যে ইহুদিরা গাজায় গণহত্যার নিন্দা জানাচ্ছে

গাজায় অবিলম্বে ইসরায়েলি হামলা বন্ধ ও যুদ্ধবিরতির দাবিতে যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস ভবনে ইহুদিদের বিক্ষোভ।
ছবি: এএফপি

আল-আহলি আল–আরাবি ব্যাপ্টিস্ট হাসপাতালে বোমা হামলায় ৫০০ জনসহ টানা হামলায় সাড়ে ৩ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনিকে হত্যার পর এখন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিবিদদের পক্ষে গাজার নিধনযজ্ঞের ঘটনা উপেক্ষা করা অসম্ভব। গাজায় হামলায় কমপক্ষে ৫০টি পরিবার পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। নারী, শিশু, নবজাতকসহ তাঁদের পরিবারের প্রত্যেক সদস্য নিহত হয়েছেন।

গাজায় যাঁরা এখনো রয়েছেন, তাঁদের উদ্দেশে আলটিমেটাম দিয়েছে ইসরায়েল। এর অর্থ হলো, উত্তর গাজার ১১ লাখ বাসিন্দাকে তাঁদের বসতি খালি করে চলে যেতে হবে। তাতে ব্যর্থ হলে বোমা হামলা ও স্থল অভিযানে মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়াতে হবে তাঁদের।

জাতিসংঘ বলেছে, এ ধরনের গণ-অপসারণ অসম্ভব এবং এর ফলে মারাত্মক মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি হবে। জাতিসংঘ ইসরায়েলকে তাদের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার জন্য মিনতি করেছে। জাতিসংঘের বিশেষ প্রতিনিধি এই আদেশকে খুব স্পষ্ট করে বলেছেন, ‘মানবতাবিরোধী অপরাধ ও আন্তর্জাতিক আইনের নির্লজ্জ লঙ্ঘন।’

আরও পড়ুন

আন্তর্জাতিক আইনে গণহত্যার সংজ্ঞা নির্ধারিত হয় দুটি বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে। কোনো জাতি, আদিবাসী, বর্ণ অথবা ধর্মীয় গোষ্ঠীকে পুরোপুরি অথবা আংশিকভাবে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার অভিপ্রায় এবং সেই অভিপ্রায় থেকে কোনো গোষ্ঠীকে ধ্বংস করে দেওয়ার প্রচেষ্টা।

গাজা ও সেখানকার বাসিন্দাদের নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার সব আয়োজন ইসরায়েল শেষ করেছে বলেই মনে হচ্ছে। ইসরায়েলের প্রেসিডেন্ট আইজাক হেরজোগ বলেছেন, গাজার বাসিন্দারা নিষ্পাপ বেসামরিক নাগরিক নন। পুরো জাতিই দায়ী। এটা মোটেও সত্য নয় যে সাধারণ নাগরিকেরা কিছু জানেন না, কিংবা সম্পৃক্ত নন। এই বক্তব্য আন্তর্জাতিক আইনের বিরোধী।

আন্তর্জাতিক আইনে সামষ্টিক শাস্তি এবং বেসামরিক লোকদের লক্ষ্যবস্তু বানানো নিষিদ্ধ। এই দুটি কাজই যুদ্ধাপরাধ। প্রেসিডেন্টের বক্তব্য থেকে এটাও স্পষ্ট যে গাজায় হামলা চালানোর ক্ষেত্রে কোনো সংযম দেখাচ্ছে না ইসরায়েল।

আরও পড়ুন

জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুতির যে কাজটা ইসরায়েল শুরু করেছে, সেটি গণহত্যা বিষয়ে পণ্ডিত এবং হলোকাস্ট  মিউজিয়ামের মতো সংস্থার বিবেচনায় দশম ধাপের বা চূড়ান্ত ধাপের গণহত্যা। এই ধাপে স্বতঃস্ফূর্তভাবে কিংবা পানি ও খাদ্য সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়ার মতো অমানবিক উপায়ে অথবা ‘সন্ত্রাসবাদবিরোধী অভিযানের’ নামে সামরিক অভিযানের মাধ্যমে গণহত্যা সংঘটিত হতে পারে।

ইসরায়েল এখন গণহত্যা সংঘটনের সেই স্তরেই রয়েছে। গাজায় নির্বিচার বোমা হামলাকে ইসরায়েলের কর্মকর্তারা সন্ত্রাসবাদবিরোধী অভিযান তকমা দিয়ে ন্যায্যতা দিতে চাইছে। ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী বলেছেন, ‘আমরা নরপশুদের সঙ্গে লড়াই করছি।’ এ ধরনের অমানবিক ভাষার ব্যবহার একটা গণহত্যা শুরু করার জন্য সব সময় ব্যবহার করা হয়। ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেছেন, ঘটনাক্রমে একদিন গাজা তাঁবুর শহরে পরিণত হবে। সেখানে কোনো ভবন থাকবে না।

আরও পড়ুন

প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বারবার বলে চলেছেন, গাজায় যে গণমৃত্যু শুরু হয়েছে, ‘সেটা কেবল শুরু’। প্রতিরক্ষামন্ত্রী বলেছেন, গাজা উপত্যকা পুরোটাই দখলে নেওয়া হবে। বিদ্যুৎ, পানি, জ্বালানি ও খাবার বন্ধ করে দেওয়া হবে। ইসরায়েলের পার্লামেন্টের একজন সদস্য খোলাখুলিভাবে এটিকে দ্বিতীয় নাকবা বলেছেন। ১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিন থেকে গণবাস্তুচুতির প্রসঙ্গ তিনি স্মরণ করিয়ে দেন।

ইসরায়েলি নেতাদের এই মনোভাব মাঠের সেনাদের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়েছে। ইসরায়েলের জাতীয় টেলিভিশনে এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, এই যুদ্ধ শুধু হামাসের সঙ্গে নয়, এটি ‘সব বেসামরিক লোকদের সঙ্গে যুদ্ধ’। গাজা থেকে ফিলিস্তিনিদের নিশ্চিহ্ন করার এই অভিযান সন্দেহাতীতভাবে গণহত্যা।

আরও পড়ুন

ইহুদি হিসেবে আমরা এর নিন্দা জানাই। আমাদের জনপ্রতিনিধিরা শর্তহীনভাবে ইসরায়েলি নীতির প্রতি সমর্থন জানিয়ে আসছেন, আমরা এর নিন্দা জানাই। তাদের এই নীতির কারণেই দশকের পর দশক ধরে আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে ইসরায়েল দখলদারি বজায় রাখতে পারছে। আমরা যুক্তরাষ্ট্রের আইনপ্রণেতাদের বলব, তাঁরা যেন এর নিন্দা জানান। ইহুদিদের নাম করে একটি সম্ভাব্য গণহত্যায় অর্থায়ন করা সেমেটিক–বিরোধী কর্মকাণ্ড বন্ধের পদক্ষেপ নয়।

গত সপ্তাহে হামাসের আচমকা নৃশংস হামলায় ১ হাজার ৪০০ ইসরায়েলি নিহত হয়েছেন। ১৫০ জনকে তারা জিম্মি করেছে। এটি ভয়াবহ একটি ঘটনা, আমরা নিঃশঙ্ক চিত্তে শোক জানাই। আর কোনো মানুষের যেন মৃত্যু না হয়, জিম্মিদের যেন মুক্ত করা যায়, সেটিই অগ্রাধিকার দিতে হবে।

আমরা আমাদের ইহুদি সম্প্রদায়ের প্রতি এই প্রশ্ন রাখতে চাই, ফিলিস্তিনে যখন সাধারণ মানুষেরা মারা গেছেন, সে সময় তাদের শোক ও দুঃখ কোথায় ছিল? ইসরায়েলের সেনারা যখন ফিলিস্তিনি শিশুদের ধরে নিয়ে গিয়েছে, তখন তারা কী করেছে?

আরও পড়ুন

মানবাধিকার সংস্থার বি’টিসেলেম জানাচ্ছে, ২০০০ সাল থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক সংঘাতের আগ পর্যন্ত ১০ হাজার ৬০০ ফিলিস্তিনি ও ১ হাজার ৩২৯ ইসরায়েলি নিহত হয়েছেন। তুলনা করলে ফিলিস্তিনি নিহতের সংখ্যা আট গুণ বেশি। ১৯৮৪ সাল থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত হাজার হাজার মানুষ নিহত হয়েছেন। এর বড় অংশই ফিলিস্তিনি। এই সংঘাতে দুই পক্ষে ক্ষয়ক্ষতির যে চিত্র, সেখানে ফিলিস্তিনিদের উপচে পড়া মৃত্যু আর বাস্তুচ্যুতির গল্পই।

আমেরিকান রাজনীতিবিদদের গরিষ্ঠতম অংশ ইসরায়েলের কর্মকাণ্ডে সম্মতি দিয়ে চলেছে। গাজায় যখন প্রতিদিন এক হাজার বোমা ফেলা হচ্ছে, তখন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বারবার করে বলে চলেছেন, ইসরায়েলের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের অঙ্গীকার অবিচল।

দ্রুত সহিংসতা বন্ধের আহ্বান না জানিয়ে ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকান—দুই শিবিরের আমেরিকান আইনপ্রণেতারা বলছেন, আমরা ‘ইসরায়েলের সঙ্গে আছি’।  হিসাব–নিকাশ পাল্টে দেওয়ার এবং ইসরায়েলকে আন্তর্জাতিক আইন মেনে চলতে বাধ্য করার ক্ষমতা তাদের আছে। কেননা, যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় সামরিক সহায়তা পাওয়া দেশ ইসরায়েল।

  • ইলন ব্রোটস্কি জায়নবাদবিরোধী সবচেয়ে বড় ইহুদি সংগঠন ভয়েস ফর পিস বে-এর  স্বেচ্ছাসেবক  

  • এরিয়েল করেন জায়নবাদবিরোধী ইহুদি আন্দোলনকর্মী