লেখক ও সাংবাদিক শাহরিয়ার কবিরের জন্ম ১৯৫০ সালের ২০ নভেম্বর, ঢাকার ইসলামপুরে। ঢাকার সেন্ট গ্রেগরিজ স্কুল থেকে মাধ্যমিক এবং তৎকালীন জগন্নাথ কলেজ থেকে তিনি উচ্চমাধ্যমিক পাস করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলায় স্নাতকে (সম্মান) অধ্যয়নকালে একাত্তর সালে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন তিনি। ১৯৭২ সালে সাংবাদিক হিসেবে যোগ দেন সাপ্তাহিক বিচিত্রায় এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে গঠিত গণ-আদালতের সঙ্গে যুক্ত থাকার কারণে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলার পর ১৯৯২ সালে সরকার কর্তৃক পদচ্যুত হওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি বিচিত্রার নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। শহীদজননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে গঠিত একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। মুক্তিযুদ্ধে বিদেশি বন্ধুদের সম্মাননা প্রদানের জন্য যে জাতীয় কমিটি গঠন করা হয়, তারও অন্যতম সদস্য তিনি।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মিজানুর রহমান খান
প্রথম আলো একাত্তরের বিদেশি বন্ধুদের সম্মাননা জানাতে আপনারা যে বিরাট আয়োজন করলেন, পদক দিলেন সেটি শেষ পর্যন্ত স্বর্ণ কেলেঙ্কারিতে পরিণত হলো? কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
শাহরিয়ার কবির আমাদের তো একটি ব্র্যান্ড তৈরি করতে হবে। হঠাৎ করে পদক দিলাম, তার গুরুত্বটা কী। যেকোনো পুরস্কারের অর্থমান গুরুত্ব বাড়ায়। নোবেল পুরস্কার এত গুরুত্ব পেত না, যদি না সেখানে অর্থমান যুক্ত থাকত। শওকত ওসমানকে দেওয়া স্বাধীনতা পদক নিয়ে এরশাদ আমলে কেলেঙ্কারি ঘটেছিল। তিনি তাঁর পদক বিক্রি করতে গিয়ে দেখেন, তাতে খাদ মেশানো। সোনা নেই।
প্রথম আলো তার মানে দুর্নীতি হতে পারে, সে বিষয়ে আপনারা হুঁশিয়ার ছিলেন?
শাহরিয়ার কবির আমরা সতর্ক ছিলাম। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর বিষয়ে আমরা যখন প্রধানমন্ত্রীর কাছে প্রস্তাব পাঠালাম যে তাঁর ক্রেস্ট পুরোটাই সোনা দিয়ে মোড়ানো হবে। সেখানে কয়েক কেজি সোনা দরকার হবে। প্রধানমন্ত্রী বললেন, ইন্দিরা গান্ধীকে দেওয়ার জন্য সোনার অভাব হবে না। ডিজাইন করার পরে সেই ক্রেস্টের ওজন সাড়ে তিন কেজি ছাড়িয়ে গিয়েছিল। তখন রাষ্ট্রপতির দপ্তর আপত্তি জানাল। বলল, এটা এত ভারী যে রাষ্ট্রপতি বহন করতে পারবেন না। তখন ওজন কমানো হলো। আপনারা জানেন, তিন-চারটি ক্যাটাগরিতে পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। ইন্দিরা গান্ধীকে যে ক্যাটাগরিতে দেওয়া হয়েছে, সেটা অনন্য। এই পুরস্কার বাংলাদেশ কাউকে কখনো আর দেবে না। দ্বিতীয় ও তৃতীয় ক্যাটাগরির মধ্যে তফাত হলো সোনার পরিমাণ কমবেশিতে।
প্রথম আলো ইন্দিরার পদক কি সবার আগে বানানো হয়?
শাহরিয়ার কবির সবার আগে, ২০১১ সালে।
প্রথম আলো ওই ক্রেস্ট আণবিক শক্তি কমিশনে পাঠানো হয় এবং অনিয়ম ধরা পড়ে। সেটা আবারও বানানো হয়। আপনাদেরও নজরদারি ছিল। প্রশ্ন হলো, তখনই কেন সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলো না? এই সেই প্রতিষ্ঠান, যাদের জালিয়াতি এখন উদ্ঘাটিত হলো।
শাহরিয়ার কবির ওখানে খাদের বিষয় ছিল না। খাঁটি সোনায় তো গয়না হয় না, কিছু খাদ মেশাতে হয়। না হলে ওটা শক্ত হবে না। ওটা খাঁটি সোনার দৃষ্টিকোণ থেকে বলেছে। খাদের দিক থেকে নয়।
প্রথম আলো কবে জানলেন, এই কেলেঙ্কারি ঘটেছে?
শাহরিয়ার কবির প্রথম আলোর রিপোর্ট (৬ এপ্রিল) পড়ে জেনেছি। এর আগে জানতাম না।
প্রথম আলো ২০১২ সালের অক্টোবরে এই কেলেঙ্কারি উদ্ঘাটিত হয় এবং সরকার তা জানতে পারে। ১৮ মাস ধরে গোপন থাকাই যথেষ্ট বিস্ময়কর কি না? এখন তো প্রকাশ্যে এসেছে বলে লোক দেখানো কমিটি হয়েছে। হয়তো কারও সদিচ্ছা ছিল বলে নমুনা পাঠানো হয়েছিল, কিন্তু তার পরও নীরবতা কেন?
শাহরিয়ার কবির এর জবাব সরকারি কর্মকর্তারা দেবেন।
প্রথম আলো না, আমার প্রশ্ন হলো, এই বিষয়টিকে আপনি কীভাবে দেখছেন? এ রকম একটি সংবেদনশীল বিষয়ে...
শাহরিয়ার কবির তাৎক্ষণিকভাবে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত ছিল। সরকার ও মন্ত্রণালয় বললে বিষয়টি বিমূর্ত হয়ে যায়। আপনাকে চিহ্নিত করতে হবে, কোন কোন ব্যক্তি এর সঙ্গে জড়িত। মন্ত্রণালয়ের কথা যখন বলা হচ্ছে, তখন নিশ্চয়ই সেখানে কতিপয় ব্যক্তিকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তারা কারা। আপনাদের পত্রিকায় কিছু নাম এসেছে। সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের নাম এসেছে। বিভাগীয় কমিশনারের নেতৃত্বাধীন তদন্ত কমিটিতে আমরা সন্তুষ্ট নই। সংসদেও এ নিয়ে স্পিকারের নেতৃত্বে কমিটি গঠনের প্রস্তাব এসেছে। সর্বোচ্চ পর্যায়ে তদন্ত হতে হবে। দোষী ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হতে হবে। বদলি, বরখাস্ত—এসব নয়। দুর্নীতি সর্বত্রই। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এই দুর্নীতি ক্ষমাহীন অপরাধ। বিশেষ করে যেখানে বাংলাদেশের ভাবমূর্তির প্রশ্ন জড়িত। কমিটির সদস্য হিসেবে লজ্জায় অপমানে আমাদের মাথা হেঁট হয়ে গেছে, যখন প্রথম আলোয় এই রিপোর্টটি আমরা দেখিছি। পদকপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা যখন জানবেন বাংলাদেশ তাঁদের প্রতারিত করেছে, ব্যক্তি বা কমিটি নয়, সেখানে দেশ এসে যাবে। এই লজ্জা আমাদের সবার লজ্জা এবং সে জন্যই আমরা আজকেও (১০ এপ্রিল) মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে এ নিয়ে কথা বলেছি। আগামী ১৫ এপ্রিল কমিটি বৈঠকে বসছে—এটাই হবে সেখানে এক নম্বর এজেন্ডা।
প্রথম আলো অনেকগুলো সংস্থা একসঙ্গে সমান্তরাল তদন্ত করতে পারে। দুদক, বিচার বিভাগ, সংসদ—সবাই সম্পৃক্ত হতে পারে। আমাদের যেহেতু সবটাই ভাঙাচোরা। তাহলে এবারে সমান্তরাল তদন্ত চলুক।
শাহরিয়ার কবির আমি সেটাই মনে করি। সংসদ সবার ওপরে। অপরাধীকে যেমন খুঁজে বের করতে হবে। ব্যক্তি কেন করতে পারল, সেটাও খুঁজে বের করতে হবে। তবে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি যদি আমরা সর্বত্র চালু করতে না পারি, তাহলে এ ধরনের অপরাধ বন্ধ করা যাবে না। আমাদের মামলায় পাঁচ কোটি টাকার ক্ষতিপূরণ নিইনি। আমার টাকা দিয়ে পেটাবেন। আবার সরকার থেকে ক্ষতিপূরণ দেবেন। এটা অদ্ভুত আইন। শেখ হাসিনার প্রথম আমলে মির্জা আব্বাসদের এ রকম ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়েছিল। দরকারি আইনটি নেই। এ উপলক্ষে নতুন আইন তৈরি করতে হবে।
প্রথম আলো আপনারা কি তাহলে অবিলম্বে ওই আইন চাইছেন?
শাহরিয়ার কবির অবশ্যই। ব্যক্তিকে জবাবদিহির জায়গায় নিতে হবে। আমরা যখন বলি সরকার করেছে, সেটা বিমূর্ত হচ্ছে। সরকার মানে কী।
প্রথম আলো এ ঘটনায় রাজনৈতিক ব্যক্তিদের সম্পৃক্ততার বিষয়টিকে কীভাবে দেখছেন? যাঁরা মন্ত্রীর মর্যাদায় বা দলে বড় পদে আছেন?
শাহরিয়ার কবির অপরাধী অপরাধীই। তাদের সরকার বা দলে কার কী অবস্থান, দেখতে চাই না।
প্রথম আলো অত্যন্ত যুক্তির কথা। কিন্তু ভারতের কংগ্রেস যেভাবে কমনওয়েলথের ঘটনায় সুরেশকে বরখাস্ত করেছিল, সেভাবে আপনি কি বাংলাদেশের বর্তমান ক্ষমতাসীন দলের কাছ থেকে তেমন পদক্ষেপ আশা করেন? সেই বাস্তবতা সত্যিই দেখেন?
শাহরিয়ার কবির অন্যান্য দুর্নীতি না-ই হোক, মুক্তিযুদ্ধের সম্মাননার প্রশ্নে আমরা আপস করব না। আমেরিকা-ইউরোপেও দুর্নীতি হয়। টাকা দিয়ে মিডিয়া-এমপি কেনা যায়। দুই সপ্তাহ আগে একজন ব্রিটিশ সাংসদ, যাঁর জামায়াতের বিরুদ্ধে শক্তিশালী অবস্থান ছিল, তিনি এখন জামায়াতের ভাষায় কথা বলছেন। কারণটা কী?
প্রথম আলো আপনার বক্তব্য ইন্টারেস্টিং দিকে মোড় নিচ্ছে। অমন কিছুর পুনরাবৃত্তি কি এখানে ঘটার আশঙ্কা নাকচ করবেন?
শাহরিয়ার কবির না না, আমি তো সেটাই বলছি, এখানে হয়তো জামায়াতের ব্যাপার না। নিছকই দুর্নীতি। কিন্তু প্রশাসনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে জামায়াত বসে গেছে টাকা নিয়ে। সরকারের মধ্যেও তো জামায়াত ঢুকে গেছে। পদক দুর্নীতি ধরতে আপস নেই। এটা স্পর্শকাতর।
প্রথম আলো বিষয়টি স্ববিরোধী হলো কি না? অন্য দশটা ক্ষেত্রে যে সরকার দুর্নীতি থামাতে অপারগ এবং সেটা আমরা মানছিও। এখন একটি আদর্শিক কারণে এই সরকার পারবেই, তা কী করে সম্ভব?
শাহরিয়ার কবির বিশ্বজিৎ হত্যা মামলায় কেউ কি ভেবেছিল যে ছাত্রলীগ-যুবলীগের এভাবে ফাঁসির আদেশ হবে। নয়টি ফাঁসির আদেশ তো হয়েছে। এটা মিডিয়া ও মানুষের নজরদারিতে হয়েছে। মিডিয়া ওয়াচডগের ভূমিকা রাখছে, যেমন এই প্রতিবেদনের জন্য অবশ্যই আমি প্রথম আলোকে অভিনন্দন জানাব।
প্রথম আলো যে দেশে সংসদসহ প্রতিটি সাংবিধানিক সংস্থা দুর্বল থাকবে, সেখানে মিডিয়া চূড়ান্ত অর্থে ঘাটতি পূরণ করতে পারে না। আপনি যে তদন্ত ও নতুন আইন তৈরির কথা বলছেন, সেই শূন্যতা এভাবে পূরণীয় নয়।
শাহরিয়ার কবির ২২ বছর আগে নির্মূল কমিটি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি তুলল, তখন কেউ আজকের দিন কল্পনা করতে পারেনি। কিন্তু হয়েছে। জাহানারা ইমাম বলতেন, সরকারে যে-ই থাকুক, আমরা সরকারকে বাধ্য করব। সেটাই বাংলাদেশের সিভিল সোসাইটির শক্তি।
প্রথম আলো এই সরকারের ওপর এতখানি চাপ সৃষ্টি কি আপনাদের পক্ষে এখন সম্ভব, যদি তারা সেটা না চায়?
শাহরিয়ার কবির সরকারের আপত্তিটা কোথায়?
প্রথম আলো ওই যে ১৮ মাস হজম করার কথা বললাম, এটা তো এই সরকারই পেরেছে। তারা তো জেনেছে।
শাহরিয়ার কবির কে জেনেছে?
প্রথম আলো মন্ত্রণালয় জেনেছে।
শাহরিয়ার কবির মন্ত্রণালয়ের কারা জেনেছে, সেটাই খুঁজে বের করতে হবে। সাধারণভাবে মন্ত্রণালয় বললে অনেক শত্রু আড়াল হয়ে যাবে। বিমূর্ত একটি জিনিস সামনে আসবে। সে জন্য সব সময় বলি, সরকার কেন বলছেন। নির্দিষ্টভাবে বলুন।
প্রথম আলো সবাই আমরা বলছি, অত্যন্ত সাংঘাতিক ও সংবেদনশীল একটি ঘটনা ঘটে গেছে। কিন্তু সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কেউ পদত্যাগ করলেন না। প্রত্যেকে যে যেখানে আছেন, তাঁরা নিজ নিজ অবস্থান ব্যাখ্যা করছেন। সবই গতানুগতিক।
শাহরিয়ার কবির অপরাধী কেন পদত্যাগ করতে যাবে? তারা তো আত্মপক্ষ সমর্থন করতে চাইবে। তার পর কথা হচ্ছে, এখানে যদি আগের মন্ত্রী থাকতেন, বর্তমান মন্ত্রী কিছুই জানেন না।
প্রথম আলো ৩০০ জনের বেশি পদক পেয়েছেন। ৬১ জনের ক্ষেত্রে এটা ঘটল। বাকিগুলো?
শাহরিয়ার কবির আমরা খোঁজ নিয়েছি, সবগুলোর যাচাই সনদ রয়েছে।
প্রথম আলো সাতটি পর্বে পদক দানের মধ্যে কেবল তৃতীয় পর্বের ৬১ জনের ক্ষেত্রে পরীক্ষা হয়েছে।
শাহরিয়ার কবির ওইখানে তারা বলছে যে, সেবারে অনেকেই বলেছিলেন, তাঁরা আসতে পারবেন না। এখানে পর্বওয়ারি ভাগ করা হয়েছে, কারা কখন আসতে পারেন। শেষ মুহূর্তে নাম অদলবদল করতে হয়েছে। এগুলো করতে গিয়ে মাত্র তিন-চার দিন সময় পাওয়া গেছে। সেটার একটা সুযোগ নিতে পারে মন্ত্রণালয়। এখন পুরোটাই আমাদের যাচাই করে দেখতে হবে।
প্রথম আলো অনেকের মতে, কাজী সব্যসাচীর মতো অনেকে বাদ পড়েছেন। আপনারা ক্ষমতাসীন দলের সুহূদদের অগ্রাধিকার দিয়েছেন। তারা সুবিধা পেয়েছেন।
শাহরিয়ার কবির এটা ভিত্তিহীন সমালোচনা। বাস্তব কারণেই তালিকা অসম্পূর্ণ থাকতে বাধ্য।
প্রথম আলো কিন্তু কাজী সব্যসাচী?
শাহরিয়ার কবির তালিকায় তাঁর নাম আছে। সাড়ে ছয় শ জনের তালিকায় তিনি আছেন। আপনারা বড় তালিকা দেখছেন না।
প্রথম আলো অষ্টম পর্ব সম্মাননা কবে?
শাহরিয়ার কবির সভায় বসে ঠিক করব। এখনো ঠিক হয়নি।
প্রথম আলো আপনাকে ধন্যবাদ।
শাহরিয়ার কবির ধন্যবাদ।