আবু সাঈদ, আমাদের ক্ষমা করো

পুলিশের সঙ্গে আন্দোলকারী শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষের সময় গুলিতে নিহত হওয়ার আগে আবু সাঈদ

প্রিয় শিক্ষার্থী আবু সাঈদ, আমাদের ক্ষমা করো। তোমার মা–বাবার সন্তান হারানো আর্তনাদ দেখে এলাম।—লিখেছেন আমাদের বন্ধু ও বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক তুহিন ওয়াদুদ। আরও অনেকের সঙ্গে তিনিও আবু সাঈদের গ্রামের বাড়িতে গিয়েছিলেন। পিতার কাধে সন্তানের লাশ সবচেয়ে ভারী। শিক্ষকের কাধে ছাত্রের লাশও কম ভারী নয়।

শিক্ষক তুহিন ওয়াদুদ ও তাঁর সহকর্মীরা আবু সাঈদের লাশ নিয়ে যখন বাড়িতে গেলেন, শুনলেন তাঁর স্বজনদের বুকফাটা আর্তনাদ। মা মনোয়ারা বেগম আহাজারি করছিলেন, ‘মোর বাবাটাক পুলিশ গুলি করিয়া মারল ক্যান, চাকরি চাওয়াটা কি অপরাধ?’

কোরবানির ঈদের ছুটিতে শেষবারের মতো বাড়িতে এসেছিলেন সাঈদ। তিন দিন পর ক্যাম্পাসে ফিরে যান। ছেলের কথা বলে বিলাপ করছিলেন মা।

বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে কোটা সংস্কারের দাবিতে যারা আন্দোলন করছিলেন, তাঁদের অন্যতম সমন্বয়ক ছিলেন আবু সাঈদ। ইংরেজি বিভাগের ১২তম ব্যাচের শিক্ষার্থী।

সংবাদমাধ্যমের ভিডিও ও ছবিতে দেখা যায়, দুই হাত দুই দিকে প্রসারিত করে দাঁড়িয়ে আছেন। পেছনে সড়ক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের গেট। পরের ছবিতে দেখি, পুলিশের ছোড়া গুলিতে আহত হয়ে তিনি বসে পড়ছেন। আরেক ছবিতে একজন তাঁকে তুলে ওঠানোর চেষ্টা করেন। হাসপাতালে নেওয়ার পর কর্তব্যরত চিকিৎসক জানান, তিনি মারা গেছেন।

আবু সাঈদের গুলিবিদ্ধ হওয়ার দৃশ্য ধারণ করেছে একাধিক গণমাধ্যম। যমুনা টেলিভিশন এ ধরনের একটি ভিডিও প্রচার করেছে। এ ছাড়া স্থানীয়ভাবেও কেউ কেউ ভিডিও করে তা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশ করেছেন। এসব ভিডিও থেকে তাঁর গুলিবিদ্ধ হওয়ার সময়ের পরিষ্কার একটি চিত্র পাওয়া যায়। সংঘর্ষ শুরু হলে আন্দোলনকারীদের মধ্যে সবার আগে ছিলেন আবু সাঈদ। তাঁর ঠিক সামনে অবস্থান ছিল পুলিশের। পুলিশের অবস্থানের জায়গাটি ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের সামনে। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, মিছিলের সামনে থাকা আবু সাঈদকে লক্ষ্য করেই গুলি করেছে পুলিশ।

কোটা সংস্কারের দাবিতে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়া আন্দোলন রুখতে পুলিশের গুলি ও বিবদমান পক্ষগুলোর সংঘর্ষে ছয়জন মারা যান। ঢাকায় দুজন, চট্টগ্রামে তিনজন, রংপুরে একজন।

ঢাকার সায়েন্স ল্যাবরেটরি মোড়ে কোটা সংস্কারকারী ও ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের মধ্যে দফায় দফায় সংঘর্ষে মোহাম্মদ শাহজাহান নামের এক হকার মারা যান। রাত সোয়া আটটার দিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গে থাকা যুবকের মরদেহ শনাক্ত করেন তাঁর স্বজনেরা। গ্রামের বাড়ি মুন্সিগঞ্জে। শাহজাহান ভাড়া থাকতেন কামরাঙ্গীরচর চাঁদ মসজিদ এলাকার জলিল মিয়ার বাসায়। তাঁর একটি শিশু সন্তানও আছে। শাহজাহান নিউমার্কেটের বলাকা সিনেমা হলের সামনে ফুটপাতে হকারি করে পাপোশ বিক্রি করতেন। বাবা মহসিন আলী অনেক আগেই মারা গেছেন। চার ভাইয়ের মধ্যে শাজাহান ছিলেন তৃতীয়।

মর্গের সামনে মা কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘আমার ছেলের দোষ কোথায়? কে মারল, কারা মারল—কিছুই তো বুঝতে পারছি না।’

ঢাকায় নিহত অপরজন ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের কর্মী সবুজ আলী। নিউমার্কেট থানার (এসআই) মাহবুব আলীর ভাষ্য অনুযায়ী, তিনি খুব গরিব পরিবারের সন্তান। তার বাবা দিনমজুরের কাজ করেন। বড় ভাই গাজীপুর এলাকায় থাকেন। তাদের একটি প্রতিবন্ধী ভাইও আছে। তাঁর মৃত্যুতে শোক জানিয়ে ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক একটি বিবৃতি দিয়েছেন। কিন্তু কোনো শোক বা বিবৃতি সবুজ আলীকে ফিরিয়ে আনতে পারবে না।

চট্টগ্রামে নিহত তিনজনের মধ্যে একজন ছাত্রলীগ ও একজন ছাত্রদলের কর্মী বলে নিজ নিজ সংগঠন থেকে দাবি করা হয়েছে। যে কোনো আন্দোলন–সংগ্রামে গরিব মানুষই বেশি মারা যান। কোটা সংস্কার আন্দোলন করতে গিয়ে আবু সাঈদসহ ছয়জনকে জীবন দিতে হলো, এর দায় কে নেবে?

এবারে কোটা সংস্কার আন্দোলনটি শুরু হয়েছিল অত্যন্ত শান্তিপূর্ণভাবে। আন্দোলনকারীরা বলছেন, তারা সংস্কার চান। সরকার বলছে, তারাও সংস্কার চায়। তাহলে এই পরিস্থিতির উদ্ভব হলো কেন? সরকারের দাবি, শিক্ষার্থীদের আন্দোলনটিতে তৃতীয় পক্ষ ঢুকে এসব করেছে। কিন্তু তৃতীয় পক্ষ ঢোকার আগে কেন তারা শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনায় বসলেন না?

নিউমার্কেট এলাকায় হকার মো. শাহজাহান যে মারা গেলেন, আন্দোলনকারী কিংবা তাঁদের বিরোধীদের সঙ্গে তাঁর কোনো সম্পর্ক ছিল না। প্রতিদিনের মতো তিনি ফুটপাতে বসেছিলেন পাপোষ বিক্রি করতে। ফিরে গেলেন লাশ হয়ে। এই রাষ্ট্র কী জবাব দেবে তাঁর শিশু সন্তান ও স্ত্রীর কাছে?

আমাদের মনে আছে, দুই বছর আগে ঢাকা কলেজে ছাত্রলীগের সঙ্গে নিউমার্কেটের ব্যবসায়ীদের সংঘর্ষের জেরে দুই হকারকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছিল। বাংলাদেশের মানুষের জীবন এতই তুচ্ছ!

মৃত্যুর আগে রংপুর রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ উনসত্তরের শহীদ রাজশাহী  বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শামসুজ্জোহাকে উদ্দেশ্য করে লিখেছিলেন, ‘স্যার, এই দিনে আপনাকে সবচেয়ে বেশি মনে পড়ে, স্যার।’ এর মাধ্যমে তিনি চেয়েছিলেন, তাঁদের ন্যায্য আন্দোলনে শিক্ষকেরাও সমর্থন করুন। তাঁদের পাশে এসে দাঁড়ান। এর কয়েক ঘণ্টা পরই আবু সাঈদ লাশ হয়ে গেলেন। নামাজে জানাজার সময় তাঁর বড় ভাইয়ের আকুতি সমবেত সবাইকে স্পর্শ করেছে। ৯ ভাই–বোনের মধ্যে আবু সাঈদই বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে পেরেছিলেন। তাঁকে নিয়ে তাঁদের অনেক স্বপ্ন ছিল।

প্রতিটি মানুষের স্বপ্ন থাকে, ইচ্ছা থাকে। রাষ্ট্রের কর্তব্য হলো সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথ করে দেওয়া। গুলি করে আন্দোলনকারীদের হত্যা করে পুরো পরিবারের স্বপ্ন চূর্ণ করে দেওয়া নয়।

১৯৮৭ সালে এরশাদ আমলে পুলিশের গুলিতে নূর হোসেন মারা যাওয়ার পর শামসুর রাহমান লিখেছিলেন ‘বুক তার বাংলাদেশের হৃদয়’। আজ শামসুর রাহমানের কবিতা ধার করে বলতে চাই—আবু সাঈদের বুক আজ বাংলাদেশের হৃদয়।

  • সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি