্রধান ভাষাই ছিল উর্দু, সেখান থেকেও। আসলে পাকিস্তান উর্দুকে তাদের রাষ্ট্রভাষা ঘোষণা করার পর থেকেই ভারতে ভাষাটির গুরুত্ব হারিয়ে যায়।
স্বাভাবিকতা একটা মানসিক অবস্থাও বটে। কাশ্মীরের জনগণের নিজেদেরই অনুভব করতে হবে যে তাদের আত্মপরিচয় আক্রান্ত নয় এবং তারা যা আকাঙ্ক্ষা করে নয়াদিল্লি তার গুরুত্ব উপলব্ধি করে। আর নয়াদিল্লিকে বুঝতে হবে যে কাশ্মীরিদের নিজেদের ভারত থেকে দূরে সরে যাওয়ার আকাঙ্ক্ষার অর্থ সত্যিকারভাবে নয়াদিল্লি থেকে শ্রীনগরের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর নয়। তা সত্ত্বেও স্বশাসনের বোধ রক্ষা করতে হবে, তা মূল্য যা-ই হোক না কেন।
অনুবাদ: মশিউল আলম।
কুলদীপ নায়ার: ভারতের সাংবাদিক।