বুদ্ধিজীবী হত্যার ধরন

বুদ্ধিজীবীদের হত্যার ধরন শুনলে নিজের কানকেই অবিশ্বাস করতে ইচ্ছে হবে
বুদ্ধিজীবীদের হত্যার ধরন শুনলে নিজের কানকেই অবিশ্বাস করতে ইচ্ছে হবে

১৯৮৮ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০০০ সালের ডিসেম্বরের ‘শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস’ পর্যন্ত বিটিভির আমন্ত্রণে, ওই দিবস সম্পর্কে আমার বিশেষ অনুষ্ঠান করার সুযোগ হয়েছিল। লক্ষণীয়, ১৯৮৮ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত তিনটি অর্থাৎ এরশাদ, খালেদা ও হাসিনা সরকার ক্ষমতায় ছিল, কোনো সরকারই ওই অনুষ্ঠানে বিধিনিষেধ আরোপ করেনি। আমি যথাসাধ্য আন্তরিকতায় ১৩ বছর অনুষ্ঠানটি করেছি।
আমি তখন বাংলা একাডেমিতে। সে সময় আমি একাডেমি থেকে ১৯৮৪ সালে শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মারকগ্রন্থ, ১৯৮৫ সালে শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষগ্রন্থ এবং ১৯৮৮ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত স্মৃতি: ১৯৭১, ১৩টি খণ্ড প্রকাশ করতে সক্ষম হয়েছিলাম। লেখা বাহুল্য, একাডেমি কর্তৃপক্ষ আমাকে দায়িত্ব দিয়েছিল বলে সাধ্য ও সামর্থ্য অনুসারে তা পালন করতে যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি। আমি এখনো দাবি করে বলি, স্মৃতি: ১৯৭১-এ সম্পাদক হিসেবে আমার নাম থাকলেও আমি ‘সম্পাদক’ নই, ‘সংগ্রাহক’ মাত্র। কারণ, যাঁরা আপনজন হারিয়েছেন, তাঁদের দুঃখকষ্ট শূন্যতা হাহাকার বেদনার কথা সম্পাদনা করা সম্ভব? অসম্ভব। দাপ্তরিক নিয়ম অনুসারে সম্পাদকের নাম ছাপতে হয়, তাই ছাপা।
এই সূত্রেই সবিনয়ে জানাই, উপরিউক্ত স্মৃতি: ১৯৭১ ১৩টি খণ্ডে তিন শতাধিক লেখা ছাপা হলেও লেখকদের মধ্যে মাত্র ২০ থেকে ২৫ জন ছিলেন প্রকৃত লেখক, আর অবশিষ্টগণ? তাঁদের অধিকাংশই জীবনেও একটা লাইন লেখেননি; তাঁরা আমার অনুরোধে অপারগতা জানিয়েছেন; আমি তাঁদের বলেছি, আপনার কাছে গল্প-কবিতা নয়, শহীদ বুদ্ধিজীবী সম্পর্কে শুধু স্মৃতিচারণাটি চাই। যাতে ইতিহাসের প্রয়োজনেই জানা যাবে তিনি কবে, কোথায়, কার দ্বারা কীভাবে শহীদ হয়েছিলেন।
অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, প্রকৃত লেখকদের চেয়ে অনেক ‘অলেখকের’ লেখা পড়ে আমি চোখের পানি ধরে রাখতে পারিনি, স্পষ্ট উপলব্ধি করেছি তাঁদের হৃদয়ে রক্তক্ষরণের শব্দ শুনছি, যেন চোখের সামনে হত্যাকাণ্ডটি দেখতে পাচ্ছি।
‘বুদ্ধিজীবী হত্যার ধরন’ শিরোনাম দেওয়ার কারণ হচ্ছে হত্যাকারীরা ‘শহীদ’দের বয়স বিবেচনা করেনি, তাঁদের শিক্ষা, মর্যাদা, দেশে-বিদেশে অবস্থান ও সম্মান, অবদান, স্বীকৃতি সবই তুচ্ছজ্ঞান করে নির্দয়ভাবে যন্ত্রণা দিয়ে হত্যা করেছে, পৈশাচিক উল্লাসে মেতে উঠেছে। একে একে বিবরণে এলে বোঝা যাবে তাদের নিষ্ঠুরতা কত গভীরে।
প্রথমেই আসা যাক আমাদের মহান ভাষা আন্দোলনের প্রথম প্রাণপুরুষ শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত প্রসঙ্গে। জন্মভূমি ছেড়ে যাননি, ৮৫ বছরেও দেশকে, ভাষাকে ভালোবেসে উচ্চারণ করেছিলেন, ‘আমার রক্তের ওপরে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পতাকা উড়বে।’ ২৯ মার্চ তাঁকে দ্বিতীয় পুত্রসহ কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে গিয়ে এমন অত্যাচার করা হয় যে তাঁকে হামাগুড়ি দিয়ে টয়লেটে যেতে হতো; সারা শরীরে ছিল বীভৎস অত্যাচারের ক্ষতচিহ্ন। শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের সঠিক মৃত্যুতারিখ জানা যায়নি, তাঁর মরদেহও পাওয়া যায়নি।
যাওয়া যাক চট্টগ্রামে। গভীর দেশপ্রেমে নিবেদিত নূতনচন্দ্র সিংহ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন সম্মানিত শিক্ষকের শত আন্তরিক অনুরোধ সত্ত্বেও তিনি রাউজান ত্যাগ করলেন না। সেই সুযোগটাই নেয় সদ্য মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী। নূতনচন্দ্র সিংহকে হত্যায় সে সরাসরি জড়িত। ৭০ বছরের বৃদ্ধকে পাকিস্তানি সৈন্যরা হত্যা না করে চলে গেলে সাকা চৌ সৈন্যদের পুনরায় ডেকে এনে হত্যা করায়। আজ সাধনা ঔষধালয়ের নাম জানেন না এমন লোক নেই বললেই চলে। ৮৮ বছরের বৃদ্ধ সাধনা ঔষধালয়ের প্রতিষ্ঠাতা যোগেশ চন্দ্র ঘোষ মাতৃভূমিকে ভালোবেসে দেশেই রয়ে গেলেন। কিন্তু ১৯৭১ সালের ৪ এপ্রিল স্বাধীনতাবিরোধীদের প্ররোচনায় গেন্ডারিয়ায় নিজ কার্যালয়ে পাকিস্তানি ঘাতকেরা তাঁকে নির্মমভাবে হত্যা করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবীণতম শিক্ষক আপন ভোলা দার্শনিক মানুষ ড. জি সি দেব কী অন্যায় করেছিলেন যে তাঁকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসগৃহ থেকে টেনেহিঁচড়ে বের করে নিয়ে গিয়ে জগন্নাথ হলের মাঠে ছাত্রদের সঙ্গে গুলি করে মারল, সবার সঙ্গে মাটিচাপা দিল?
চলে যাই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। ওখানে তিনজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক—হবিবর রহমান, সুখরঞ্জন সমাদ্দার ও মীর আবদুল কাইয়ুমকে যে হত্যা করা হলো, তার মধ্যে আবদুল কাইয়ুমের মৃত্যুদৃশ্যটি তো কল্পনাতেই আনা যায় না। তাঁকে পদ্মা নদীর তীরে গর্ত খুঁড়ে জীবন্ত কবর দেওয়া হয়। জানা যায়, রাজশাহীতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হত্যায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ড. সৈয়দ সাজ্জাদ হোসায়েনের প্রত্যক্ষ প্ররোচনা ছিল। তাঁর প্ররোচনা বা ভূমিকার কিছুটা পরিচয় দেওয়া যাক।
ড. সাজ্জাদেরই, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্যক্ষ ছাত্র, ইউনিভার্সিটির ডেপুটি রেজিস্ট্রার ও জনসংযোগ বিভাগের কর্মকর্তা নাজিম মাহমুদ ওই বিপদের দিনে শিক্ষকের কাছে ব্যাংক থেকে টাকা তোলার বিষয়ে পরামর্শ চাইতে গেলে ড. হোসায়েন নানা কথার পর বললেন: ‘দ্যাখো, আমি সবাইকে যে কথা বলি, ড. কাদেরকে সেদিন যে কথা বলেছি, তোমাকেও তাই বলি—ওরা যদি তোমাকে গুলি করতে চায়, তাহলে ঠিক কপালের মাঝখানে গুলি করতে বলো, Painless death, absolutelty Painless’ (যখন ক্রীতদাস: স্মৃতি ৭১—নাজিম মাহমুদ, মুক্তধারা, পৃষ্ঠা ৫৫, দ্বিতীয় প্রকাশ, ফেব্রুয়ারি ১৯৯৩)। এই ড. হোসায়েনই মুক্তিযুদ্ধকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসি হিসেবে এসে কিছু শিক্ষককে হত্যার প্ররোচনা দিয়েছিলেন, তালিকা দিয়েছিলেন। আমার প্রত্যক্ষ শিক্ষক অধ্যাপক রফিকুল ইসলামের কাছ থেকে জেনেছি, হত্যার উদ্দেশে্য তিনিসহ আরও কিছু শিক্ষককে প্রথমে রমনা থানায় নিয়ে গেলে ড. ইসলাম আর্মিদের অনেক অনুরোধ করে মধ্যরাতেই ভিসি ড. হোসায়েনকে ফোন করেছিলেন। ড. ইসলাম কাকে কাকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে গেছে বলা শেষ করতেই ড. হোসায়েন প্রবল আগ্রহে জানতে চাইলেন, ‘আর কাকে নিয়েছে?’ অধ্যাপক রফিকুল ইসলামের স্পষ্ট ধারণা হয়, ড. হোসায়েনের দেওয়া তালিকা অনুসারে সবাইকে নিয়েছে কি না সেটা জানতেই তিনি আগ্রহী ছিলেন। ড. হোসায়েন দেশ স্বাধীন হওয়ার আগেই পালিয়ে সৌদি আরব চলে গিয়েছিলেন। ফিরেছিলেন বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর।
বুদ্ধিজীবীদের হত্যার ধরন শুনলে নিজের কানকেই অবিশ্বাস করতে ইচ্ছা হবে। যশোরের আইনজীবী মশিউর রহমানকে এতটাই অত্যাচার করা হয় যে তাঁর চেহারা বীভৎসভাবে বিকৃত হয়ে যায়, তাঁকে তাঁর অতি আপনজনই চিনতে পারেননি। কী দোষ করেছিলেন কবি মেহেরুন্নেসা? ঢাকার মিরপুরে, তাঁর মাথাটা কেটে তাঁরই লম্বা চুল দিয়ে ফ্যানের সিলিংয়ে ঝুলিয়ে রাখা হয়। ঠাকুরগাঁওয়ে বহু বুদ্ধিজীবীকে জীবন্ত অবস্থায় বাঘের খাঁচায় ফেলে দেওয়া হয়েছিল। মিরপুরে ১০ নম্বর গোল চত্বরের অদূরে জল্লাদখানা নামক বধ্যভূমিতে বাঙালি জবাই করে করে একটা কুয়োয় ফেলে দেওয়া হতো, ওখানেই ইত্তেফাক-এর সাংবাদিক আবু তালেবকে জবাই করে হত্যা করা হয়। মাগুরায় লুৎফুননাহার হেলেন নামে এক স্কুল শিক্ষয়িত্রীকে জিপের পেছনে বেঁধে সারা শহর ঘুরিয়ে বোঝানো হয়েছিল স্বাধীনতা চাওয়ার ফল কী এবং সৈয়দপুরে ডা. শামশাদ আলী নামে একজন চিকিৎসককে ট্রেনের জ্বলন্ত কয়লার ইঞ্জিনের মধ্যে ছুড়ে ফেলে হত্যা করা হলো। সে সময় সৈয়দপুর ছাড়াও পার্বতীপুর, পাকশী, ঈশ্বরদী, পাহাড়তলী ইত্যাদি বড় রেলওয়ে জংশনে ইঞ্জিন জ্বালিয়েই রাখা হতো, কেবল ভেতরে ছুড়ে ফেলে দেওয়ার অপেক্ষায়।

আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ জীবিতকালে বলেছিল, দেশে কোনো যুদ্ধাপরাধী নেই। শেষে ফাঁসির দড়িতে দেখল সে নিজেই যুদ্ধাপরাধী এবং সাকা চৌধুরী হুংকার ছেড়ে বলেছিল, ‘দাঁড়া, বেরোই আগে।’ হ্যাঁ, ওই যুদ্ধাপরাধী বেরিয়েছে ঠিকই, তখন সঙ্গে তার প্রাণটিই নেই।
রশীদ হায়দার: কথাসাহিত্যিক।

আরও পড়ুন: