শুধু প্রবৃদ্ধি নয়, সার্বিক জীবনমানের দিকে দৃষ্টি দিতে হবে

সূত্র: বিশ্বব্যাংক

করোনার অভিঘাত থেকে অর্থনীতি পুনরুদ্ধার নিয়ে বিভিন্ন পূর্বাভাস দেওয়া হচ্ছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বলছে, চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৩ দশমিক ৮ শতাংশ এবং মাথাপিছু জিডিপি ভারতের ১ হাজার ৮৭৭ ডলার ছাড়িয়ে বাংলাদেশের ১ হাজার ৮৮৮ ডলার হবে। তবে বিশ্বব্যাংক বলেছিল প্রবৃদ্ধি কমে দাঁড়াবে ১ দশমিক ৬ শতাংশ।

বিশ্বব্যাংকের এ পূর্বাভাস বাংলাদেশের অর্থনীতির বর্তমান উত্তরণের সঙ্গে সামঞ্জস্যহীন নয় বলে ভিন্নমত পোষণ করেছেন অর্থমন্ত্রী। অধিকাংশ আলোচনা প্রবৃদ্ধিতেই আটকে আছে। কিন্তু পুনরুদ্ধারের সার্বিক বিষয় তথা কী ধরনের, কী উপায়ে এবং কার জন্য পুনরুদ্ধার নিয়ে আলোচনা অল্প বিস্তর।


নতুন দারিদ্র্য মোকাবিলা
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ‘কোভিড-১৯ বাংলাদেশ: জীবিকার ওপর অভিঘাত ধারণা জরিপ’ অনুযায়ী, এই মহামারির প্রথম চার মাসে বেকারত্ব ১০ গুণ বেড়ে যায়। বিবিএস জানাচ্ছে, আর্থিক সংকটে পড়া ৪৬ দশমিক ২২ শতাংশ পরিবার সঞ্চয় ভেঙে এবং ৪৩ শতাংশের বেশি পরিবার আত্মীয়স্বজনের সাহায্য-সহায়তায় সংসার চালিয়েছে।

১১ শতাংশ পরিবার জমি বিক্রি করেছে বা বন্ধক রেখেছে। সরকারি ত্রাণ বা অনুদান পেয়েছে মাত্র ২১ শতাংশ পরিবার। বিবিএসের জরিপ স্পষ্ট করেছে, চলমান উন্নয়ন কৌশল দুর্যোগ-দুর্বিপাকের অভিঘাত লাঘব করতে পারছে না।

অভিঘাত মোকাবিলায় পর্যাপ্ত সরকারি সহায়তার ব্যবস্থা নেই। ফলে অধিকাংশ মানুষ নিজেদের সর্বস্ব হারিয়ে দরিদ্র হয়ে পড়ছে। করোনার প্রভাবে দারিদ্র্য পরিস্থিতি পূর্বের চেয়ে দ্বিগুণের বেশি হবে বলে অনেক গবেষণা প্রতিষ্ঠান দেখিয়েছে। বিরাটসংখ্যক দরিদ্র জনগোষ্ঠীর অবস্থা পরিবর্তন করা না গেলে কাঙ্ক্ষিত বৈষম্যহীন পুনরুদ্ধার সম্ভব হবে না।


কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও সর্বজনীন সামাজিক নিরাপত্তা


বিবিএসের জরিপ অনুযায়ী, ৬৮ শতাংশ পরিবার আর্থিক সংকটে পড়েছে। সংকট থেকে উত্তরণে আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক খাতের নিয়োজিত সবার কর্মসংস্থান সুরক্ষা জরুরি। দেশের ৮৭ শতাংশ শ্রমিক অনানুষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত। বেতন সামান্য, দুর্ঘটনা বা অভিঘাতে কোনো সুরক্ষা নেই এবং যেকোনো সময় ছাঁটাইয়ের ঘটনা ঘটে। বিবিএস বলছে, পরিবার-পরিজন নিয়ে আর্থিক সংকটে পড়েছে ৮৫ শতাংশ রিকশা-ভ্যানচালক। দিনমজুর-শ্রমিকদের ৮৪ শতাংশ আর্থিক সংকটে।

ক্ষতিগ্রস্ত ৫০ লাখ দরিদ্র পরিবারের কাছে সরকারঘোষিত আড়াই হাজার টাকা করে প্রদানের চিত্র সুখকর নয়। প্রায় ১৫ লাখ পরিবার এখনো টাকা পায়নি। সব মিলিয়ে ২১ শতাংশ পরিবার সরকারি ত্রাণ বা অনুদান পেয়েছে। সুবিধাভোগী নির্বাচনে রয়েছে বিস্তর অনিয়ম।


এ জন্য প্রয়োজনীয় রাজস্ব প্রণোদনা, সহায়ক কাজ, দক্ষতা বৃদ্ধিকরণ প্রকল্প ও নতুন কর্ম সন্ধানের ব্যবস্থা দরকার। নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং গ্রামীণ অর্থনীতির পুনর্জীবন করতে প্রতিটি গ্রামকে ‘বিকাশ কেন্দ্র’ হিসেবে গড়ে তুলতে হবে।

একই সঙ্গে নগদ আর্থিক সহায়তা, শ্রমিকের অধিকারসমূহের স্বীকৃতি ও সুরক্ষা এবং সর্বজনীন সামাজিক নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা। সর্বজনীন সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি থাকলে মানুষের সঞ্চয় ভাঙা, জমি বিক্রয় বা বন্ধক রাখা অথবা আত্মীয়স্বজনের ওপর নির্ভর করতে হতো না। অর্থনীতিতে সামগ্রিক চাহিদাও হ্রাস পেত না।

সর্বজনীন স্বাস্থ্য ও শিক্ষা
আইইডিসিআর এবং আইসিডিডিআরবির যৌথ গবেষণা জানাচ্ছে, তিন মাস আগেই রাজধানীর ৪৫ শতাংশ মানুষ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছিলেন। করোনায় স্বাস্থ্য খাতের নাজুক দশা আরও প্রকট হয়েছে। কিন্তু এখনো স্বাস্থ্যসেবাকে সর্বজনীন করতে প্রয়োজনীয় সংস্কার ও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। স্বাস্থ্যসেবা পেতে নিজের পকেট থেকেই দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বোচ্চ পরিমাণের ৬৭ শতাংশ খরচ করতে হয়। দরিদ্র-প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য এবং প্রত্যন্ত অঞ্চলে অললাইন শিক্ষাকার্যক্রম তেমন কাজ করছে না। শিক্ষার্থীদের মূল্যবান শিক্ষাজীবনের দীর্ঘ একটি সময় বিনষ্ট হচ্ছে। অটো প্রমোশন দেওয়া হলেও শিক্ষা খাতের মৌলিক সমস্যা সমাধানের কোনো নীতিকাঠামো এখনো পরিলক্ষিত হয়নি। প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা দক্ষ শ্রমশক্তি তৈরি করতে সক্ষম হচ্ছে না; নতুন জ্ঞান সৃষ্টি ও নাগরিকত্ব তৈরিতেও ব্যর্থ হচ্ছে।


কুটির, ক্ষুদ্র, ছোট ও মাঝারি শিল্পে নজর
কুটির, ক্ষুদ্র, ছোট ও মাঝারি শিল্পে ঘোষিত ২০ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ঋণ বিতরণ হয়েছে মাত্র ২০ দশমিক ৫৬ শতাংশ। ব্যাংক খাতের প্যাকেজ থেকে বড় ব্যবসায়ীরা ঋণ নিতে পারলেও সিএমএসএমই খাত তেমন নিতে পারছে না। ১ হাজার ৭৮৬ জন বড় ব্যবসায়ীকে দেওয়া হয়েছে ২৩ হাজার ১৭৯ কোটি টাকা। অন্যদিকে ৯ হাজার ৫০ জন এসএমই খাতের উদ্যোক্তা পেয়েছে মাত্র ৩ হাজার ৫২২ কোটি টাকা। এ খাতসমূহ জিডিপির ৪০ শতাংশ। সম্পদ ও সুযোগ-সুবিধাগুলো গুটিকয় গোষ্ঠীর হাতে কেন্দ্রীভূত হলে বৈষম্য ও মেরুকরণ বৃদ্ধি পাবে।

কৃষি ও কৃষকের অবস্থার পরিবর্তনে গুরুত্বারোপ
বন্যায় ৩১টি জেলায় অল্প কদিনেই ১ লাখ ৪২ হাজার টন ফসলের ক্ষতি হয়েছে। বাজারমূল্যে এ ক্ষতি প্রায় ৩৫০ কোটি টাকা। করোনার অভিঘাতের সঙ্গে প্রাকৃতিক দুর্যোগের থাবায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র কৃষক। অন্যদিকে বাজারে কৃষিপণ্যের দাম বেশি হলেও কৃষক মধ্যস্বত্বভোগীদের প্রতাপে প্রকৃত মূল্য পাচ্ছে না। চাষাবাদে বৈচিত্র্য না থাকায় সমস্যা প্রকট হয়েছে।

কৃষিতে পর্যাপ্ত ভর্তুকির ঘাটতি রয়েছে। এ অর্থবছরে সরকার ভর্তুকিতে ৫০০ কোটি টাকা বাড়িয়েছে। মহামারির মুখে এই সামান্য বৃদ্ধি স্থিতিশীল খাদ্য সুরক্ষা তৈরি করতে যথেষ্ট নয়। করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের ৪ শতাংশ সুদে ঋণ বিতরণের সরকারি উদ্যোগ থাকলেও ব্যাংকগুলোর আগ্রহে ঘাটতি রয়েছে। গত পাঁচ মাসে ছয়টি ব্যাংক কৃষি খাতে কোনো ঋণই বিতরণ করেনি বলে খবরে প্রকাশ।


রপ্তানি পণ্য ও বৈদেশিক শ্রমশক্তি বাজারের বহুমুখীকরণ
রপ্তানি পণ্য ও বাজারের যেমন বহুমুখীকরণ ও বৈচিত্র্য দরকার তেমনি জনশক্তি রপ্তানির জন্যও নতুন বাজার খোঁজা জরুরি। করোনার কারণে নিয়মিত বিমান চলাচল বন্ধ হওয়ার আগে গত ২১ জানুয়ারি থেকে ১৭ মার্চ পর্যন্ত বিভিন্ন দেশ থেকে ফিরে এসেছেন ৬ লাখ ২৪ হাজারের বেশি প্রবাসী।

নিয়মিত বিমান চলাচল বন্ধ হওয়ার পর বিশেষ ব্যবস্থায় গত ছয় মাসে গত ১ এপ্রিল থেকে ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেশে ফিরে এসেছেন ১ লাখ ৬৫ হাজার ৬৫৮ জন প্রবাসী বাংলাদেশি। এসেই দেশে আটকা পড়েন তাঁরা। সম্প্রতি কর্মস্থলে ফেরার চেষ্টা করছেন। কিন্তু বিভিন্ন কারণে যেতে পারছেন না তাঁরা। এতে কর্মচ্যুতির আশঙ্কা রয়েছে।

মালয়েশিয়া ও আরব আমিরাতে দীর্ঘদিন ধরে কর্মী রপ্তানি বন্ধ থাকায় একটি মাত্র দেশ সৌদি আরবের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে বাংলাদেশ। ইউরোপের অনেক দেশে বাংলদেশি শ্রমিকদের প্রবেশের অনুমতি নেই। যুক্ত হয়েছে বৈদেশিক শ্রমবাজার নিয়ে বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক রাজনীতি। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে জনশক্তি রপ্তানির বাজার ক্রমেই সংকুচিত হচ্ছে। অন্যদিকে ভূরাজনৈতিকভাবে বাংলাদেশ ক্রমেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠলেও নতুন বাজার সৃষ্টি, সংযোগ স্থাপন এবং বঙ্গোপসাগরের বিপুল সম্পদ ব্যবহারে কার্যকরী কৌশল গ্রহণ ও বাস্তবায়নের উদ্যোগও দৃশ্যমান নয়।

বৈষম্য হ্রাসে জোর পদক্ষেপ
কোভিড মহামারি প্রকট অসমতা আরও উন্মোচিত করেছে। উন্নয়ন অন্বেষণ গবেষণায় দেখিয়েছে, বেকারত্ব বৃদ্ধি পাওয়া এবং অনানুষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের আয় বন্ধ হয়ে যাওয়ায় জিনি সহগ ০.৩২ থেকে বেড়ে ০.৫০ এবং পা’মা রেশিও ২.৯৩ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। করোনার কারণে কিছু কিছু খাতের আয় অনেক গুণ বেড়েছে আর অধিকাংশ খাতের আয় কমেছে। প্রচলিত কায়দায় সরকারের গৃহীত বিভিন্ন প্রণোদনা, নীতি-কৌশল নতুন দরিদ্র এবং বেকারদের সমস্যা সমাধানে কাজ করেনি। প্রণোদনাগুলো মূলত ক্ষমতাশালী মানুষের উপকারে লেগেছে। ক্রমবর্ধমান বৈষম্যের লাগাম টেনে না ধরতে পারলে সর্বজনীন পুনরুদ্ধার হবে না।


পুনরুদ্ধারের মূলনীতি
সংকট কাটিয়ে উঠতে এখানে সাতটি মূলনীতি উল্লেখ করা হয়েছে। এগুলোর আলোকে নীতি-কৌশল নেওয়া গেলে এখনো তুলনামূলকভাবে একটি বৈষম্যহীন পুনরুদ্ধার সম্ভব হবে।

প্রথমত, সর্বজনীন প্রাথমিক আয় হিসেবে প্রতিটি নাগরিকের কাছে অবশ্যই নগদ অর্থ পৌঁছাতে হবে।

দ্বিতীয়ত, গণদ্রব্য যেমন শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির সর্বজনীন ব্যবস্থা করতে হবে।

তৃতীয়ত, কতিপয় ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর স্বার্থ চিন্তা না করেই সংখ্যাগরিষ্ঠদের স্বার্থে নীতি-কৌশল গ্রহণ করতে।

চতুর্থত, রপ্তানি প্রতিযোগিতা বাড়ানোর জন্য রপ্তানিমুখী পণ্য এবং বাজারের বৈচিত্র্যকরণে গুরুত্বারোপ করতে হবে।

পঞ্চমত, টেকসই ও সবুজ বিকাশের জন্য উত্পাদন ব্যবস্থা অবশ্যই সবুজ এবং পরিবেশবান্ধব করতে হবে।

ষষ্ঠত, শুধু মুদ্রানীতিনির্ভর না হয়ে রাজস্ব ও মুদ্রানীতির সমন্বয়ে নতুন বিনিয়োগ এবং নতুন কর্মসংস্থান তৈরি করতে হবে।

সপ্তমত, কর্মসূচি এবং নীতিগুলো নির্দিষ্ট লক্ষ্যভিত্তিক হতে হবে, যাতে অর্থনীতিতে গুণকপ্রভাবক সৃষ্টিতে সক্ষম খাতে বিনিয়োগ বাড়ে।


ড. রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক এবং ‘উন্নয়ন অন্বেষণ’–এর চেয়ারপারসন

[email protected]