মানুষের ভালোবাসায় ঋদ্ধ যে জীবন

সৈয়দ হাসান ইমাম

আজ আমার আব্বু সৈয়দ হাসান ইমামের ৮৮তম জন্মবার্ষিকী। ১৯৩৫ সালের এই দিনে বর্ধমানে মামাবাড়িতে তাঁর জন্ম। দুই বছর বয়সে পিতৃহারা এক শিশু তাঁর সাহসী মা, দুই বছরের বড় একমাত্র ভাই আর মামাদের পরিচর্যায় বেড়ে ওঠেন। সেকালে অবশ্য পাড়া–প্রতিবেশী বা যেকোনো গুরুজনই অভিভাবক ছিলেন।

এই গুণী মানুষের কথা যখন ভাবি, তখন মনে হয়, সে যুগে বাবা না থাকা এক শিশু ২০ বছর বয়সী মায়ের তত্ত্বাবধানে মামাবাড়িতে অসংখ্য মানুষের একজন হয়ে বড় হয়েছেন। তাঁর তো গড্ডলিকায় ভেসে যাওয়ার কথা। দেশভাগের পর দুই ভাই মামাবাড়ি ছেড়ে পা বাড়ান স্বদেশে, অনিশ্চিত এক জীবনে। হাসান ইমাম ও আলী ইমামের দাদা খান বাহাদুর সৈয়দ সুলতান আলী বসবাস করতেন বর্ধমানে। কিন্তু ঢাকায় এসে জীবনযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন তরুণ সৈয়দ হাসান ইমাম। জীবিকার পাশাপাশি ক্লাব ক্রিকেট খেলা, থিয়েটার ও সংগীতশিক্ষাও শুরু করেন নতুন দেশে। এ বয়সের এত স্বাধীন তরুণকে কোন শক্তি এমন আদর্শে বলীয়ান করল? কীভাবে তিনি সারাটি জীবন ধরে একই আদর্শে দৃঢ় থেকেছেন? যেকোনো অবস্থানে থেকে মানুষের পাশে, ন্যায় ও সত্যের সঙ্গে দেশপ্রেমে একনিষ্ঠ থাকছেন এই মহান প্রাণ।

প্রকৃতপক্ষে মামাবাড়ির বামপন্থী পরিবেশ চরিত্রে প্রোথিত করেছিল আদর্শের বীজ। মানুষের প্রতি সহমর্মিতা, অসাম্প্রদায়িকতা, নারীকে সম্মান করা, সংস্কৃতিচর্চা—এ ধরনের সদ্‌গুণ ছোটবেলায়ই গেঁথে গিয়েছিল পারিবারিক ও রাজনৈতিক পরিবেশের কারণে। যখন যে বাস্তবতায় থাকেন না কেন, তিনি অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছেন সব সময়। একবারে স্কুলজীবনে বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে এক ব্রিটিশ সাহেব এসেছিলেন। স্কুলছাত্রদের সঙ্গে সেদিনের ৯ বছর বয়সী হাসান অগ্রণী হয়ে প্রতিবাদ জানায়। সে থেকেই তিনি দেশের প্রশ্নে আপসহীন যোদ্ধা।

তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে এসে সৈয়দ হাসান ইমাম সাংস্কৃতিক অঙ্গনে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। পরিচিতি লাভ করেন। ১৯৬১ সালে রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী উদ্‌যাপনে বাধা দিলে আন্দোলনে সক্রিয় হন তিনি। সিনেমার নায়ক হয়েও রাজপথে আন্দোলন করেন। রবীন্দ্রনাথের নাটক মঞ্চায়নে উদ্যোগী ভূমিকা পালন করেন। নাটক পরিচালনা ও অভিনয় করেন। তৎপরবর্তী স্বাধিকার আন্দোলনে সংস্কৃতিকর্মীদের অগ্রভাগে থেকে কাজ করে যান। ১৯৭০ সালে ভোলার ঘূর্ণিঝড়-পরবর্তী দ্রুততম সময়ে নিজ উদ্যোগে শিল্পী–কর্মী–সহযোদ্ধাদের একত্র করে ত্রাণসামগ্রী জোগাড় করে সেখানে চলে যান সদলবলে।

একজন সিনেমা পরিচালক একবার সৈয়দ হাসান ইমামকে বলেছিলেন, আপনি যে এভাবে সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশে আন্দোলন করেন, তাতে আপনার গ্ল্যামার তো কমে যাবে। দর্শক তো আপনাকে নিজেদের মতোই মনে করবেন। আপনার সিনেমা দেখবেন না। তখন তিনি বলেছিলেন, ‘নায়কেরা যদি দূর গ্রহের অচিন মানুষ হয়, তবে সে নায়ক আমি না। দর্শকেরা নায়ক হিসেবে না চাইলে নায়ক হব না।’ সত্যিই তিনি একাত্তর-পরবর্তী সময়ে আর নায়ক চরিত্র করেননি।

একাত্তরে তিনি আমাকে আর আম্মুকে দাদি ও চাচার কাছে রেখে যুদ্ধে যান। প্রথমে মুজিবনগরে শপথ গ্রহণের সাক্ষী হন। তারপর চলে যান ভারতে। যুদ্ধকালীন প্রধানমন্ত্রীর কাছে একটি ট্রান্সমিটার চেয়ে নিয়ে শিল্পী সংগঠকদের সঙ্গে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন সহযোদ্ধাদের সঙ্গে। মুক্তিসংগ্রামী শিল্পী সমিতি গড়ে তোলেন ভারতে চলে যাওয়া শিল্পীদের নিয়ে। অভুক্ত-অর্ধভুক্ত শিল্পীদের জন্য ভাতার ব্যবস্থা করে নিজ উদ্যোগে অর্থ সংগ্রহ করেন। রেডক্রসের সঙ্গে কথা বলে কম্বল ও গরম কাপড় বিতরণ করেন শিল্পী ও শিল্পী পরিবারগুলোর মধ্যে।

স্বাধীন বাংলাদেশে নিজের ডিস্ট্রিবিউশন অফিসটি কখনো উদীচীর বন্ধুদের মিটিং বা থাকার জায়গা, আবার কখনো টেলিভিশন নাট্যশিল্পী নাট্যকার সমিতির (টেনাশিনাস) কার্যালয় হয়ে উঠত। শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হওয়ার পর থেকে বিএমএ ভবনের কার্যালয়টি ডিস্ট্রিবিউশনের কাজ বন্ধ করে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির কার্যালয়ে পরিণত হয়। সিনেমা ও নাটক সব কাজ বন্ধ করে তিনি জেলায় জেলায় ঘুরে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পক্ষে জনমত গঠনের কাজ করেন। এ কাজের জন্য বিএনপি-জামায়াতের রোষানলে পড়েন। কয়েকবার তাঁর ওপর হামলা হয়। এমনকি বাড়িতে এসে ফ্রিডম পার্টির পেটোয়া বাহিনী আমার দাদির বুকে পিস্তল ধরে তাঁর ছেলেকে এসব থেকে দূরে থাকার জন্য হুমকি দেয়। তবুও এ জননী সাহসিকা ছেলেকে একবারের জন্যও তাঁর কাজ থেকে বিরত থাকতে বলেননি। মায়ের সম্পর্কে সৈয়দ হাসান ইমাম বলেন, ‘আমার মা গোর্কির মায়ের চেয়েও সাহসী।’

পরবর্তী সময়ে বিএনপি ক্ষমতায় এসে নানাভাবে গ্রেপ্তার ও অন্যায় অভিযোগ দেওয়ার চেষ্টা করলে তিনি দেশ ছেড়ে প্রবাসী ছেলেমেয়েদের কাছে চলে যান। সাত বছর দেশে ফিরতে না পারলেও যেখানে যখন থেকেছেন, দেশের সংস্কৃতি নিয়ে কাজ করেছেন। দেশে সংঘটিত অন্যায়–অবিচারের প্রতিবাদ করেছেন প্রবাসে থেকেই।

আমার আব্বু সব সময় চেয়েছেন তাঁর সন্তানেরা তাঁর প্রাণের গানের ভাষাটা ধারণ করুক। আমরা ভাই–বোনেরা নিজ নিজ স্থান থেকে চেষ্টা করে যাই আব্বুর আদর্শকে ধারণ করতে। অসাম্প্রদায়িকতার চর্চা করতে। জীবনে মানবতার আদর্শ চর্চা করতে, জন্মভূমিকে ভালোবাসতে। একজন সৈয়দ হাসান ইমাম হওয়া আমাদের পক্ষে অসম্ভব। তবে তাঁর পদাঙ্ক অনুসরণ করে রাজপথে আন্দোলন–সংগ্রামে ব্রতী হয়েছি। সৎ, মানবিক, অসাম্প্রদায়িক জাতি গঠনে শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন ও শিশুদের জন্য সাহিত্য রচনা করে বোধের উদয়ে চেষ্টা করে যাচ্ছি।

আব্বুর এই ৮৮তম জন্মবার্ষিকীতে তাই বলতে চাই, আমার আব্বুর জীবনের অর্জন শুধু রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ পদক নয়; মানুষের ভালোবাসায় ঋদ্ধ তাঁর জীবন। তিনি তুষ্টির সঙ্গে বলেন, ‘আমি নায়করাজ হইনি; কিন্তু হাসান ইমাম তো হয়েছি।’ ভালোবাসি আব্বু। তোমার আদর্শে আজীবন যেন অটল থাকতে পারি।

  • সঙ্গীতা ইমাম শিক্ষক, লেখক ও সংস্কৃতিকর্মী