২০২২ সালে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেছে। আমরা ২০২০ আর ২০২১ সালে করোনা সংক্রমণের অর্থনৈতিক অভিঘাতগুলো কাটিয়ে ওঠার প্রচেষ্টা দেখেছি। কোনো কোনো জায়গায় বাংলাদেশের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানোরও একটা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল। বিশেষ করে রপ্তানি প্রবৃদ্ধি এবং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসার যে প্রক্রিয়া, সেটি চলমান ছিল। কিন্তু গত বছরের মার্চ–এপ্রিল মাসে রাশিয়া–ইউক্রেনের যুদ্ধের ফলে বাংলাদেশের অর্থনীতির বেশ কয়েকটি জায়গায় চাপের সৃষ্টি হলো। একটা মূল্যস্ফীতির চাপ। আমরা দেখলাম, যুদ্ধের কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে বিভিন্ন পণ্যের মূল্য অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পেয়ে গেল। জ্বালানি তেল থেকে শুরু করে নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্য, শিল্পকারখানার কাঁচামাল, যন্ত্রপাতি—এ রকম অনেক পণ্যের জন্যই বাংলাদেশ আমদানির ওপর নির্ভরশীল। আন্তর্জাতিক বাজারে যখন এসব পণ্যের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেল, তখন দেশের বাজারেও পণ্যের দামের ওপর এক অতিরিক্ত চাপের সৃষ্টি হলো। এ কথা খেয়াল করা দরকার যে ২০২১ সালেও আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে দেশে জ্বালানি তেলের দামের ঊর্ধ্বমুখী সমন্বয় হয়েছিল। কিন্তু ২০২২ সালের মাঝামাঝি এসে জ্বালানি তেলের মূল্যে একটা বড় ধরনের বৃদ্ধি হলো, যা অর্থনীতির ওপর বড় ধরনের একটা চাপ সৃষ্টি করেছে। বিশেষ করে ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে পণ্য পরিবহনসহ উৎপাদনের খরচ অনেক বেড়ে গেছে।
অর্থনীতির ওপর চাপের আরেকটা দিক হচ্ছে, সামষ্টিক অর্থনীতির ওপর বড় ধরনের চাপ। এই চাপের কারণ শুধুই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ নয়, এটা ২০২১ সালেই শুরু হয়ে গিয়েছিল। ২০২১-২২ অর্থবছরে আমদানিতে কোনো কোনো ক্ষেত্রে অস্বাভাবিক প্রবৃদ্ধি দেখা গেছে এবং এ কারণে ইতিহাসে সর্বোচ্চ বাণিজ্যঘাটতি হয়েছে। একই সঙ্গে যদিও রপ্তানিতে ভালো প্রবৃদ্ধি হয়েছে, রেমিট্যান্সে প্রবৃদ্ধি নেতিবাচক ছিল। সুতরাং বৈদেশিক মুদ্রা, বিশেষ করে ডলারের সরবরাহে বড় ধরনের ঘাটতির সৃষ্টি হয়েছিল। সেটা আমাদের সামষ্টিক অর্থনীতির ওপর, বিশেষ করে বৈদেশিক বাণিজ্যের লেনদেনের ভারসাম্যের ওপর একটা বড় ধরনের চাপের সৃষ্টি করেছে। এতে করে বাংলাদেশ ব্যাংক যেভাবে কয়েক বছর ধরে বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার কৃত্রিমভাবে ধরে রাখার চেষ্টা করেছে, সেটা আর সম্ভব হচ্ছিল না। কারণ, কৃত্রিমভাবে ধরে রাখার প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশ ব্যাংক যখনই দেখত যে মুদ্রাবাজারে কোনো কারণে সরবরাহ কমে গেছে, তখনই তারা বাজারে ডলারের সরবরাহ বাড়িয়ে দিত। এভাবে ডলারের সরবরাহ বাড়িয়ে–কমিয়ে অভ্যন্তরীণ বাজারে ডলারের চাহিদা ও জোগানের ভারসাম্য বজায় রাখার চেষ্টা করা হতো এবং এতে করে বৈদেশিক মুদ্রার লেনদেনে দীর্ঘদিন ধরে একধরনের স্থিতাবস্থা ছিল। এই প্রক্রিয়া কৃত্রিম এবং এতে অর্থনীতিতে একটা পুঞ্জীভূত সংকটের সৃষ্টি হচ্ছিল, যার বহিঃপ্রকাশে আমরা দেখলাম যে বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হারে একটা বড় ধরনের সামঞ্জস্য আনতে হলো। আমরা দেখলাম, খুব অল্প সময়ের মধ্যে ডলারের দাম ৩০ শতাংশের বেশি বেড়ে গেল। যদি গত এক দশকে ক্রমান্বয়ে বিনিময় হার সমন্বয় করা হতো, তাহলে বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হারে এ ধরনের বড় উল্লম্ফন আমাদের দেখতে হতো না। উদাহরণ হিসেবে ভারত, ভিয়েতনাম এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অনেক দেশের কথাই বলা যায়, যারা কিন্তু বাজারব্যবস্থার সঙ্গে সংগতি রেখেই বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার নির্ধারণ করে এবং কৃত্রিমভাবে বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার ধরে রাখার চেষ্টা করে না। হঠাৎ করেই ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায়, আমদানির খরচও বেড়ে গেছে। একই সঙ্গে দেশের বাজারে আমদানিনির্ভর পণ্যগুলোর দামও বেড়ে গেছে, যা মূল্যস্ফীতিতে বাড়তি ভূমিকা রেখেছে।
পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ—যেটি রপ্তানি ও রেমিট্যান্সের প্রবৃদ্ধির কারণে ২০২০ এবং ২০২১ সালে ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেয়েছিল—সেটিও কিন্তু ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে প্রতি মাসে এক বিলিয়ন ডলারের বেশি করে কমে গেছে।
২০২১ সালের শেষে আমাদের যে পরিমাণ রিজার্ভ ছিল, সেটি দিয়ে ছয়-সাত মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো যেত, কিন্তু রিজার্ভ এখন যেটি আছে, সেটি দিয়ে তিন থেকে সাড়ে তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাওয়ার ঘটনা সামগ্রিক অর্থনীতির সংকটকে ঘনীভূত করেছে।
২০২০ আর ২০২১ সালে আমাদের শ্রমবাজারে অনেকেই ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। অনেক পরিবার যারা দারিদ্র্যসীমার ওপর ছিল, তারা দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে গেছে। কোভিড মহামারি সংকটের মধ্যেও তারা ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছে। কিন্তু এই যে মূল্যস্ফীতির অস্বাভাবিক চাপ, যেটির ফলে এক দশকের মধ্যে জীবনযাত্রার ব্যয় সবচেয়ে বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে, সেটি কোভিড মহামারিতে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে নতুন করে অসহায়ত্বের দিকে ঠেলে দিয়েছে। আমরা দেখেছি, চাল থেকে শুরু করে অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্যের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। নিম্নবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত, এমনকি মধ্যবিত্ত পরিবারের অনেকেও এতে করে সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে এবং কারও কারও ক্ষেত্রে দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ার মতো অবস্থা তৈরি হয়েছে। কোভিডের সময় তারা কাজ হারিয়েছে অথবা তাদের আয় কমে গেছে, কারও কাছ থেকে ধার করতে হয়েছে এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে নিজেদের সঞ্চয় ভাঙতে হয়েছে। যখন মূল্যস্ফীতির কারণে নতুন করে অভিঘাতের সৃষ্টি হলো, তখন নতুন সংকট মোকাবিলা করার মতো আর কোনো উপায় তাদের ছিল না।
ফলে ২০২২ সালে সামগ্রিকভাবে আমরা বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতিতে যে রকম টানাপোড়েন ও সংকট দেখেছি, গত এক দশকে দেশের অর্থনীতির ওপর এমন চাপ দেখা যায়নি। দরিদ্র ও নিম্ন আয়ের মানুষও যে রকম চাপের মুখে পড়েছেন, সেটাও গত এক দশকে দেখা যায়নি। এ কারণে ২০২২ বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য একটা সংকটপূর্ণ বছর ছিল।
এখন কথা হলো, ২০২৩ সাল কেমন যাবে? নতুন বছরে আমরা কী ধরনের পরিবর্তন প্রত্যাশা করতে পারি? আমরা দেখতে পাচ্ছি, বিশ্ববাজারে একধরনের মন্দাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার পূর্বাভাসে দেখা যাচ্ছে যে বৃহৎ আন্তর্জাতিক বাজারগুলো, বিশেষ করে উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপের দেশগুলোয় মন্দাবস্থার সৃষ্টি হতে পারে। এমনকি চীনের মতো অর্থনীতিতেও সংকোচনের পরিস্থিতি দেখছি। এ অবস্থায় একদিকে বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য আশঙ্কা রয়েছে, বিশেষ করে যেহেতু বাংলাদেশের রপ্তানিবাজারের দুটো বড় কেন্দ্র হচ্ছে উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপ। এসব দেশে যদি মন্দাবস্থার সৃষ্টি হয় এবং দীর্ঘদিন বিরাজ করে, তাহলে বাংলাদেশের রপ্তানির ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে, যেটি নিয়ে একধরনের আশঙ্কা রয়েছে। তবে মন্দাবস্থার একটা উল্টো দিকও আছে। ২০২২ সালের একটা বড় সময়জুড়ে আমরা দেখেছি, আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের মূল্য অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। তার একটা বড় কারণ ছিল রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, যার ফলে বিশ্ববাজারের সরবরাহব্যবস্থা বড় ধরনের ধাক্কা খেয়েছে—পরিবহন খরচ বেড়েছে, অনিশ্চয়তা বেড়েছে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে আমরা আবার দেখছি যে আন্তর্জাতিক বাজারে বেশ কিছু পণ্যের দাম ক্রমান্বয়ে কমছে। এর মধ্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি পণ্য হচ্ছে জ্বালানি তেল। মন্দাবস্থার কারণে যদি এসব পণ্যের দাম কমে আসে, তাতে কিন্তু বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতির ওপর একটা ইতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। সে কারণে আশা করব, ২০২৩ সালে মূল্যস্ফীতি কমে আসবে। তার জন্য অবশ্যই দেশের বাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমানো প্রয়োজন। জ্বালানি তেলের দাম যখন বেড়েছিল, তখন সরকার তা বাড়িয়েছিল এই যুক্তিতে যে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়ছে বলে ভর্তুকি দিয়ে আর সরকারের পক্ষে তেল সরবরাহ করা সম্ভব হচ্ছে না। কিন্তু যখন আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমে যাচ্ছে, তখন কেন সরকার সেটির সঙ্গে সামঞ্জস্য করবে না? এ ক্ষেত্রে আমি ভারতের উদাহরণ দেব, সেখানে তারা আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম ওঠানামার সঙ্গে তাদের অভ্যন্তরীণ বাজারে দাম সামঞ্জস্য করার একধরনের স্বয়ংক্রিয় প্রক্রিয়া রেখেছে। তেলের দাম ঘোষণা দিয়ে কমানোর বা বাড়ানোর বিষয় সেখানে নেই। এই দিকে তাই নজর দেওয়া দরকার।
এসব কারণে তাই ২০২৩ সালে একটা আশা আছে, যেসব পণ্যের জন্য আমরা আমদানির ওপর নির্ভরশীল, সেগুলোর দাম আন্তর্জাতিক বাজারে কমলে আমরা সেটির একধরনের সুফল পেতে পারি।
তারপরও একটা আশঙ্কা রয়েই গেছে। সেটি হচ্ছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। এই যুদ্ধের পরিস্থিতি কোন দিকে যায়, নতুন করে আর কোনো সংকট সৃষ্টি হতে পারে কি না এবং নতুন করে বৈশ্বিক বাজারে সরবরাহব্যবস্থা বিঘ্নিত হয় কি না—সেদিকেও নজরে রাখার প্রয়োজন রয়েছে। কারণ, নতুন করে একটা সংকটের সৃষ্টি হলে, এখন পর্যন্ত যেসব পূর্বাভাস করা হচ্ছে, সেগুলোর অনেকগুলোই আবার নতুন করে হিসাব-নিকাশ করতে হবে।
২০২২ সালে আমরা যে সংকটের মধ্য দিয়ে গেছি, সেটি অনেক ক্ষেত্রেই সাম্প্রতিক সময়ে আমরা দেখিনি। কিন্তু আমি আশা করব, ২০২৩ সালে আমরা এই সংকট কাটিয়ে উঠতে পারব। বিশেষ করে মূল্যস্ফীতির রাশটা টেনে ধরা যাবে। সরকারের যে সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি, সেটির ব্যাপক প্রসারের প্রয়োজন রয়েছে। ২০২২ সালে এই কর্মসূচি সরকার কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রসারিত করেছে, কিন্তু এর আরও প্রসার দরকার। এই সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির ক্ষেত্রে নানা ধরনের যেসব সমস্যা আছে, বিশেষ করে দুর্নীতি, প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা, তালিকাভুক্তিকরণে ভুল—এগুলো সমাধান করতে হবে। পাশাপাশি সামষ্টিক অর্থনীতির কয়েকটি জায়গায় দীর্ঘদিন ধরে যেসব সমস্যা বিরাজ করছে, সেগুলোর দিকে নজর দিতে হবে। কর খাত, ব্যাংকিং খাত, বাণিজ্যনীতি, মুদ্রার বিনিময় হার—এসব খাতে আমরা কীভাবে সংস্কার করব এবং যৌক্তিকভাবে এসব সংস্কার কীভাবে বাস্তবায়ন করা যায়, সেদিকে আমাদের গভীরভাবে নজর দেওয়া দরকার।
এ ধরনের সংস্কারগুলো করতে পারলে এবং পাশাপাশি, পদ্মা সেতুর মতো অন্যান্য মেগা প্রকল্পগুলোর এবং কয়েকটি বিশেষায়িত অর্থনৈতিক অঞ্চলের দ্রুত বাস্তবায়ন করতে পারলে বিভিন্ন অভিঘাত ঠেকানোর সক্ষমতা বাংলাদেশ অর্জন করতে পারবে। তাতে সামনের দিনগুলোয় নতুন সংকট এলেও যে অর্থনীতির এ রকম অস্থিতিশীল অবস্থা হবে না, সেই আশাবাদ দেখছি।
লেখক: অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং নির্বাহী পরিচালক, সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং।
ই–মেইল: [email protected]