পাচার করা অর্থ ফিরিয়ে আনার দায় কার

গত কয়েক বছরে বিদেশে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার হয়েছে। কত অর্থ পাচার হয়েছে, সেটার কিছু হিসাব বিভিন্ন সংস্থার কাছে রয়েছে। পাচার রোধ করা কিংবা পাচার হয়ে যাওয়া অর্থ ফেরত আনার ব্যাপারে বিগত সরকারের কোনো সদিচ্ছা ছিল না। আর্থিক খাত সংস্কার করতে চাইলে নতুন সরকারকে এই পাচারকৃত অর্থ ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে কার দায় কতটুকু, তা নিয়ে লিখেছেন ফারুক মঈনউদ্দীন

বিগত বছরগুলোতে বাংলাদেশ থেকে বিদেশে অর্থ পাচারের বিষয়টি এত ব্যাপকভাবে আলোচিত ছিল যে সাধারণ মানুষের কাছে এখন এটি আর অজানা নেই। তবে অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়েছে, কেবল সরকারের কাছেই জানা ছিল না ব্যাপারটা। তা না হলে সংসদে ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেট আলোচনার সময় তৎকালীন অর্থমন্ত্রী বলতে পারতেন না, কারা অর্থ পাচার করে, সেই তালিকা তাঁর কাছে নেই। নামগুলো যদি কেউ জানেন, তাহলে যাতে তালিকাটা তাঁকে দেওয়া হয়।

এ রকম ডাহা মিথ্যা ভাষণের পর তৎকালীন অর্থমন্ত্রী জাতির বিবেকের মতো আরও বলেছিলেন, দেশের মানুষের কষ্টার্জিত টাকা বিদেশে চলে গেলে আর সবার যেমন লাগে, তাঁরও তেমন লাগে। তিনি, ‘অনিয়ম, বিশৃঙ্খলার বিরুদ্ধে। এগুলো বন্ধ করতে হবে।’ 

তারপর দাবি করেন যে এসব ‘বন্ধ হচ্ছেও। অনেকেই জেলে আছেন। বিচার হচ্ছে। আগে যেমন ঢালাওভাবে চলে যেত, এখন তেমন নেই।’ 

এটাও ছিল জাতির সঙ্গে একধরনের মশকরা। সরকারের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের প্রধান যখন সংসদে এ রকম কথা অবলীলায় বলতে পারেন, সেটাকে মশকরা ছাড়া আর কী-ই বা বলা যায়। ২০২৪ সালে সরকার পতনের পাঁচ মাস আগেও সেই সরকারের অর্থনীতিবিষয়ক উপদেষ্টা ঘোষণা করেছিলেন, পাচার করা অর্থ ফেরত আনার ব্যবস্থা করা হবে। কিন্তু এসব যে কেবলই কথার কথা ছিল, তৎকালীন অর্থমন্ত্রীর উপরোক্ত মন্তব্য ও অবস্থান থেকে বিষয়টা আবারও পরিষ্কার হয়। আসলে অর্থ পাচার রোধে সরকার কখনোই আন্তরিক ছিল না। 

■ বাংলাদেশের বিদ্যমান মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন অনুযায়ী আদালত দেশে বা বিদেশে অবস্থিত মানি লন্ডারিং অপরাধলব্ধ সম্পত্তি অধিগ্রহণ করতে পারেন। 

■ বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচারকারীরা যেসব উন্নত দেশে সম্পদ গড়ে তুলেছেন, সেসব উদ্‌ঘাটন এবং রোধ করতে দেশগুলোর কর্তৃপক্ষেরও একটি বড় ভূমিকা রয়েছে।

■ বিদেশি রাষ্ট্রের সঙ্গে চুক্তি করে সেই দেশের কাছ থেকে অর্থ পাচার সম্পর্কিত প্রয়োজনীয় তথ্য চাওয়ার সুযোগ রয়েছে। প্রয়োজনীয় আইন থাকা সত্ত্বেও সেটা কখনোই ব্যবহার করা হয়নি।

■ বর্তমান সরকারকে আর্থিক খাতে সুশাসনের ঘাটতিগুলো দূর করার বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। দেশের সম্পদ ফেরত আনাও এই অগ্রাধিকারের মধ্যে পড়ে। 

এ প্রসঙ্গে একটি উদাহরণ দেওয়া যাক। ২০১৩ সালের শেষ দিকে ঢাকার একাধিক জাতীয় দৈনিকে বিশাল বিজ্ঞাপন দিয়ে বাংলাদেশি নাগরিকদের দুবাইতে অ্যাপার্টমেন্ট কেনায় সহায়তা দেওয়ার জন্য একটি অভিজাত হোটেলে দুদিনের মেলার আয়োজন করেছিল দামাক প্রপার্টিজ নামে দুবাইভিত্তিক একটি প্রতিষ্ঠান। যদিও বিজ্ঞাপনটি প্রকাশের পরদিনই বাংলাদেশ ব্যাংকের ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্ট ইউনিট পাল্টা বিজ্ঞাপন দিয়ে বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ আইনে বাংলাদেশিদের বিদেশে সম্পত্তি কেনার ওপর বিধিনিষেধ সম্পর্কে স্মরণ করিয়ে দেয়। এমনকি এ-জাতীয় অননুমোদিত কাজে প্রলুব্ধকর বিজ্ঞাপন প্রকাশ না করার ব্যাপারে গণমাধ্যমগুলো যাতে আরও দায়িত্বশীল হয়, সে পরামর্শও দেওয়া হয়েছিল। 

এই বিজ্ঞাপনের পর অবশ্য দুদিনের মেলা এক দিনে শেষ করে আয়োজকরা লাপাত্তা হয়ে যায়। কিন্তু দুবাইতে বাংলাদেশিদের সম্পত্তি কেনা থেমে থাকেনি। প্যারিসভিত্তিক গবেষণাপ্রতিষ্ঠান ইইউ ট্যাক্স অবজারভেটরির ২০২২ সালের মে মাসের রিপোর্ট অনুযায়ী, দুবাইতে ৯৭২টি সম্পদ কিনেছেন ৪৫৯ জন বাংলাদেশি। এই সম্পদের মোট মূল্য ৩১ কোটি ৫০ লাখ ডলার। বিদেশে অর্থ পাচার করে জমিজমা বা ঘরবাড়ি কেনার এই হিসাব দ্য টিপ অব দ্য আইসবার্গ (হিমশৈলের চূড়া)।  

আইনে বাংলাদেশি নাগরিকদের বিদেশে সম্পত্তি কেনার জন্য অর্থ স্থানান্তরের বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও দামাক প্রপার্টিজের এই বিজ্ঞাপন ও আয়োজন ছিল আমাদের বিদ্যমান আইনের প্রতি সরাসরি অবজ্ঞা। কারণ, বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ আইন সম্পর্কে খোঁজখবর নিয়েই এই প্রচারণা চালাচ্ছিল প্রতিষ্ঠানটি।

দেশের মন্ত্রী তথা সরকার যখন এই আইনের প্রতি উদাসীন থাকে, তখন দুবাইভিত্তিক প্রতিষ্ঠানটিকে একতরফা দোষও দেওয়া যায় না। বরং আমাদের কর্তৃপক্ষেরই উচিত ছিল সেই আয়োজনে কারা কারা দুবাইতে সম্পত্তি কেনার ব্যাপারে খোঁজখবর করতে গিয়েছিলেন, তাঁদের শনাক্ত করা। 

কারণ, কেবল সম্ভাব্য অর্থ পাচারকারীদের ধরা নয়, তাঁদের পরিচয় ও আর্থিক অবস্থা সম্পর্কে তথ্যও আমাদের জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের জন্য খুব প্রয়োজনীয় ছিল। দুর্ভাগ্যের বিষয়, আমাদের দেশের সরকারি মহলে স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে এ–জাতীয় কোনো কাজ করার নজির নেই বললেই চলে।

স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে উদ্যোগী হওয়ার নজির কখনো কখনো বিচার বিভাগ স্থাপন করেছে। ‘আলাদিনের প্রদীপ’-এর বদৌলতে বাংলাদেশের অত্যন্ত প্রভাবশালী এস আলম গ্রুপ সিঙ্গাপুরে ১০০ কোটি ডলার পাচার করে সেখানে বাণিজ্য সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছে, ২০২৩ সালে এমন অনুসন্ধানী রিপোর্ট প্রকাশ করেছিল একটি ইংরেজি দৈনিক । 

সেই সংবাদের সূত্র ধরে হাইকোর্ট বিভাগ স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন, ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) এবং সিআইডিকে তদন্তের নির্দেশ দেন। সেই সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর, অর্থ, পররাষ্ট্র ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, এনবিআর এবং পুলিশের আইজিকেও এই নির্দেশের পক্ষভুক্ত করা হয়েছিল। 

গ্রুপটি এ সময় তাদের বিরুদ্ধে আর কোনো সংবাদ প্রকাশ এবং তদন্ত চালানোর জন্য হাইকোর্টের নির্দেশের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা চেয়ে উচ্চতর আদালতে এক নজিরবিহীন আবেদন করে। প্রায় ছয় মাস পর উচ্চতর আদালত হাইকোর্টের উপরোক্ত আদেশ স্থগিত করে দেন। তবে আদেশে বলা হয়—দুদক, বিএফআইইউ এবং সিআইডি নিজ উদ্যোগে তদন্ত চালাতে পারে।

সিঙ্গাপুরে অর্থ পাচার করে সম্পদ কেনার ওপরের উদাহরণটাও হিমশৈলের চূড়ামাত্র। কারণ, যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণাপ্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটির রিপোর্ট অনুযায়ী দেড় দশকে বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়েছে প্রায় ১৮ লাখ কোটি টাকা। সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলোতে ২০২১ সালের হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশিদের গচ্ছিত মোট অর্থের পরিমাণ ছিল ৮৭ কোটি ১১ লাখ সুইস ফ্রাঁ (বর্তমান বিনিময় হারে বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা)।

চলতি বছরের মার্চ মাসের শেষে মালয়েশিয়ার সরকারি হিসাব অনুযায়ী ‘সেকেন্ড হোম’ সুবিধা নিয়ে দেশটিতে সম্পত্তি কিনেছেন ৩ হাজার
৬০৪ জন বাংলাদেশি। মালয়েশিয়ায় এই সুবিধাভোগী দেশগুলোর তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান চতুর্থ স্থানে।

কয়েক বছর ধরে ব্যাপক প্রচার পাওয়া এসব হিসাব আজ প্রায় সবারই জানা। সেই সঙ্গে এটাও বোঝা কঠিন ছিল না যে পাচার রোধ করা কিংবা পাচার হয়ে যাওয়া অর্থ ফেরত আনার ব্যাপারে বিগত সরকারের কোনো সদিচ্ছা ছিল না। সদিচ্ছা ও আন্তরিকতা থাকলে কাজটা কঠিন হলেও অসম্ভব ছিল না।

এগমন্ট গ্রুপের (বিশ্বের বিভিন্ন দেশের আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থার সমন্বয়ে গঠিত আন্তর্জাতিক ফোরাম) সদস্য হিসেবে বাংলাদেশ এই গ্রুপের অন্য সদস্যদের কাছ থেকে অর্থ পাচার–সংক্রান্ত সব তথ্য পাওয়ার অধিকার রাখে। কিন্তু সেই সুবিধাটুকুও কখনো নেওয়া হয়নি। যোগাযোগ করা হয়নি পাচারকৃত অর্থের সহজ গন্তব্য সুইজারল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, দুবাই, কানাডা, ব্রিটেন Ñবা অন্য কোনো দেশের সরকারের সঙ্গে।

সম্প্রতি সিঙ্গাপুরে এস আলম গ্রুপের সম্পত্তি কেনা নিয়ে দেশের সংবাদমাধ্যমে আরও নিবিড় অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার পর দেশটির আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা দেশে-বিদেশে এই গ্রুপের সম্পদের তথ্য চেয়েছে বিএফআইইউর কাছ থেকে। এই উদ্যোগের সূত্র ধরে বাংলাদেশের তরফ থেকে বিভিন্ন দেশের সরকারের সহযোগিতা চাওয়া হলে নিশ্চিত কিছু সুফল পাওয়া যেতে পারে।

এখানে উল্লেখ করা উচিত, ২০২৩ সালের আগস্ট মাসে সিঙ্গাপুর কর্তৃপক্ষ অর্থ পাচারকারীদের বিরুদ্ধে দেশটির ইতিহাসে সবচেয়ে বড় আকারের অভিযান চালিয়েছিল। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে অবৈধ উপায়ে অর্থ পাচারকারীদের বিরুদ্ধে এই অভিযান চালানো হয়। ব্যাপক এই অভিযানে ১০০ কোটি সিঙ্গাপুর ডলারের সমপরিমাণ সম্পদ ও নগদ মুদ্রা জব্দ করা হয়েছিল বলে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে খবর প্রচারিত হয়। সিঙ্গাপুর কর্তৃপক্ষের এমন উদ্যোগের পর আমাদের সরকার দেশটির কাছ থেকে সহায়তা নিতে পারে। 

এ ছাড়া বাংলাদেশের বিদ্যমান মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২ অনুযায়ী আদালত দেশে বা বিদেশে অবস্থিত মানি লন্ডারিং অপরাধলব্ধ সম্পত্তি অধিগ্রহণ করতে পারেন। এমনকি সেই অর্থ বা সম্পত্তি শনাক্ত করা সম্ভব না হলে অভিযুক্ত ব্যক্তির দেশে থাকা অন্য অর্থ বা সম্পত্তি ক্রোক করার বিধান রয়েছে আইনে। এই আইনে বিদেশি রাষ্ট্রের সঙ্গে চুক্তি করে সেই দেশের কাছ থেকে অর্থ পাচার সম্পর্কিত প্রয়োজনীয় তথ্য চাওয়ার সুযোগও অবারিত রয়েছে। অথচ প্রয়োজনীয় আইন থাকা সত্ত্বেও সেটা কখনোই ব্যবহার করা হয়নি।

এ প্রসঙ্গে একটি উল্লেখযোগ্য পর্যবেক্ষণ পেশ করা যায়। বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচারকারীরা যেসব উন্নত দেশে সম্পদ গড়ে তুলেছেন,
সেসব উদ্‌ঘাটন এবং রোধ করতে দেশগুলোর কর্তৃপক্ষেরও একটা বড় ভূমিকা রয়েছে। সেই সব দেশ বিভিন্ন সময়ে মানবাধিকার, দুর্নীতি, গণতন্ত্র ইত্যাদি বিষয়ে প্রায়ই নসিহত করে আমাদের। অথচ আমাদের দেশ থেকে বৈধভাবে বিদেশে অর্থ স্থানান্তর সম্ভব নয় জানার পরও তারা এই অবৈধ অর্থের উৎস কিংবা স্থানান্তর প্রক্রিয়া সম্পর্কে কখনোই কোনো প্রশ্ন তোলেনি। 

বিশ্ব মানি লন্ডারিংয়ের প্রেক্ষাপটে সব দেশের (এগমন্ট গ্রুপের সদস্য) সমভাবে সক্রিয় হওয়া উচিত হলেও আমাদের মতো দেশ থেকে অর্থ পাচারের বিষয়ে সেই সব দেশ নীরব ও নিষ্ক্রিয় দর্শকের ভূমিকা পালন করে আসছে। আমাদের দেশের স্বজনতোষণকারী সরকার এ বিষয়ে উদাসীন বা অনিচ্ছুক হলেও ন্যায় ও আইনের শাসন পরিপালনকারী বলে পরিচিত দেশগুলোর উদাসীনতা বা প্রশ্রয় কি তাহলে কেবল সেসব দেশের স্বার্থেই ঘটে? এই দ্বৈত নীতির কারণেই উন্নত বিশ্বের কিছু কিছু দেশ আমাদের অর্থ পাচারকারীদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে।

বর্তমান সরকার যেহেতু দেশে ন্যায়ের শাসন প্রতিষ্ঠা এবং রাষ্ট্র সংস্কারের কাজে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ বলে সাধারণ মানুষ বিশ্বাস করে, আর্থিক খাতে সুশাসনের চরম ঘাটতিগুলো দূর করাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে তাদের। দেশের সম্পদ ফেরত আনাও এই অগ্রাধিকারের মধ্যে পড়ে। 


ফারুক মঈনউদ্দীন, ব্যাংকার ও লেখক